পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় ক্রমশ লম্বা হয়ে যাচ্ছে কোরিয়ান কিশোর-কিশোরীরা। দক্ষিণ কোরিয়ায় গত ১০০ বছরে পুরুষদের গড় উচ্চতা বেড়েছে ৪-৫ ইঞ্চি এবং মহিলাদের ৩-৪ ইঞ্চি। কোরীয় মন্ত্রকের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
সে দেশের বাণিজ্য, শিল্প ও জ্বালানি মন্ত্রকের অধীনস্থ এজেন্সি ফর টেকনোলজি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে ১১ থেকে ১৯ বছর বয়সি ১ হাজার ১১৮ জন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, এক দশক আগেও যে পরিমাণ উচ্চতা বাড়ত এই বয়সিদের, তার তুলনায় অনেকটাই লম্বা হয়ে গিয়েছে এরা।
এ ছাড়া আরও একটি পরিসংখ্যান উঠে এসেছে গবেষণায়, যা দেখে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে গবেষকদের। বয়সের তুলনায় আগেই পরিণত হয়ে উঠছে কিশোর-কিশোরীরা। অর্থাৎ কৈশোর পেরোতে না পেরোতেই যৌবনের আগমন ঘটছে তাদের শরীরী গঠনে।
এক শতাব্দী আগেও দক্ষিণ কোরীয়রা ছিলেন বেশ ছোট। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ কোরিয়ার মহিলাদের গড় উচ্চতা ছিল প্রায় ৪ ফুট ৭ ইঞ্চি, বা ১২৪ সেন্টিমিটার, যেখানে আমেরিকান মহিলাদের গড় ছিল প্রায় ৫ ফুট ২ ইঞ্চি বা ১৫৯ সেন্টিমিটার।
এক শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী মানুষ গড়ে প্রায় ৩ ইঞ্চি বৃদ্ধি পেয়েছেন। সেখানে কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ায় মহিলারা ৪ ইঞ্চি এবং পুরুষেরা গড়ে ৫-৬ ইঞ্চি বৃদ্ধি পেয়েছেন।
বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণা করে নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন মানুষের উচ্চতার জন্য জেনেটিক্সকে কতটা দায়ী করা যেতে পারে। উচ্চতা বৃদ্ধি কতটা আমাদের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয় তা-ও গবেষণার একটি অন্যতম বিষয় ছিল। পুষ্টিগত ও অর্থনৈতিক এই দু’টি বিষয় এর সঙ্গে জড়িত বলে মনে করছেন তাঁরা।
একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, উন্নত পুষ্টি এবং কম রোগের পরিবেশে বেড়ে ওঠার ফলে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে উচ্চতার লক্ষণীয় পার্থক্য দেখা দেয়। দক্ষিণ কোরিয়া হল এর একটি অনন্য উদাহরণ।
বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলোর তালিকায় দক্ষিণ কোরিয়া দ্বাদশ স্থানে রয়েছে। এশিয়ায় চতুর্থ। বিত্তশালীই বলা যায় এই দেশটিকে। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে সমৃদ্ধ ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে অর্থনীতির দিক থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটির জিডিপি ১৯৬০ সালে ছিল প্রায় ১৫৮ ডলার। সেই জায়গা থেকে ২০২১ সালে জিডিপির পরিমাণ আকাশচুম্বী হয়, ৩৫ হাজার ডলারে পৌঁছয় তা।
প্রাথমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে করা সমীক্ষায় উঠে এসেছে, উভয় শিক্ষার্থীই বয়সের তুলনায় দ্রুত তাদের সর্বোচ্চ বৃদ্ধির স্তরে পৌঁছেছে। ছেলেদের বৃদ্ধির হার ১৪ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৩ থেকে ১৪ এর মধ্যে সর্বোচ্চ বৃদ্ধির হার। ১০ বছরের আগের তুলনায় এখন প্রায় দুই বছর আগেই তারা বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে।
বয়ঃসন্ধিকালের খাদ্যাভ্যাসও পাল্টাচ্ছে কোরিয়ানদের মধ্যে। আমেরিকা ও ইউরোপের ধাঁচে খাবারের অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় কিশোর-কিশেরীদের গড় ওজন এবং উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সময়ের আগে ‘বড়’ হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের জীবনযাত্রায় ঘটছে আমূল পরিবর্তন। কৈশোরে পা দেওয়া বা সদ্য কৈশোর পেরোনো কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মদ্যপান, ধূমপান এবং যৌনতার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।
শুধুমাত্র উচ্চতাই নয়, স্বাস্থ্যের দিক থেকেও পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে। দক্ষিণ কোরিয়ার তরুণেরা শুধু লম্বা হচ্ছে না, ১০ বছরের মধ্যে উভয় লিঙ্গের বিএমআই বা বডি মাস ইনডেক্স বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। ছেলেদের গড় পরিসংখ্যান ২০.৭ থেকে ২১.৫ হয়েছে, যেখানে মেয়েদের ১৯.৮ থেকে বেড়ে ২০-তে পৌঁছেছে।
ন্যাশনাল হেল্থ ইনসিয়োর্যান্স সার্ভিসের গবেষণা বলছে, শুধু কিশোর-কিশোরী নয়, জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনের কারণে অকালে বুড়িয়ে যাচ্ছেন সেখানকার তরুণ-তরুণীরাও। ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সিদের মধ্যে ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, গাউট এবং আর্থ্রাইটিসের মতো রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তরুণ কোরীয়দের মধ্যে মাংস এবং রুটি এবং চিনি খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। প্রক্রিয়াজাত খাবার, শর্করা এবং পরিশোধিত শস্যজাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে স্ট্রেস হরমোন তৈরি হয়। এই খাবার চর্বি ও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
এ ছাড়়া আরও একটি গভীর সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে কিম জং উনের পড়শি দেশটি। দেশের যুব সমাজের স্বাস্থ্যের হঠাৎ করে বিশাল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের জন্ম না দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গড় জন্মহারে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে সে দেশে।
কয়েক দশক ধরে নবজাতকের সংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে যে সব দেশের, তাদের মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ কোরিয়া। বিশ্বব্যাপী উন্নত দেশগুলিতে জন্মের হার কমতে দেখা গিয়েছে। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো চরম সঙ্কটের মুখোমুখি নয় কোনও দেশই।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, দেশটির জন্মহার এতটাই নেমে গিয়েছে যে, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে শতাব্দীর শেষ নাগাদ দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা তার বর্তমানের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশে সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে।