African Civil War

রক্তে ভিজছে হ্রদ এলাকার মাটি, চারদিকে লাশের স্তূপ! গৃহযুদ্ধ-গণহত্যায় ক্ষতবিক্ষত ‘অন্ধকার মহাদেশ’

আফ্রিকার বিরাট হ্রদ এলাকাকে কেন্দ্র করে বছরের পর বছর ধরে চলছে গৃহযুদ্ধ আর জাতি সংঘর্ষ। কেন লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ‘অন্ধকার মহাদেশ’?

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:১৪
Share:
০১ ২১

কখনও গৃহযুদ্ধ। কখনও আবার জাতিগত সংঘাত। নানা অশান্তিতে ক্ষতবিক্ষত ‘অন্ধকার মহাদেশ’। এই সুযোগে হায়নার মতো সুবিশাল ভূখণ্ডটিকে ঘিরে ধরেছে দুনিয়ার তাবড় ‘সুপার পাওয়ার’। কারও নজর সেখানকার খনিজের উপর, কেউ আবার কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা কব্জা করার নেশায় বুঁদ। ফলে যত সময় গড়াচ্ছে ততই বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে এই মহাদেশ।

০২ ২১

পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার সুবিশাল গ্রেট লেক্‌স অঞ্চল। এই এলাকাটিকেই ‘অন্ধকার মহাদেশ’টির অশান্তির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে চিহ্নিত করেছেন দুনিয়ার তাবড় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, রিফ্‌ট উপত্যকা সংলগ্ন গ্রেট লেক্‌স অঞ্চলটি প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। সেখানকার অনন্য বাস্তুতন্ত্র দক্ষিণ গোলার্ধের মহাদেশটির আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উপর বিরাট প্রভাব ফেলেছে।

Advertisement
০৩ ২১

গ্রেট লেক্‌স অঞ্চলটিকে অনেকেই আফ্রিকার ‘হৃৎপিণ্ড’ বলেন। এর অবস্থান ‘অন্ধকার মহাদেশ’-এর প্রায় কেন্দ্রস্থলে। সেখানে রয়েছে মিষ্টি জলের একাধিক হ্রদ। এর মধ্যে সর্ববৃহৎটির নাম ভিক্টোরিয়া। ৫৯ হাজার ৯৪৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে এটি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে টাঙ্গানিকা হ্রদ। ৩২ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এর বিস্তার।

০৪ ২১

এ ছাড়াও রয়েছে মালাউই হ্রদ (২৯,৬০০ বর্গ কিলোমিটার), আলবার্ট হ্রদ (৫,৫৯০ বর্গ কিলোমিটার), কিভু হ্রদ (২,৭০০ বর্গ কিলোমিটার) এবং এডওয়ার্ড হ্রদ (২,৩২৫ বর্গ কিলোমিটার)। আফ্রিকার মোট ১০টি দেশে ঘেরা সেখানকার গ্রেট লেক্‌স অঞ্চল। সেই তালিকায় আছে বুরুন্ডি, ডেমোক্র্যাটিক কঙ্গো রিপাবলিক (ডিসিআর), ইথিওপিয়া, কেনিয়া, মালাউই, মোজ়াম্বিক, রুয়ান্ডা, তানজ়ানিয়া, উগান্ডা এবং জ়াম্বিয়া। এই রাষ্ট্রগুলির প্রতিটিরই লম্বা সময় ধরে গৃহযুদ্ধ বা রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার অন্ধকার অতীত রয়েছে।

০৫ ২১

উদাহরণ হিসাবে রুয়ান্ডা ও ডেমোক্র্যাটিক কঙ্গো রিপাবলিক (ডিসিআর)-এর মধ্যে অবস্থিত কিভু হ্রদের কথা বলা যেতে পারে। এর গভীরে লুকিয়ে রয়েছে বহু মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে কিভুতে খনিজ তেলের হদিস মিলেছে বলে ঘোষণা করে রুয়ান্ডা প্রশাসন। এর পরই সেখানে বেড়েছে স্থানীয় বিদ্রোহীদের আনাগোনা।

০৬ ২১

আফ্রিকার এই অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার নিয়ে সরকার এবং সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে সংঘর্ষ। ২১ শতকে বহিরাগত শক্তির লাগাতার হস্তক্ষেপে আরও জটিল হয়েছে সেখানকার পরিস্থিতি। সম্পদের দখলকে কেন্দ্র করেই গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়েছে ‘অন্ধকার মহাদেশ’টির একের পর এক রাষ্ট্র।

০৭ ২১

বিশেষজ্ঞদের দাবি, সরকারের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ চাইছে আফ্রিকার সমস্ত বিদ্রোহী গোষ্ঠী। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি এবং ডেমোক্র্যাটিক কঙ্গো রিপাবলিক (ডিসিআর)-এ আবার রয়েছে শরণার্থী সমস্যা। গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে লাখো মানুষ এই তিন রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছেন। এতে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়েছে।

০৮ ২১

আফ্রিকার দ্বিতীয় সমস্যা হল এর দীর্ঘ ঔপনিবেশিক ইতিহাস। জার্মানি এবং বেলজিয়ামের একাধিক নীতি মহাদেশটির গায়ে তৈরি করেছে একের পর এক ক্ষতচিহ্ন। রুয়ান্ডা এবং বুরুন্ডির অর্থনৈতিক শোষণ, জাতিগত সংঘাত, নিম্ন মানের প্রশাসনিক কাঠামো এবং দুর্বল শাসন ব্যবস্থার নেপথ্যে ইউরোপের ওই দুই দেশের ‘হাতযশ’কেই দায়ী করে থাকেন বিশ্লেষকদের একাংশ।

০৯ ২১

আফ্রিকার জনজাতিগুলির মধ্যে শ্রেণিবিভাগের ক্ষেত্রে ‘হামিটিক তত্ত্ব’-এ বিশ্বাসী ছিল জার্মানি। সেই নিয়ম মেনে ‘টুটসি’কে উন্নত জাতিগোষ্ঠী হিসাবে দেগে দেয় ইউরোপের ওই দেশ। জার্মানরা মনে করতেন, তথাকথিত ‘বর্বর’দের সভ্য করতে ইথিওপিয়ার উচ্চ ভূমিখণ্ড থেকে গ্রেট লেক্‌স এলাকায় পা পড়েছিল ‘টুটসি’দের। এই ধারণার ফলে সেখানে বৃদ্ধি পায় জাতিবিদ্বেষ। একে অপরের চিরশত্রুতে পরিণত হয় ‘টুটসি’ ও ‘হুটু’রা।

১০ ২১

এ হেন জার্মান তত্ত্বের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে স্থলবেষ্টিত দেশ রুয়ান্ডার উপর। উপনিবেশ-পরবর্তী সময়ে ‘টুটসি’ ও ‘হুটু’দের মধ্যে জাতি সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে গ্রেট লেক্‌স অঞ্চলের এই রাষ্ট্র। ১৯৯৪ সালে সেখানে সংঘটিত হয় গণহত্যা।

১১ ২১

১৯৬২ সালে স্বাধীনতার সময়ে দেশের ক্ষমতা দখল করে ‘হুটু’রা। কুর্সিতে বসেই ‘টুটসি’দের সমূলে বিনাশ করার চেষ্টা করতে থাকে আফ্রিকার এই জনজাতি। ফলে বার বার গণহত্যার শিকার হন তাঁরা। প্রাণ বাঁচাতে ‘টুটসি’দের একটা বড় অংশ প্রতিবেশী উগান্ডা এবং তানজ়ানিয়ার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এই গোষ্ঠীর সাবেক রাজ এবং রাজপরিবারের সদস্যরাও। দীর্ঘ সময় তাঁদেরও শরণার্থী শিবিরে কাটাতে হয়েছিল।

১২ ২১

পরবর্তী কালে ‘রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট’ বা আরপিএফ নামের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জন্ম দেন ‘টুটসি’ শরণার্থীরা। মাতৃভূমিতে ফেরার জন্য ‘হুটু’ পরিচালিত সরকারের বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধই ঘোষণা করেন তাঁরা। বিদ্রোহীদের ঠেকাতে শাসক ‘হুটু’দের একাংশ তৈরি করেন একটি আধা সামরিক সংগঠন, স্থানীয় ভাষার যার নাম ‘ইন্টারাহামওয়ে’। কথাটির অর্থ হল একসঙ্গে আক্রমণকারীদের একটি দল।

১৩ ২১

১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডা গণহত্যার নেপথ্যে ছিল কুখ্যাত ‘ইন্টারাহামওয়ে’র হাত। মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে ‘টুটসি’ ও তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল ‘হুটু’ উপজাতিদের আট লক্ষ নিরীহ মানুষকে খুন করেন তাঁরা। আরপিএফ ক্ষমতা দখলের পর বন্ধ হয় সেই রক্তের হোলি খেলা। গত তিন দশক ধরে কঠোর হাতে রুয়ান্ডা শাসন করছে আরপিএফ।

১৪ ২১

বিদ্রোহী ‘টুটসি’রা ক্ষমতায় আসার পর রুয়ান্ডার অর্থনীতিতে এসেছে বড় বদল। আফ্রিকার দ্রুততম উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে গ্রেট লেক্‌স অঞ্চলের এই রাষ্ট্র। নিজেদের অবস্থা বদলের পর বার বার সংবিধান বদল করেছেন সেখানকার শাসকেরা। ২০০৯ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে কমনওয়েলথে যোগ দেয় রুয়ান্ডা। এর ফলে এটি ফ্রাঙ্কোফোন থেকে রূপান্তরিত হয় একটি অ্যাংলোফোন দেশে।

১৫ ২১

রুয়ান্ডার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি স্থলবেষ্টিত ছোট দেশ হল বুরুন্ডি। ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর জাতিসঙ্ঘ (লিগ অফ নেশনস) দু’টি দেশের শাসনভার তুলে দেয় বেলজিয়ামের হাতে। ক্ষমতা পেয়ে টুটসি অভিজাতদের প্রশাসনিক উচ্চ পদে বসাতে শুরু করেন ব্রাসেলসের শীর্ষকর্তারা। ফলে আরও চওড়া হয় হুটু-টুটসি বিভাজন। অচিরেই দুই জনজাতির মধ্যে আর্থিক এবং সামাজিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে।

১৬ ২১

১৯৬২ সালে বেলজিয়ামের থেকে স্বাধীনতা পায় বুরুন্ডি। পরবর্তী চার বছর সেখানে ছিল ‘টুটসি’ রাজতন্ত্রের শাসন। ১৯৬৬ সালে সেনা অভ্যুত্থানের পর বুরুন্ডিতেও শুরু হয় জাতিসংঘর্ষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। ১৯৭২ সালে নির্বাসন থেকে দেশে ফিরেই খুন হন রাজা পঞ্চম এনতার। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম বার গণহত্যার ঘটনা ঘটে বুরুন্ডিতে।

১৭ ২১

রাজা পঞ্চম এনতারের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ‘হুটু’দের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠায় রীতিমতো খেপে ওঠে মিশেল মিকোম্বেরোর ‘টুটসি’ প্রভাবিত সরকার। ‘হুটু’ বিদ্রোহীদের দমন করেও শান্ত হননি তিনি। এই জনজাতির বহু নিরীহ নাগরিককে প্রকাশ্যে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বাহিনীর বিরুদ্ধে।

১৮ ২১

১৯৯৩ সালে ফের জাতি সংঘর্ষে রক্তাক্ত হয় বুরুন্ডির মাটি। সে বার গণহত্যার শিকার হয় স্কুলের শিশুরাও। ১৯৭৬ সালে কর্নেল জিন-ব্যাপটিস্ট বাগাজ়া এবং ১৯৮৭ সালে মেজর পিয়েরে বুয়োয়ার সেনা অভ্যুত্থানের ফলে শাসন কাঠামো আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯৯৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বুরুন্ডিতে চলেছে গৃহযুদ্ধ। ফলে আফ্রিকার এই দেশটি আর কখনওই সে ভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।

১৯ ২১

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেমোক্র্যাটিক কঙ্গো রিপাবলিক (ডিসিআর)-এর সর্ববৃহৎ শহর গোমা দখল করেন ‘এম২৩’ বিদ্রোহীরা। এর পর একতরফা ভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হলেও ওই সশস্ত্র গোষ্ঠীর যোদ্ধারা থেমে থাকেননি। ধীরে ধীরে তাঁরা দক্ষিণের শহর বুকাভুর দিকে এগোতে শুরু করেছেন। ফলে গ্রেট লেক্‌স অঞ্চলে নতুন করে সংঘর্ষ তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।

২০ ২১

এই অবস্থায় শান্তি ফেরাতে বিদ্রোহীদের আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানিয়েছেন পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকান ব্লকের রাষ্ট্রনেতারা। কিন্তু ‘এম২৩’ বিদ্রোহী গোষ্ঠী রুয়ান্ডার সমর্থন পাওয়ার কারণে এই চেষ্টা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

২১ ২১

আফ্রিকার গ্রেট লেক্‌স এলাকার বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করার পিছনে ছুটছে চিন, আমেরিকা, তুরস্ক এবং রাশিয়ার মতো বিশ্ব শক্তি। নিজেদের স্বার্থে কখনও বিদ্রোহী, কখনও আবার সরকারপক্ষকে সমর্থন জানাচ্ছে তারা। এই এলাকা অস্থির থাকলে ছলে বলে কৌশলে সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ কব্জা করা সহজ হবে, এত দিনে তা ভালই বুঝে গিয়েছে এই সমস্ত দেশ। ফলে ‘অন্ধকার মহাদেশ’-এর হ্রদ এলাকায় রক্তের হোলি খেলা খুব দ্রুত বন্ধ হওয়ার নয়, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement