সাত বছর পর ফের চিন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ড্রাগনভূমির বন্দর শহর তিয়ানজ়িনে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিওর (সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন) বৈঠকে যোগ দেবেন তিনি। সূত্রের খবর, তাঁকে মেগা অভ্যর্থনা জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বেজিং। মার্কিন শুল্কযুদ্ধের আবহে একে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বৈঠকে যোগ দেবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও।
ড্রাগনভূমির গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসসিওর বৈঠকে মধ্য, পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মিলিয়ে মোট ২০ জনের বেশি রাষ্ট্রপ্রধানের পা পড়ার কথা রয়েছে। তাঁদের মধ্যে মাত্র দু’জনকে ব্যক্তিগত ভাবে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাবেন স্বয়ং চিনা কমিউনিস্ট পার্টি বা সিসিপির চেয়ারম্যান তথা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তাঁরা হলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক স্তরে এর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন ‘চায়না-গ্লোবাল সাউথ প্রজেক্ট’ নামের গবেষণা সংস্থার মুখ্য সম্পাদক এরি ওল্যান্ডার। তাঁর কথায়, ‘‘এ বারের এসসিও সম্মেলনকে মার্কিন-বিরোধী শক্তিশালী জোট হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করবেন শি। সেই লক্ষ্যে রাশিয়া, ভারত এবং ইরানকে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে তাঁর প্রশাসন। এটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।’’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, এ বারের এসসিও বৈঠকে ‘রুশ ভারত চিন ত্রিশক্তি’ বা রিক ট্রয়িকার (রাশিয়া-ইন্ডিয়া-চায়না ট্রয়িকা) পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি, মোদী ও শি-র মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠককে কেন্দ্র করেও পারদ চড়তে শুরু করেছে। সীমান্ত সংঘাত মেটাতে দু’তরফে একাধিক সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা।
ওল্যান্ডার জানিয়েছেন, সীমান্তে সৈন্য প্রত্যাহার, বাণিজ্য এবং ভিসা নীতিকে শিথিল করার ব্যাপারে বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন মোদী ও জিনপিং। এ ব্যাপারে মূল মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে মস্কো, যার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দিয়েছেন নয়াদিল্লির রুশ দূতাবাসের কর্তাব্যক্তিরা। তাঁদের কথায়, ‘‘চিন ও ভারতের সঙ্গে খুব দ্রুত ত্রিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করব আমরা।’’
বিশেষজ্ঞদের দাবি, যে ভাবে মার্কিন শুল্কনীতির বিরুদ্ধে মোদী রুখে দাঁড়িয়েছেন, তাতে সীমান্ত সংঘাত মেটাতে দর কষাকষির ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছেন তিনি। কারণ, ইতিমধ্যেই তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছে জার্মানি ও ফ্রান্স। শুধু তা-ই নয়, এই বছরই ভারতের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি করতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ)। এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লিকে দলে টানতে হলে সীমান্তে সমঝোতা করা ছাড়া বেজিঙের কাছে দ্বিতীয় রাস্তা খোলা নেই।
এসসিওর সম্মেলন চলাকালীন মোদী-শি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক নিয়ে জল্পনা বাড়লেও এর দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য নিয়ে অবশ্য যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অতীতেও বহু বার উল্লেখ্যযোগ্য সহযোগিতার প্রশ্নে ব্যর্থ হয়েছে এই গোষ্ঠী। ভারতের ক্ষেত্রেও কাঁটা দু’জায়গায়। প্রথমত, এসসিওর অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র হল পাকিস্তান। দ্বিতীয়ত, ইরান-ইজ়রায়েলের সংঘাতপূর্ণ সম্পর্ক।
এ বারের এসসিওর বৈঠকে যোগ দিয়ে প্রেসিডেন্ট জিনপিঙের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। সেখানে ‘চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’ বা সিপিইসির (চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর) দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের ঘোষণা করতে পারে বেজিং। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিতে ‘পাকিস্তান অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর’ বা পিওজেকের (পাকিস্তান অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর) মধ্যে দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে। এই নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে নয়াদিল্লির।
দ্বিতীয়ত, লাদাখে ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ বা এলওসি (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) বরাবর নতুন রেল প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চলেছে চিন। ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর মাধ্যমে জ়িনজ়িয়াংয়ের হোতানের সঙ্গে তিব্বতের লাসাকে জুড়তে চাইছে বেজিং। প্রস্তাবিত রেললাইনটির আকসাই চিনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে, যা ১৯৬২ সালের যুদ্ধে দখল করে ড্রাগনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, কৌশলগত কারণে এই রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ করতে চাইছে চিন। এর ফলে ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’য় দ্রুত সেনা মোতায়েন করা যে বেজিঙের পক্ষে অনেকটাই সহজ হবে, তা বলাই বাহুল্য। বিষয়টির উপরে কড়া নজর রেখেছে নয়াদিল্লি। মোদী-শির বৈঠকে এই ইস্যুতে আলোচনা হলে মান্দারিনভাষী প্রেসিডেন্টের কাছে সেটা যে খুবই অস্বস্তির হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গত জুনে এসসিও-ভুক্ত দেশগুলির প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকে যৌথ বিবৃতি গ্রহণে তীব্র আপত্তি জানায় ভারত। কারণ, সেখানে এ বছরের ২২ এপ্রিলের জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় পর্যটক-সহ ২৬ জনের মৃত্যুর কোনও উল্লেখ ছিল না। সামরিক ও আর্থিক দিক থেকে বেজিং এবং ইসলামাবাদের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। নয়াদিল্লির কাছে সেটা যথেষ্ট চিন্তার।
জুনের শুরুতে এসসিওর সদস্যরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় ইজ়রায়েল। পারস্য উপসাগরের কোলের দেশটির রাজধানী তেহরানকে নিশানা করে ইহুদি বায়ুসেনা। পাল্টা তেল আভিভ ও হাইফা-সহ ইজ়রায়েলের একাধিক শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় শিয়া ফৌজ। এই সংঘাতের তীব্র নিন্দা করলেও এসসিওর যৌথ বিবৃতি থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিল ভারত।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদী ক্ষমতায় আসার পর ইজ়রায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে ভারত। কৃষি, প্রযুক্তি এবং সমরাস্ত্রের ক্ষেত্রে এ দেশে ইহুদিদের ব্যাপক লগ্নি রয়েছে। অন্য দিকে, ইজ়রায়েলের হাইফার মতো বন্দর বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ করছেন ধনকুবের শিল্পপতি গৌতম আদানি। এ ছাড়া প্রস্তাবিত ‘ভারত-মধ্য প্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক বারান্দা’ বা আইম্যাকের (ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ-ইকোনমিক করিডোর) ইহুদিভূমির উপর দিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে।
এ ছাড়াও মোদীর চিন সফরের মুখে আরও দু’টি বিষয়ের উপরে কড়া নজর রাখছে বিশ্ব। সূত্রের খবর, বর্তমানে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে রাশিয়ার উপর থেকে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে পারেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বর্তমানে মস্কোর উপরে রয়েছে ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করতেই এ সব চাপিয়ে দেয় আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্ব।
পাশাপাশি, গত ২৫ অগস্ট চিনা পণ্যে ২০০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসে বসে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তিনি বলেন, ‘‘ওদের (বেজিঙের) হাতে কিছু তাস রয়েছে। আমাদের কাছেও অসাধারণ কিছু তাস আছে। কিন্তু আমি সেই তাসগুলি খেলতে চাই না। যদি আমি সেই তাসগুলি খেলি, তা হলে চিন ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি ওই তাসগুলি খেলব না।’’
বর্তমানে, বিরল খনিজ এবং তা দিয়ে তৈরি চুম্বকের উপরে বিশ্বে একাধিপত্য রয়েছে চিনের। যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা, এসসিওর বৈঠকের পর ওয়াশিংটনকে এর রফতানি বন্ধ করতে পারে বেজিং। আর তাই আগেভাগে হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রেসিডেন্ট শি-র উপরে চাপ তৈরির চেষ্টা করেছেন ট্রাম্প। তাঁর কথায়, ‘‘বেজিংকে চুম্বক দিতেই হবে। নইলে আমরা ওদের ধ্বংস করে দেব।’’
মার্কিন সামরিক ক্ষেত্রে বিরল খনিজের প্রবল চাহিদা রয়েছে। লড়াকু জেট, ডুবোজাহাজ এবং রণতরী তৈরিতে এর বহুল ব্যবহার করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিরক্ষা সংস্থা। অন্য দিকে, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষকে ‘মোদীর যুদ্ধ’ বলে উল্লেখ করেছেন ট্রাম্পের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো। এতে দু’দেশের সম্পর্ক আরও জটিল হল বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
বেঙ্গালুরুর ‘তক্ষশীলা ইনস্টিটিউট’-এর ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় গবেষণা প্রকল্পের (ইন্দো-প্যাসেফিক রিসার্চ প্রজেক্ট) চেয়ারপার্সন মনোজ কেওয়ালরামানি বলেছেন, ‘‘এসসিওর অনেক কিছুই অস্পষ্ট। কিছু ক্ষেত্রে চিনের অর্থনীতি বেশি পরিমাণে আমেরিকার উপরে নির্ভরশীল। ভারতের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে শীতলতা এলেও ইউরোপের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। ফ্রান্স, জার্মানি বা ইটালির বাজার পাওয়া বেজিঙের পক্ষে কঠিন। সব মিলিয়ে সমঝোতায় অনেক কিছুই আদায় করার সুযোগ পাবেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।’’
গত ২৭ অগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ করে শুল্ক নেওয়া শুরু করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। নতুন করে আর কোনও কর চাপানোর কথা অবশ্য বলেননি তিনি। এই পরিস্থিতিতে খুব দ্রুত দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা কাটবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন ট্রেজ়ারি সচিব স্কট ব্যাসেন্ট।
গত বছর রাশিয়ার কাজ়ানে ‘ব্রিকস’ সম্মেলনে পুতিন ও জিনপিঙের সঙ্গে এক মঞ্চে ছিলেন মোদী। ওই সময় থেকে চিনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও করেন তিনি। প্রায় ১০ মাস পর ফের সেই ছবি প্রত্যক্ষ করবে বিশ্ব। কাজ়ানের বৈঠকের পরও ‘ব্রিকস’ মুদ্রা চালু করার ব্যাপারে সহমত হয়নি ভারত। এ বারের এসসিও থেকে ‘লাভের গুড়’ কতটা নয়াদিল্লি ঘরে তুলতে পারে, সেটাই এখন দেখার।