অস্ত্র প্রতিযোগিতায় দুই ‘সুপার পাওয়ার’-এর কাঁটে কা টক্কর! তার মধ্যেই অত্যাধুনিক ‘আকাশ থেকে আকাশ’ (পড়ুন এয়ার টু এয়ার) হাইপারসনিক (পড়ুন শব্দের পাঁচগুণের চেয়ে বেশি গতিশীল) ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে ফের পেশি ফোলাল ড্রাগন। তাদের এ-হেন সাফল্যে ঘুম উড়েছে যুযুধান আমেরিকার। তবে কি এ বার সর্বাধিক শক্তিশালী বিমানবাহিনীর তকমা হারাবে যুক্তরাষ্ট্র? আকাশ-যুদ্ধে চৈনিক চ্যালেঞ্জ সামলাতে হিমসিম খাবে ওয়াশিংটন? বেজিঙের মারণাস্ত্রের খবর প্রকাশ্যে আসতেই দুনিয়া জুড়ে পড়ে গিয়েছে শোরগোল।
চলতি বছরের জুলাইয়ে ‘আকাশ থেকে আকাশ’ (পড়ুন এয়ার টু এয়ার) হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে বিস্ফোরক দাবি করে চিন। বেজিং জানিয়েছে, এই শ্রেণির হাজার কিলোমিটার পাল্লার মারণাস্ত্র হাতে পেয়েছে তাদের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ বায়ুসেনা। ড্রাগনের এই দাবি সত্যি হলে মাঝ-আকাশের ডগফাইট থেকে শুরু করে দৃশ্যমানতার বাইরের (বিয়ন্ড ভিস্যুয়াল রেঞ্জ) আকাশযুদ্ধে তারা যে কয়েকশো যোজন এগিয়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
আধুনিক যুদ্ধে বিমানবাহিনীর গুরুত্ব অপরিসীম। যে আগে শত্রুর আকাশ দখল করতে পারবে, লড়াইয়ে জয়ের সম্ভাবনা বেশি থাকবে তার। আর তাই সংঘাতের সময়ে সেখানে প্রাধান্য পেতে দু’পক্ষের যোদ্ধা পাইলটেরা প্রায়ই জড়িয়ে পড়েন ডগফাইটে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এই লড়াইয়ে ‘গেম চেঞ্জার’ হতে পারে চিনের এয়ার টু এয়ার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। কারণ, হাতিয়ারটির পাল্লা হাজার কিলোমিটার হওয়ায় নিজের আকাশসীমার মধ্যে থেকেই শত্রুপক্ষকে নিশানা করতে পারবে পিএলএ বিমানবাহিনী।
বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে আগামী দিনে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি সংঘাতে জড়াবে চিন ও আমেরিকা। আসন্ন সেই যুদ্ধকে মাথায় রেখে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে দু’পক্ষ। সেই জায়গায় হাজার কিলোমিটার পাল্লার ‘আকাশ থেকে আকাশ’ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে বেজিং ওয়াশিংটনের থেকে কিছুটা এগিয়ে গেল তা বলাই যায়। সংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্র দিয়ে নিজেদের আকাশসীমায় থেকেই তাইওয়ান এবং জাপান পর্যন্ত শত্রুর যুদ্ধবিমানকে নিশানা করতে পারবে ড্রাগন।
বিশ্বের শক্তিশালী ‘আকাশ থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলির তালিকায় নাম রয়েছে ফ্রান্সের ‘মেটিওর’-এর। শব্দের চার গুণ গতিতে ছুটতে পারে ১৯০ কেজি ওজনের ৩.৬৫ মিটার লম্বা ওই মারণাস্ত্র। চিনের তৈরি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা ফরাসি ‘উল্কা’র প্রায় পাঁচ গুণ বলে জানা গিয়েছে। মার্কিন নৌসেনার হাতে থাকা এয়ার টু এয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের নাম ‘এআইএম-১৭৪বি’, পাল্লা ৪০০ কিলোমিটার। সমপাল্লার এই শ্রেণির একটি রুশ ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে। মস্কোর বাহিনীতে সেটি ‘আর-৩৭এম’ হিসাবে পরিচিত।
বর্তমানে চিনা বিমানবাহিনী যে দূরপাল্লার ‘আকাশ থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে তার নাম ‘পিএল-১৭’। এর পাল্লা ৪০০ কিলোমিটার। সূত্রের খবর, আগামী দিনে তার জায়গা নেবে বহরে নতুন শামিল হওয়া সংশ্লিষ্ট হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। এতে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার শক্তির ভরকেন্দ্র পুরোপুরি বেজিঙের দিকে ঘুরে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সাবেক মার্কিন সেনাকর্তারা।
গত ছ’দশকে আকাশের লড়াইয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে ‘আকাশ থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্রে এসেছে বড় বদল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ক্যালিফোর্নিয়ার ইনয়োকার্নে (বর্তমানে যা নৌবাহিনীর হাতিয়ার স্টেশন হিসাবে পরিচিত) এই অস্ত্র তৈরির কাজে কোমর বেঁধে লেগে পড়েন মার্কিন প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ১৯৫০-এর দশকের প্রথমার্ধে এতে সাফল্য পান তাঁরা।
১৯৫৬ সালে দুনিয়ার প্রথম দেশ হিসাবে ‘আকাশ থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয় আমেরিকা। হাতিয়ারের নাম ছিল ‘এয়ার ইন্টারসেপ্টর মিসাইল-৯’ বা এআইএম-৯। এতে ইনফ্রারেড প্রযুক্তি ব্যবহার করেন মার্কিন প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। নৌবাহিনীর লড়াকু জেট থেকে হামলার জন্য এর নকশা করেছিলেন তাঁরা।
প্রথম দিকের ‘এআইএম-৯’গুলি পরিচালিত হত ফায়ার অ্যান্ড ফরগেট মোডে। অর্থাৎ, শত্রুকে লক্ষ্য করে এক বার তা ছোড়া হয়ে গেলে আর নিশানা বদল করার কোনও প্রযুক্তি ছিল না তাতে। পরবর্তী কালে এতে সেই সুবিধা যোগ করা হয়। কিন্তু তার পরেও এতে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। আর্দ্র পরিবেশ বা বৃষ্টির মধ্যে এটি একেবারেই ভাল কাজ করত না।
১৯৫৭ সালে ‘আকাশ থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। মস্কোর হাতিয়ার আবার রেডারকে ফাঁকি দিয়ে হামলা করতে পারত না। ফলে লড়াকু জেটের পাইলটকে ডগ ফাইটের সময় খুব বুদ্ধি করে এটি ব্যবহার করতে হত। ঠিক এই সময়েই আকাশ থেকে আকাশের ক্ষেপণাস্ত্র হাতে পায় চৈনিক বিমানবাহিনীও।
১৯৫৮ সালে দ্বিতীয় তাইওয়ান প্রণালী সঙ্কটের সময়ে পিএলএ বায়ুসেনার সঙ্গে মাঝ-আকাশে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়ায় তাইপের বায়ুবীরেরা। ওই সময়ে বেজিঙের একাধিক আকাশ থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রকে গুলি করে নামাতে সক্ষম হয় তারা। শুধু তা-ই নয়, ওই সংঘাতে ধ্বংস হয় একটি চৈনিক মিগ যুদ্ধবিমান। তার পরই রণে ভঙ্গ দিয়ে পিছু হটে ড্রাগন।
১৯৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধে নিজের জাত চিনিয়েছিল ‘আকাশ থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র। এ দেশের বিমানবাহিনীতে তত দিনে চলে এসেছে মিগ-২১ লড়াকু জেট। আর ইসলামাবাদের আকাশযোদ্ধাদের বহরে ছিল এফ-৮৬ সাবের। মাঝ-আকাশের লড়াইয়ে রুশ ‘কে-১৩’ ক্ষেপণাস্ত্রের উপরে ভরসা করতে হয়েছিল নয়াদিল্লিকে। অন্য দিকে, পাক বায়ুসেনা ‘এআইএম-৯বি সাইডউইন্ডার’ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করছিল। ফলে তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি যুদ্ধবিমান হারায় ভারতীয় বিমানবাহিনী।
’৬৫-র যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী সময়ে ‘আকাশ থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা বাড়াতে মরিয়া হয়ে ওঠে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। ফলে এতে যুক্ত হয় বিয়ন্ড ভিস্যুয়াল রেঞ্জ প্রযুক্তি। বর্তমানে এই শ্রেণির প্রায় প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েই দৃষ্টির বাইরে হামলা চালাতে পারেন যোদ্ধা পাইলট। এর সাম্প্রতিকতম নমুনা দেখা গিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে।
গত বছরের জুলাইয়ে ‘আর-৩৭’ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে মাঝ-আকাশে ইউক্রেনের একটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে রুশ বায়ুসেনা। এসইউ-৩৫ লড়াকু জেট থেকে হাতিয়ারটিকে ছোড়া হয়েছিল। প্রায় ২১৩ কিলোমিটার উড়ে গিয়ে কিভের যুদ্ধবিমানটিকে উড়িয়ে দেয় সেটি। এর আগে এতটা লম্বা রাস্তা পাড়ি দিয়ে কোনও ‘আকাশ থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্রকে যুদ্ধের ময়দানে শত্রু সংহার করতে দেখা যায়নি।
চলতি বছরের গোড়ায় ৮০০ থেকে হাজার কিলোমিটার পাল্লার ‘আকাশ থেকে আকাশ’ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষার কথা প্রকাশ্যে আনেন চিনা প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির একটি নমুনা তৈরি করেন তাঁরা। আগামী দিনে ষষ্ঠ প্রজন্মের লড়াকু জেটে এটি ব্যবহৃত হবে বলে জানা গিয়েছে। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে কোনও বিবৃতি দেয়নি বেজিঙের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
চিনের এই ক্ষেপণাস্ত্রটিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে সতর্ক করেছেন সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ। তাঁদের যুক্তি, অস্বাভাবিক গতির কারণে একে ঠেকানো বেশ কঠিন। মূলত মার্কিন লড়াকু জেট এফ-২২ র্যাফটার, এফ-৩৫ লাইটনিং টু এবং বোমারু বিমান বি-২ স্পিরিট এবং বি-২১ রাইডারের কথা মাথায় রেখে এর নকশা তৈরি করেছেন বেজিঙের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা।
তবে চিনা হাতিয়ারের দক্ষতা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে। কারণ, ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের ‘যুদ্ধে’ বেজিঙের তৈরি আকাশ থেকে আকাশ পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রটি ব্যবহার করেছিল পাক বায়ুসেনা। কিন্তু কোনও রকমের বিস্ফোরণ না ঘটিয়ে পঞ্জাবের সীমান্তবর্তী হোশিয়ারপুরে একটি খেতের মধ্যে গিয়ে পড়ে সেটি। পরে এলাকাবাসীরাই সেটিকে উদ্ধার করে তুলে দেন সেনাবাহিনীর হাতে।
বর্তমানে ভারতীয় বায়ুসেনার বহরে রয়েছে ফরাসি সংস্থা দাসোঁ অ্যাভিয়েশনের তৈরি রাফাল লড়াকু জেট এবং মেটিওর এয়ার টু এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র। সূত্রের খবর, উল্কাসদৃশ হাতিয়ারটি ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ ব্যবহার করছে নয়াদিল্লি। এ ছাড়া এই শ্রেণির অস্ত্র নামের আর একটি ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে এ দেশের বিমানবাহিনীর হাতে, যার নির্মাণকারী সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন)।