‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের ‘যুদ্ধে’ আড়ালে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানকে ক্রমাগত সাহায্য করে গিয়েছে চিন? সংঘাত বন্ধ হওয়ার পর এই প্রশ্নেই সরগরম দুনিয়া। সূত্রের খবর, সীমান্তে ভারতীয় সেনার গতিবিধির উপর নজর রাখতে একাধিক ‘গুপ্তচর’ উপগ্রহকে কাজে লাগায় বেজিং। সেখান থেকে পাওয়া তথ্য সরাসরি রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতরে পাঠাচ্ছিল ড্রাগন সরকার। যদিও তাতে শেষরক্ষা হয়নি।
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সংঘাত তীব্র হতেই সীমান্তে ভারতীয় সেনার গতিবিধির উপর নজরদারি শুরু করে চিনা ‘গুপ্তচর’ উপগ্রহ। বিষয়টি প্রথম বার নজরে আসে ওপেন-সোর্স ইনটেলিজেন্স বা ওএসআইএনটির গোয়েন্দাদের। তাঁদের দাবি, গত কয়েক দিনে বহু বার রাজস্থানের আন্তর্জাতিক সীমান্তের উপর বেজিঙের ‘গুপ্তচর’ উপগ্রহকে পাক খেতে দেখা গিয়েছে। এই ঘটনাকে কাকতালীয় বলতে নারাজ তাঁরা।
ওএসআইএনটির গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে মরু রাজ্যে পাক ফৌজ ‘সোয়ার্ম’ ড্রোন দিয়ে হামলা চালানোর সময়েই ওই এলাকার উপর নজরদারি চালায় ড্রাগনের ‘গুপ্তচর’ উপগ্রহ। সেই কারণেই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। বিশ্বের তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বেজিঙের সাহায্য নিয়ে ওই হামলা পরিচালনা করছিলেন রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারেরা। তবে ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) দুর্দান্ত কাজ করায় সেগুলিকে শূন্যেই ধ্বংস করতে সক্ষম হয় ভারতীয় সেনা।
বর্তমানে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএর কাছে রয়েছে গোয়েন্দা তথ্য, নজরদারি এবং অনুসন্ধানমূলক কাজে পটু একগুচ্ছ কৃত্রিম উপগ্রহ। সূত্রের খবর, ভারত-পাক যুদ্ধে ইসলামাবাদের সুবিধা করে দিতে সেগুলির বড় অংশকে কাজে লাগায় বেজিং। বিশ্লেষকদের দাবি, ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধকৌশল, ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ ব্যবহারের পদ্ধতি এবং ক্ষেপণাস্ত্র কমান্ডের তথ্য সংগ্রহই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, সংঘাত চলাকালীন চিনকে বাদ দিলে আরও দু’টি কৃত্রিম উপগ্রহের তথ্য হাতে পাচ্ছিলেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। সেগুলি হল, ‘পাকিস্তান রিমোট সেন্সিং স্যাটেলাইট-১’ (পিআরএসএস-১) এবং পাকস্যাট-এমএম১। এগুলির নিয়ন্ত্রণও রয়েছে বেজিঙের হাতে। সূত্রের খবর, ভারতের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’কে ধ্বংস করতে ভবিষ্যতে এই ধরনের উপগ্রহগুলিকে আরও উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ড্রাগন সরকার।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই ‘যুদ্ধে’ হার থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে গোয়েন্দা তথ্য, নজরদারি এবং অনুসন্ধানমূলক কৃত্রিম উপগ্রহের সংখ্যা বৃদ্ধির দিকে নজর দেবে ইসলামাবাদ। আর এ ব্যাপারে তাদের একমাত্র ভরসা চিন। নয়াদিল্লিকে পশ্চিম সীমান্তে ব্যস্ত রাখতে ইতিমধ্যেই পাক ফৌজকে উপগ্রহভিত্তিক যুদ্ধের প্রশিক্ষণ বেজিং দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও তা পুরোপুরি অস্বীকার করেছে সংশ্লিষ্ট দুই দেশ।
অন্য দিকে, পহেলগাঁও কাণ্ডের তদন্তে চিনা যোগ খুঁজে পেয়েছেন নয়াদিল্লি। গোয়েন্দা সূত্রকে উদ্ধৃত করে সিএনএন-নিউজ় ১৮ জানিয়েছে, বেজিঙের বেইদু গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত একটি নিষিদ্ধ হুয়াওয়ে স্যাটফোন ব্যবহার করেছে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা। ভারতীয় সেনার রেডার গ্যাজেটটির উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছে। যদিও বৈসরন উপত্যকায় জঙ্গি হামলার পর সংশ্লিষ্ট স্যাট ফোনটিকে খুঁজে পাননি জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি বা এনআইএ) গোয়েন্দারা।
সূত্রের খবর, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে ভারতে নিষিদ্ধ চিনা অ্যাপগুলি ব্যবহার করেছিল পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা। ২০২০ সালে গালওয়ান উপত্যকায় পিএলএর সঙ্গে সংঘাতের সময় সংশ্লিষ্ট অ্যাপগুলিকে নিষিদ্ধ করে নয়াদিল্লি। এই অ্যাপগুলিতে তথ্য গোপনের পন্থা (এনক্রিপশন) অনেক শক্তিশালী এবং আধুনিক। এগুলিকে হ্যাক করা একরকম দুঃসাধ্য।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এ ব্যাপারে পাকিস্তানকে সাহায্য করার নেপথ্যে চিনের নিজস্ব স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। বেজিঙের আশঙ্কা, অরুণাচল প্রদেশ বা লাদাখের সীমান্ত সংঘাতকে কেন্দ্র করে যে কোনও দিন ভারতের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ের ময়দানে নামতে হবে তাঁদের। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে ‘যুদ্ধে’ ব্যবহার হওয়া নয়াদিল্লির মারণাস্ত্র এবং আক্রমণ পদ্ধতি বুঝে নিতে ‘গুপ্তচর’ উপগ্রহগুলিকে কাজে লাগায় তারা।
পাশাপাশি, এই লড়াইয়ে ইসলামাবাদকে বিক্রি করা অস্ত্রগুলির শক্তি পরীক্ষার উপরেও কড়া নজর রেখেছিল বেজিং। সেখানে অবশ্য চিনা হাতিয়ার ‘ডাহা ফেল’ করায় পাক ফৌজের সঙ্গে মুখ পুড়েছে ড্রাগনের। ফলে সংশ্লিষ্ট অস্ত্রগুলির ফাঁকফোকর বুঝে নিতে ভবিষ্যতে এই উপগ্রহচিত্রগুলিকে যে তারা কাজে লাগাবেন, তা বলাই বাহুল্য। চিনের বিক্রি করা অস্ত্রের ৬০ শতাংশই রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা কিনেছেন বলে জানা গিয়েছে।
সংঘাত চলাকালীন ড্রোন হামলা চালিয়ে পাক পঞ্জাব প্রদেশের লাহৌরের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’কে উড়িয়ে দেয় ভারতীয় সেনা। সেখানে মোতায়েন ছিল চিনের তৈরি ‘এইচকিউ-৯পি’ নামের একটি এয়ার ডিফেন্স। এ ছাড়া বেজিং থেকে কেনা জেএফ-১৭ নামের দু’টি লড়াকু জেটকে ধ্বংস করে নয়াদিল্লি। সে কথা অবশ্য স্বীকার করে নিয়েছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারেরা।
আর তাই ‘যুদ্ধে’র মধ্যে ‘গুপ্তচর’ উপগ্রহের তথ্য দিয়ে সাহায্য করার পাশাপাশি পাকিস্তানের হয়ে ভুয়ো খবর ছড়াতে কোমর বেঁধে লেগেছিল চিনের যাবতীয় সংবাদ সংস্থা। প্রথমেই ভারতীয় বিমানবাহিনীর রাফাল লড়াকু জেটকে ইসলামাবাদ ধ্বংস করেছে বলে খবর প্রকাশ করে তারা। এ ব্যাপারে এগিয়ে ছিল বেজিঙের সরকারি সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইমস’। তবে অচিরেই ড্রাগনের এই ফন্দি ধরে ফেলে নয়াদিল্লি।
এর পর ‘গ্লোবাল টাইমস’কে সঠিক তথ্য দিতে ‘ফ্যাক্ট চেক’ পাঠায় কেন্দ্রের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো বা পিআইবি। বাধ্য হয়ে ভুল খবর প্রকাশ করার কথা স্বীকার করে নেয় চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যম। রাফালকে ধ্বংস করতে বেজিঙের জে-১০সি লড়াকু জেট ব্যবহার হয়েছে বলে দাবি করেন পাক বিদেশমন্ত্রী ইশাক দার। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ঢোঁক গিলে পত্রপাঠ তাঁর বক্তব্য খারিজ করে দেয় ড্রাগন প্রশাসন।
তবে এত কিছুর পরেও বেজিং ও ইসলামাবাদের সম্পর্কে যে চিড় ধরেছে এমনটা নয়। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সংঘর্ষবিরতির পর পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে কথা বলেন চিনা বিদেশ মন্ত্রকের একাধিক প্রতিনিধি। ড্রাগনকে এ ভাবে পাশে পেয়ে কাশ্মীর ইস্যুতে নতুন করে সুর চড়াতে দেরি করেনি ইসলামাবাদ। এ ব্যাপারে শরিফ বলেছেন, ‘‘আমরা যুদ্ধের জন্যও তৈরি, আবার শান্তির জন্যেও প্রস্তুত। ভারতকে যে কোনও একটা বেছে নিতে হবে।’’
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় পর্যটক-সহ মোট ২৬ জনকে নৃশংস ভাবে গুলি চালিয়ে খুন করে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা। ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ৭ মে মধ্যরাতে পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরের (পাক অকুপায়েড কাশ্মীর বা পিওকে) মোট ন’টি সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় ভারতীয় ফৌজ। অভিযানটির পোশাকি নাম রাখা হয় ‘অপারেশন সিঁদুর’। এর পরই দুই দেশের মধ্যে সংঘাত তীব্র হয়।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর ভারতের একাধিক বায়ুসেনা ঘাঁটিকে নিশানা করে হামলা চালায় ইসলামাবাদ। ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র মাধ্যমে সেগুলিকে ঠেকিয়ে পাল্টা প্রত্যাঘাত শানায় ভারতীয় বিমানবাহিনী। আর তাতেই একরকম গুঁড়িয়ে যায় পাকিস্তানের ১১টি বায়ুসেনা ঘাঁটি। ফলে বাধ্য হয়ে যুদ্ধবিরতির জন্য নয়াদিল্লির কাছে আবেদন করেন পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারল অফ মিলিটারি অপারেশন্স (ডিজিএমও)।
গত ১০ মে বিকেলে আনুষ্ঠানিক ভাবে সংঘর্ষবিরতির কথা ঘোষণা করে দুই দেশ। এতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করার কথা জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর দাবি, বাণিজ্য বন্ধ করার হুমকি দিতেই সংযত হয় দুই দেশ। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এই দাবিকে খারিজ করে দিয়েছে নয়াদিল্লি।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এ বারের ভারত-পাক ‘যুদ্ধে’ সরাসরি নাক গলিয়েছে চিন। এ ছাড়াও তুরস্ককে পাশে পেয়েছে ইসলামাবাদ। বেজিং ভবিষ্যতে পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নতুন শক্তিজোট তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে বলে মনে করেন তাঁরা। সে ক্ষেত্রে ‘নিঃসঙ্গ’ ভারতের পাশে কোন কোন দেশ দাঁড়ায়, সেটাই এখন দেখার।