ফের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কুকীর্তি ফাঁস! তাঁর ‘পাকিস্তান প্রেম’-এর রহস্য উন্মোচনে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল হইচই। এই ইস্যুতে তাঁকে ‘মুনাফাখোর’ বলে বিস্ফোরক অভিযোগ করলেন আমেরিকার সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার) জ্যাক সুলিভান। পাশাপাশি, নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্কের শীতলতাকে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলে খোঁচা দিতেও ছাড়েননি তিনি।
ট্রাম্পের পূর্বসূরি জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের এনএসএ-র দায়িত্বভার সামলেছেন সুলিভান। সম্প্রতি টিম মিলারের সঙ্গে ‘দ্য বুলওয়ার্ক’ নামের একটি পডকাস্ট-সাক্ষাৎকার দেন তিনি। সেখানেই বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে একের পর এক বিস্ফোরক অভিযোগ করেন পেশায় আইনজীবী জ্যাক। বলেন, ‘‘পারিবারিক ব্যবসায় মোটা লাভের কথা মাথায় রেখে ভারতের মতো ‘কৌশলগত অংশীদার’কে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। এর ফল আমেরিকাকে ভোগ করতে হবে।’’
চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল ‘পাকিস্তান ক্রিপ্টো কাউন্সিল’ বা পিসিসি চালু করে ইসলামাবাদ। এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার ‘ক্রিপ্টো হাব’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার স্বপ্ন রয়েছে ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশীর। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বিকেন্দ্রীভূত আর্থিক প্ল্যাটফর্ম ‘ওয়ার্ল্ড লিবার্টি ফাইন্যান্সিয়াল’ বা ডব্লিউএলএফের সঙ্গে ইতিমধ্যেই একটি চুক্তি সেরে ফেলেছে পিসিসি, যা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিশানা করেন সুলিভান। তাঁর কথায়, ‘‘সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটি ছিল নয়াদিল্লির কাছে বিশ্বাসভঙ্গের শামিল।’’
সুলিভানের এই অভিযোগের যথেষ্ট সারবত্তা রয়েছে। গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সাল) যাত্রা শুরু করা ডব্লিউএলএএফের ৬০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে ‘ডিটি মার্কস ডিইএফআই এলএলসি’-র হাতে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আবার ট্রাম্প-পুত্র এরিক ও ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র এবং ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত। তাঁদের ওই সংস্থার মালিক বললে অত্যুক্তি করা হবে না।
শুধু তা-ই নয়, ডব্লিউএলএএফের ওয়েবসাইটের হোমপেজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ছবি দিয়ে তার নীচে ‘অনুপ্রাণিত’ শব্দটি লেখা রয়েছে। পাশাপাশি, তাঁকে ‘প্রধান ক্রিপ্টো অ্যাডভোকেট’ বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। গত ২২ এপ্রিল জন্মু-কাশ্মীরের পলেহগাঁওয়ে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ ২৬ জন। সেই ঘটনার চার দিনের মাথায় পিসিসির সঙ্গে চুক্তি করে ডব্লিউএলএএফ। পডকাস্টে এই নিয়েও প্রশ্ন তোলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা।
সাক্ষাৎকারে সুলিভান বলেন, ‘‘এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে শুধুমাত্র পারিবারিক ব্যবসায় মুনাফার জন্য ভারতকে এক পাশে সরিয়ে রেখে পাকিস্তানের হাত ধরেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এতে অবশ্য ষোলো আনা মদত রয়েছে ইসলামাবাদের। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে গেলে এটা একটা বিরাট বড় কৌশলগত ধাক্কা। নয়াদিল্লির সঙ্গে অংশীদারি ওয়াশিংটনের স্বার্থপূরণে সহায়ক। সেটা একটি পরিবারের লাভের নিরিখে জলাঞ্জলি দেওয়া যায় না।’’
পহেলগাঁও হামলার পর পাক সন্ত্রাসবাদীদের গুপ্ত ঘাঁটিগুলিকে গুঁড়িয়ে দিতে বিশেষ সেনা অভিযান চালায় ভারত। এর পোশাকি নাম রাখা হয় ‘অপারেশন সিঁদুর’। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চার দিনের সংক্ষিপ্ত ‘যুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়ে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ। পরে সংঘর্ষ থামাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছেন বলে দাবি তোলেন ট্রাম্প। কিন্তু পত্রপাঠ তা খারিজ করে দেয় কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। আমেরিকার জনপ্রিয় গণমাধ্যম ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এতেই চটে গিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে একের পর এক পদক্ষেপ করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
সুলিভান অবশ্য এই যুক্তি মানতে নারাজ। পডকাস্টে তিনি বলেন, ‘‘সেটা হলে, রুশ খনিজ তেল কেনার যুক্তি দেখিয়ে কেন নয়াদিল্লির উপরে শুল্ক চাপাচ্ছেন তিনি? কেন জোর দিয়ে বলছেন না, সংসদে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী? আমরা কোনও দেশের আন্তর্জাতিক বৈধ বাণিজ্যে হস্তক্ষেপ করতে পারি না। সেটা তাদের সার্বভৌমত্বে আঘাত করার শামিল। ভারতের মতো শক্তিশালী দেশ কখনওই সেটা মানবে না।’’ গত জুলাইয়ে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে সংসদে বিবৃতি দেন মোদী।
সেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘তৃতীয় কোনও দেশ ভারতকে যুদ্ধ থামাতে বলেনি।’’ তার পরেও অবশ্য নিজের অবস্থান থেকে একচুল সরেননি ট্রাম্প। সুলিভানের দাবি, এতে দু’দেশের সম্পর্কে আরও জটিলতা তৈরি হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটির সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা তৈরি করতে কয়েক দশক সময় লেগে গিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লির কাছাকাছি যাওয়া একান্ত ভাবে প্রয়োজন। এতে বাড়বে প্রযুক্তি, প্রতিভা ও আর্থিক আদানপ্রদান।’’
এর পরেই পডকাস্ট-সাক্ষাৎকারে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চিনের ক্ষমতাবৃদ্ধির প্রসঙ্গ তোলেন সুলিভান। তিনি বলেন, ‘‘ড্রাগনের আগ্রাসন ঠেকাতে হলে ভারতকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকাকে এগোতে হবে। নইলে ওই এলাকায় ড্রাগনের হাতে নাস্তানাবুদ হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। কিন্তু, ট্রাম্পের বিদেশনীতির জেরে নয়াদিল্লি ধীরে ধীরে বেজিং এবং মস্কোর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সেখান থেকে তাদের ফেরানো কঠিন হবে।’’
গত জুনে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন তিনি। পডকাস্টে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেছেন, ‘‘এটা ছিল আসলে একটা ঘুষ দেওয়ার ফাঁদ। ট্রাম্পের পরিবার এবং তাঁর ঘনিষ্ঠদের ক্রিপ্টো কাউন্সিলে ধরে রাখতে প্রেসিডেন্টকে তোষামোদ করেছেন মুনির।’’
পাশাপাশি, ট্রাম্পের বিদেশনীতিতে আন্তর্জাতিক ম়ঞ্চে কী ভাবে আমেরিকা একা হয়ে পড়ছে, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন সুলিভান। তাঁর কথায়, ‘‘ভারতের সঙ্গে আমরা যে অসভ্যতা করলাম, সেটা কিন্তু জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স বা কানাডার মতো দেশগুলি দেখছে। এ বার তারা ভাববে আমাদের সঙ্গেও এটা ঘটতে পারে। তখন এক এক করে সব ‘বন্ধু’রা সরে পড়বে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রাখবে তারা।’’ এতে ভূ-রাজনৈতিক সঙ্কটের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বড় বিপদের মুখে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
এ বছরের জানুয়ারিতে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতা যে হ্রাস পেয়েছে, তা একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন প্রাক্তন এনএসএ সুলিভান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এখন অনেক দেশের নেতানেত্রীরাই আমাদের নিয়ে উপহাস করে কথা বলেন। তাঁদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র একটা ‘গোলমাল পাকানো’ দেশ, যাকে বিশ্বাস বা নির্ভর, কোনওটাই করা যায় না।’’ অন্য দিকে, বিশ্বমঞ্চে ভারতের পাশাপাশি চিনের গ্রহণযোগ্যতা কয়েক গুণ বেড়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
এ ব্যাপারে একটি প্রশ্নের জবাবে চমৎকার উদাহরণ দেন সুলিভান। বলেন, ‘‘জনপ্রিয়তার দিক থেকে ওয়াশিংটনের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে আছে বেজিং। অনেক দেশই মার্কিন ব্র্যান্ডকে শৌচালয়ের সঙ্গে তুলনা করেন। তাঁদের কাছে চিন একটা দায়িত্বশীল খেলোয়াড়। অথচ এক বছর আগেও এমনটা ছিল না।’’ ট্রাম্প জমানায় এই সূচক আরও নিম্নমুখী হচ্ছে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
গত ৩১ অগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চিনের তিয়েনজিনে চলেছে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিও-ভুক্ত (সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজ়েশন) দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠক। সেখানে যোগ দিয়ে ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলাদা করে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন মোদী। এই আবহে সাবেক মার্কিন এনএসএ-র এ-হেন মন্তব্যের আলাদা গুরুত্ব আছে বলেই মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল।
সুলিভানের সুরেই কথা বলতে শোনা গিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন বোল্টনকে। একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোষ্ঠীভুক্ত ছিল ভারত। সেখান থেকে নয়াদিল্লিকে বার করে আনতে কয়েক দশক সময় লেগে গিয়েছিল। এটা সত্যি যে আমরা ওদের বিপুল পরিমাণে হাতিয়ার বিক্রি করতে পারিনি। কিন্তু সব ভুলে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সুরক্ষার প্রশ্নে আমাদের কাছে এসেছিল মোদী সরকার।’’
কিন্তু, ট্রাম্পের শুল্কনীতির জেরে সেই সম্পর্কে যে চওড়া ফাটল দেখা দিয়েছে, তা মেনে নিয়েছেন বোল্টন। এ ব্যাপারে তাঁর গলায় ছিল হতাশার সুর। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘আমরা ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে চতুঃশক্তি জোট তৈরি করেছিলাম। কিন্তু সেই পরিশ্রম জলে গেল বলেই মনে হচ্ছে।’’ এ বছরের সেপ্টেম্বরে সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির বৈঠক নয়াদিল্লিতে হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু সেখানে যোগ দিতে আসছেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
গত জুলাইয়ে ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন ট্রাম্প। ফলে ২৭ অগস্ট থেকে এ দেশের সামগ্রীতে ৫০ শতাংশ করে কর নিচ্ছে আমেরিকার প্রশাসন। এর জেরে নয়াদিল্লির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাণিজ্য করা যথেষ্ট কঠিন হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে চিন সফরে শি এবং পুতিনের সঙ্গে মোদীর ঘনিষ্ঠ বাক্যালাপ নতুন জল্পনার জন্ম দিয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক গাড়িতেও হোটেলে যান তিনি।
তিয়েনজিনে এসসিও বৈঠক শেষ হতে না হতেই নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ একটি পোস্ট করেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘অনেকেই বুঝতে পারছেন না যে ভারতের সঙ্গে আমাদের বিরাট বাণিজ্যিক ঘাটতি রয়েছে। নয়াদিল্লি ক্রমাগত মস্কোর থেকে খনিজ তেল এবং হাতিয়ার কিনে চলেছে। এতে আখেরে লোকসান হচ্ছে আমেরিকার।’’ তাঁর এই পোস্টের পরেও যুক্তরাষ্ট্রের আমজনতার মধ্যে ট্রাম্পের নীতিকে কেন্দ্র করে দানা বাঁধছে বিক্ষোভ।
‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিও-র বৈঠকে একটি উন্নয়নমূলক ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে অনুমোদন পেয়েছে চিন। এর মাধ্যমে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ‘একাধিপত্য’কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বেজিঙের। ফলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের শীতলতায় আমেরিকার যে রক্তচাপ বাড়ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পরিস্থিতি সামলাতে ট্রাম্প কোনও বড় পদক্ষেপ করেন কি না, সেটাই এখন দেখার।