বিদেশের মাটিতে জোড়া বিমানঘাঁটি। সোখান থেকে দিব্যি চিন, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের উপর কড়া নজরদারি চালানো যায়। মধ্য এশিয়ার এ-হেন কৌশলগত অবস্থান ছেড়ে চলে এসেছে ভারত? সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই দেশ জুড়ে পড়ে গিয়েছে তুমুল হইচই! বিষয়টিতে সরকারি ভাবে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী প্রশাসন কোনও বিবৃতি না দেওয়ায় ইতিমধ্যেই তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
আফগানিস্তান এবং চিন সীমান্ত লাগোয়া তাজিকিস্তান। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত যা ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) অন্তর্গত। এর পর কমিউনিস্ট জোট ভেঙে গেলে মধ্য এশিয়ায় পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ওই মুসলিমপ্রধান এলাকা। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে দেরি করেনি ভারত। ফলস্বরূপ পরবর্তী সময়ে সেখানে জোড়া বিমানঘাঁটি তৈরির অনুমতি পায় নয়াদিল্লি।
২১ শতকের গোড়ার দিকে ভারতের অর্থানুকূল্যে তাজিকিস্তানে জোড়া বিমানঘাঁটি গড়ে ওঠে। সেগুলি হল, আয়নি এবং ফারখোর। নির্মাণকাজ শেষ হলে নয়াদিল্লিকেই সেগুলি লিজ়ে চালানোর অনুমতি দেয় দুসানবে। সূত্রের খবর, এর মধ্যে প্রথমটি থেকে যাবতীয় কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যেই গুটিয়ে ফেলেছে ভারতীয় বিমানবাহিনী। আর সেটাও সাম্প্রতিক সময়ে নয়। তিন বছর আগে শেষ হয়েছে গোটা প্রক্রিয়া।
একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যম ‘দ্য প্রিন্ট’ জানিয়েছে, ভারত-তাজিকিস্তান আয়নি বিমানঘাঁটির লিজ়ের চুক্তি শেষ হয় ২০২২ সালে। সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটি আর পুনর্নবীকরণ করেনি দুসানবে। ফলে ওই বছরই সেখান থেকে সরে আসে নয়াদিল্লির ফৌজ। আয়নিতে ভারতীয় বিমানবাহিনী কোনও যুদ্ধাস্ত্র ফেলে আসেনি বলে জানা গিয়েছে।
২০২১ সালে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর দ্বিতীয় বারের জন্য আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ফেরে তালিবান। ওই সময় হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে আটকে পড়া ভারতীয়দের বার করে আনতে তাজিকিস্তানের আয়নি বিমানঘাঁটির ব্যাপক ব্যবহার করেছিল এ দেশের বায়ুসেনা। আফগান মুলুক থেকে নাগরিকদের উদ্ধারে সেখানে একের পর এক সামরিক মালবাহী বিমান পাঠায় নয়াদিল্লি। এর পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন দেবী শক্তি’।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত মধ্য এশিয়ার দেশটিকে দু’-তিনটি সামরিক হেলিকপ্টার উপহার দিয়েছিল ভারত। মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ত্রাণ এবং মানবিক সহায়তার জন্য সেগুলিকে ব্যবহার করত দুসানবে। এর জন্য অবশ্য নয়াদিল্লির বিমানবাহিনীর অফিসার এবং কর্মীদেরই সাহায্য নিতে হত তাদের। বিমানঘাঁটি ছাড়ার সময় সংশ্লিষ্ট কপ্টারগুলিকে সেখানেই রেখে আসার নির্দেশ দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, খবর সূত্রের।
তাজিকিস্তানের জোড়া বায়ুসেনা ঘাঁটিতে খুব অল্প সময়ের জন্য লড়াকু জেট মোতায়েন করেছিল ভারত। এর জন্য রুশ নির্মিত এসইউ-৩০এমকেআই যুদ্ধবিমানকে সেখানে নিয়ে যায় এ দেশের বিমানবাহিনী। সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটি থেকে মস্কোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার সুবিধা রয়েছে। বর্তমানে একে নয়াদিল্লির আকাশযোদ্ধাদের শিরদাঁড়া বললে অত্যুক্তি হবে না।
তাজিকিস্তানের ঠিক পশ্চিমে রয়েছে আয়নি গ্রাম। সেখানেই সংশ্লিষ্ট বিমানঘাঁটিটিকে নির্মাণ করে নয়াদিল্লি। চুক্তি থাকায় টানা দু’দশক এটি পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিল ভারত। বিদেশ মন্ত্রকের অর্থানুকূল্যে সংশ্লিষ্ট ছাউটিকে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল। এই প্রকল্পে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত ছিলেন ‘জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা’ বা এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার) অজিত ডোভাল এবং সাবেক বায়ুসেনাপ্রধান এয়ার চিফ মার্শাল বিএস ধানোয়া।
২০০১-’০২ আর্থিক বছরে জাতীয় নিরাপত্তাকে সুরক্ষিত করতে তাজিকিস্তানে বায়ুসেনা ঘাঁটি তৈরির প্রস্তাব পান তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ়। বিষয়টি নিয়ে সেনার শীর্ষ অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এর পরই দেশের বাইরে ছাউনি নির্মাণের সবুজ সঙ্কেত পায় বাহিনী। দুসানবের সঙ্গে যোগাযোগ করে শুরু হয় কাজ।
তাজিকিস্তানে জোড়া বিমানঘাঁটি নির্মাণের দায়িত্ব তৎকালীন গ্রুপ ক্যাপ্টেন নাসিম আখতারকে দিয়েছিল ভারতীয় বায়ুসেনা। পরবর্তী কালে এয়ার কমোডোর হিসাবে অবসর নেন তিনি। নাসিম সরে গেলে আরও একজন অফিসারকে দুসানবেতে পাঠায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। তাঁর বিরুদ্ধে আবার বেসরকারি ঠিকাদারদের কাজে লাগানোর অভিযোগ উঠেছিল। বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলাও দায়ের হয়। এতে কাজ কিছুটা থমকালেও তা পুরোপুরি আটকে যায়নি।
সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে বর্ডার রোড অর্গানাইজ়েশন বা বিআরওকে কাজে লাগিয়েছিল কেন্দ্র। এর নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার একজন অফিসার। এ দেশের মোট ২০০ জন বায়ুসেনা ঘাঁটি নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এর রানওয়ে ৩,২০০ মিটার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। এককথায় সেখানে যে কোনও ধরনের সামরিক এবং লড়াকু জেট অবতরণ ও উড্ডয়নের সুযোগ তৈরি করে নয়াদিল্লি।
দু’টি বিমানঘাঁটিতেই লড়াকু জেটের হ্যাঙ্গার, জ্বালানি ভরার জায়গা, মেরামতির ওয়ার্কশপ এবং রেডার স্টেশনের সুব্যবস্থা তৈরি করে ভারতীয় বিমানবাহিনী। এর জন্য ১০ কোটির বেশি ডলার খরচ করেছিল বিদেশ মন্ত্রক। মোদী সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর দুসানবের জোড়া ঘাঁটিতে এসইউ-৩০এমকেআই লড়াকু জেট নিয়ে যাওয়া হয়।
সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাজিকিস্তানের বিমানঘাঁটিগুলির গুরুত্ব ভারতের কাছে অপরিসীম। আয়নি ছাউনি থেকে পাক ও চিনা ফৌজের উপর নজরদারির সুবিধা পেত ভারত। পাশাপাশি, সেখান থেকে তালিবানশাসিত আফগানিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সহজ হচ্ছিল। আয়নি ত্যাগের খবর সত্যি হলে নয়াদিল্লির যাবতীয় পরিকল্পনায় যে জল পড়ল, তা বলাই বাহুল্য।
দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানের সঙ্গে পাক অধিকৃত কাশ্মীর বা পিওকের (পাকিস্তান অকুপায়েড কাশ্মীর) একটি ছোট্ট সীমান্ত রয়েছে। নাম ওয়াখান করিডর, যা ভারত থেকে মধ্য এশিয়া যাওয়ার একটি প্রাচীন রাস্তা। কাবুল নিয়ন্ত্রিত ওয়াখানের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে তাজিকিস্তানও। ফলে দুসানবেতে নয়াদিল্লির প্রভাব হ্রাসের খবরে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশের।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কথায়, তাজিকিস্তান সীমান্ত থেকে পিওকের দূরত্ব মেরেকেটে ২০ কিলোমিটার। আর তাই দুসানবেতে ভারতীয় বিমানবাহিনী মোতায়েন থাকায় ইসলামাবাদের রক্তচাপ বাড়ছিল। সেখানকার জোড়া বায়ুসেনা ঘাঁটি থেকে অনায়াসে পাক প্রদেশ খাইবার পাখতুনখোয়ার পেশোয়ারকে নিশানা করার সুবিধা রয়েছে। ফলে সংঘাত পরিস্থিতিতে রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারদের দু’দিকের সাঁড়াশি চাপে ফেলার সুযোগ পেত নয়াদিল্লি।
যদিও বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, তাজিকিস্তানের জোড়া বিমানঘাঁটি ব্যবহারের তেমন কোনও সুবিধা কখনওই নিতে পারেনি ভারত। ফলে পশ্চিমের রাস্তায় হামলা হওয়ার আতঙ্কে ভুগতে দেখা যায়নি ইসলামাবাদকে। এ ব্যাপারে সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশের দাবি, চুক্তিতে কোনও সামরিক অভিযানের অনুমতি সে ভাবে ছিল না। কারণ সে ক্ষেত্রে ইসলামাবাদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি হত দুসানবের।
জোড়া বায়ুসেনা ঘাঁটিতে ভারতের উপস্থিতি থাকা বা না থাকা নিয়ে সরকারি ভাবে এখনও কোনও বিবৃতি দেয়নি তাজিকিস্তান। ফলে নতুন কোন লিজ় নেওয়ার সুযোগ যে একেবারে নেই তা নয়। দুসানবের সঙ্গে নয়াদিল্লির কূটনৈতিক সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল। তা ছাড়া ফারখোর ঘাঁটি থেকে এ দেশের বাহিনী সরে এসেছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।