নতুন প্রজন্মের হাতিয়ারের দুনিয়ায় পা রাখল ভারত। সৌজন্যে ‘ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন’ বা ডিআরডিও। লেজ়ার অস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে দেশের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা। এর সাহায্যে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ আকাশেই পুড়িয়ে ছাই করতে পারবে ফৌজ।
চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল লেজ়ার হাতিয়ারটির পরীক্ষায় সাফল্য পায় ডিআর়ডিও। অস্ত্রটির পোশাকি নাম ‘এমকে-টু(এ) লেজ়ার’। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি ‘ডিরেক্ট এনার্জি ওয়েপন সিস্টেম’ বা ডিইডব্লিউ। বর্তমান বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশের কাছে আছে এই হাতিয়ার।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্নুলের ন্যাশনাল ওপেন এয়ার রেঞ্জে লেজ়ার হাতিয়ারের পরীক্ষা করা হয়। ইতিমধ্যেই সেই ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি তৈরির মূল কৃতিত্ব ডিআরডিওর ‘সেন্টার ফর হাই এনার্জি সিস্টেমস অ্যান্ড সায়েন্সেস’-এর (সিএইচইএসএস)।
লেজ়ার হাতিয়ারের গবেষণায় হারদরাবাদের একাধিক ল্যাবরেটরি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাহায্য পেয়েছে ডিআরডিও। পরে নকশা অনুযায়ী অস্ত্রটিকে তৈরি করে একটি দেশীয় প্রতিরক্ষা সংস্থা। ট্রাক আকৃতির গাড়ির উপর ‘এমকে-টু(এ) লেজ়ার’কে বসানো হয়েছে। যুদ্ধের সময়ে একে একাধিক রণাঙ্গনে মোতায়েন করতে পারবে ফৌজ।
‘এমকে-টু(এ)’র পরীক্ষায় সাফল্য পাওয়ার পর নতুন প্রজন্মের হাতিয়ারটিকে নিয়ে বিবৃতি দেয় ডিআরডিও। প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থার তরফে বলা হয়েছে, ‘‘ভারত এ বার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন লেজ়ার অস্ত্র ব্যবস্থার অধিকারী দেশগুলির ক্লাবে ঢুকে পড়ল।’’ হাতিয়ারটি একসঙ্গে গুচ্ছ গুচ্ছ ড্রোন হামলাকে রুখে দিতে পারবে বলে বলে দাবি করেছে ডিআরডিও।
প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা সূত্রে খবর, শত্রুর নজরদারি সেন্সর, অ্যান্টেনা বা রাডার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে পারবে ‘এমকে-টু(এ)’। চোখের পলক ফেলার আগে নিখুঁত নিশানায় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলা চালাতে পারবে এই সমরাস্ত্র। লেজ়ার হাতিয়ারটি ৩০ কিলোওয়াট শক্তি সম্পন্ন। তবে এর পাল্লার বিষয়টি গোপন রেখেছে প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা।
ডিআরডিওর তরফে অত্যাধুনিক অস্ত্রটিকে ‘ড্রোন ঘাতক’-এর তকমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থাটির কর্তা-ব্যক্তিদের দাবি, ‘এমকে-টু(এ)’র সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, এর নামমাত্র খরচ। এক-দু’লিটার পেট্রলের দামে কয়েক সেকেন্ডের জন্য লেজ়ার রশ্মি ছুড়তে পাবে এই হাতিয়ার।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) সংজ্ঞা বদলে দেবে ডিআরডিওর তৈরি অত্যাধুনিক এই অস্ত্র। এর দু’রকম ব্যবহারের কথা বলেছেন সাবেক সেনাকর্তারা। দীর্ঘ দিন ধরেই ড্রোনের সাহায্যে জম্মু-কাশ্মীর এবং পঞ্জাবে হাতিয়ার ও মাদক চোরাচালান চালিয়ে আসছে পাকিস্তান। বাহিনীতে ‘এমকে-টু(এ)’ চলে এলে সেই সূচক যে অনেকাংশেই নেমে আসবে, তা বলাই বাহুল্য।
এ ছাড়া যুদ্ধ বা সীমান্ত সংঘর্ষের সময়ে শত্রুর ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসা ড্রোনকে পুড়িয়ে শেষ করতে পারবে নতুন লেজ়ার হাতিয়ার। তবে ভারতীয় ফৌজ় কবে থেকে এটি ব্যবহার শুরু করবে, তা স্পষ্ট করেনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
কিছু দিন আগে ‘সূর্য’ নামের একটি ‘ডিইডব্লিউ’ তৈরির জন্য ডিআরডিও গবেষণা চালাচ্ছে বলে খবর প্রকাশ্যে আসে। নতুন লেজ়ার হাতিয়ারটির সঙ্গে তার কোনও মিল রয়েছে কি না, সেটা জানা যায়নি। তবে ‘সূর্য’র মাধ্যমে লেজ়ার, মাইক্রোওয়েভ বা পার্টিকল বিমের (কণা রশ্মি) মতো কেন্দ্রীভূত শক্তিকে শত্রুর উপর সরাসরি প্রয়োগ করা যাবে বলে জানা গিয়েছিল।
‘সূর্য’ নিয়ে গবেষণার কাজে নিয়োজিত রয়েছে ডিআরডিওর লেজ়ার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজ়ি সেন্টার। প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থাটির দাবি, ২০২৭ সালের মধ্যে হাতিয়ারটির প্রোটোটাইপ তৈরি করার কাজ পুরোপুরি শেষ করতে পারবে তারা। তবে এর জন্য একাধিক বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্বের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
তবে ডিইডব্লিউ নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারতকে পথিকৃৎ বলা যায় না। বর্তমানে এই নিয়ে গবেষণায় মেতে আছেন বিশ্বের একাধিক দেশের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। ১০০ কিলোওয়াটের শক্তি সম্পন্ন লেজ়ার অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে আমেরিকা। এই প্রতিযোগিতায় আছে চিনও।
অন্য দিকে, এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে রাশিয়া। মস্কোর প্রতিরক্ষা গবেষকেরা যে লেজ়ার হাতিয়ার তৈরি করেছেন, তার পোশাকি নাম ‘পেরেসভেট’। অস্ত্রটি পৃথিবীর নিম্নকক্ষ পথে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহকেও ধ্বংস করতে সক্ষম। তবে এখনও পর্যন্ত কোনও যুদ্ধে এটিকে ব্যবহার করেনি ক্রেমলিন।
গত বছরের নভেম্বরে নতুন লেজ়ার হাতিয়ারের একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করে গোটা দুনিয়াকে চমকে দেয় ইজ়রায়েল। অস্ত্রটির পোশাকি নাম আয়রন বিম। ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) সূত্রে খবর, যাবতীয় হাওয়াই হামলা রুখতে সক্ষম তাঁদের এই নতুন হাতিয়ার।
ইজ়রায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে, আয়রন বিম রকেট এবং ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও মর্টারের গোলা এবং ড্রোন ধ্বংস করতে সক্ষম। ২০২১ সালে এই হাতিয়ারের একটি নমুনা তৈরি করা হয়েছিল। তখন থেকেই আইডিএফের অস্ত্রাগারে আয়রন বিমকে যুক্ত করতে মরিয়া ছিলেন ইহুদি প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
সংবাদ সংস্থা ‘সিএনএন’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইজ়রায়েলের এই নতুন হাতিয়ারটি থেকে ১০০ কিলোওয়াটের লেজ়ার বিম ছোড়া যায়। এর পাল্লা সাত কিলোমিটার। অর্থাৎ, এই দূরত্বে কোনও রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন বা মর্টার চিহ্নিত হলে, তা আকাশেই ধ্বংস করতে পারে আয়রন বিম। চলতি বছর থেকে বিভিন্ন মোর্চায় আইডিএফ এটিকে মোতায়েন করবে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর।
অন্য দিকে, এ বছরের মার্চে ড্রোন ধ্বংসকারী নতুন সমরাস্ত্রের প্রদর্শন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক সংস্থা এপিরাস আইএনসি। স্পার্টার ইতিহাসখ্যাত গ্রিক রাজাকে মনে রেখে হাতিয়ারটির নামকরণ করা হয়েছে ‘লিওনাইডাস সিস্টেম’। স্টার্ট আপ কোম্পানিটির দাবি, সংশ্লিষ্ট অস্ত্রটি থেকে বেরিয়ে আসা উচ্চ শক্তির মাইক্রোওয়েভ নিমেষে পুড়িয়ে ছাই করবে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসা মানববিহীন উড়ুক্কু যান।
আমেরিকা, রাশিয়া, ইজ়রায়েল হোক বা ভারত, এই ধরনের সরাসরি শক্তির হাতিয়ার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রথমত, এই অস্ত্র নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চালিয়ে যেতে হলে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। সেটা না পাওয়া গেলে উচ্চ শক্তির লেজ়ার বা মাইক্রোওয়েভ তৈরি করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, শত্রুপক্ষ যদি যুদ্ধের গোড়াতেই বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহের কেন্দ্রগুলি উড়িয়ে দেয়, তা হলে একরকম অকেজো হয়ে পড়বে এই সমরাস্ত্র।