জীবনে কখন কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তা কেউই বলতে পারে না। আপনি হয়তো সঠিক পথ দিয়েই চলছেন, ভাবছেন সৎ থাকলে ভয় কিসের! কিন্তু আপনার সততার উপরও যদি কালি লেপার চেষ্টা করা হয়? কী ভাবে সামলাবেন নিজেকে? আদৌ কি কাটিয়ে উঠতে পারবেন সমাজের হেনস্থা!
এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল জগেশ্বরপ্রসাদ আওয়াধিয়ার জীবনে। অতি সাধারণ পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন তিনি। সব সময় চেষ্টা করেছেন সৎ পথে আয় করার। কিন্তু সেই জগেশ্বরকেই টানা ৩৯ বছর ধরে বাঁচতে হয়েছিল অসম্মানিত হয়ে, সঙ্গে মিলেছিল আদালতের টানাপড়েন।
ঘুষ নেওয়া এবং ঘুষ দেওয়া— আইনের চোখে দু’টিই অপরাধমূলক কাজ। ধরা পড়লে অনেক সময় কড়া শাস্তি মেলে। অনেক সময় আবার শাস্তি তো দূর, ঘুষের বিষয়ে টেরও পাওয়া যায় না।
কিন্তু মাত্র ১০০ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে কখনও কাউকে শাস্তি পেতে শুনেছেন? তা-ও আবার কোনও দোষ না করেই! হ্যাঁ, জগেশ্বরের সঙ্গে এমনটাই হয়েছিল।
১০০ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে টানা ৩৯ বছর আদালতে হাজিরা দিয়ে গিয়েছিলেন জগেশ্বর। সঙ্গে ছিল আরও ভয়ঙ্কর শাস্তি। সমাজ, পাড়া, প্রতিবেশী তো জগেশ্বরকে ঘুষখোরের তকমা দিয়েই দিয়েছিল। জগেশ্বরের পরিবারকেও হেনস্থা করতে ছাড়েনি তারা।
জগেশ্বর ছত্তীসগঢ়ের রাজধানী রায়পুরের বাসিন্দা। তাঁর উপার্জনেই সংসার চলত। স্ত্রী এবং চার সন্তানকে নিয়ে সুখী পরিবার ছিল তাঁর। জগেশ্বর চাকরি করতেন মধ্যপ্রদেশ রাজ্য সড়ক পরিবহণ কর্পোরেশনের রায়পুর অফিসে। সেই চাকরিই তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় ‘কাল’ হয়ে দাঁড়ায়। ছিনিয়ে নেয় মান, সম্মান, সব কিছু!
আদালতের দীর্ঘ টানাপড়েনের পর অবশেষে জয় হয়েছে তাঁর। যদিও লাঞ্ছনা পেতে পেতে হারিয়ে গিয়েছে বেঁচে থাকার ইচ্ছে। ৮৩ বছর বয়সে এসে জগেশ্বর বলছেন, ‘‘এ বার অন্তত আমি শান্তিতে মরতে পারব!’’ এখন শুধু মৃত্যুর চিন্তা জগেশ্বরের মনে।
কিন্তু এমন কী হয়েছিল যে জগেশ্বরকে যন্ত্রণা, সম্মানহানির সঙ্গে কাটাতে হল এতগুলি বছর! ১৯৮৬ সালের ঘটনা। জগেশ্বরের বয়স তখন ৪৪ বছর।
রাজ্য সড়ক পরিবহণ দফতরে জগেশ্বর চাকরি করতেন বিলিং সহকারী পদে। কাজের দক্ষতার জন্য সুনাম ছিল তাঁর। বিলিং সহকারী পদ মানেই বোঝা যায় তাঁকে বেশ দায়িত্বপূর্ণ কাজই করতে হত। যতই লোভনীয় সুযোগ আসুক না কেন, সততার পথ থেকে কখনওই নড়তেন না জগেশ্বর।
কিন্তু একটা অভিযোগ বদলে দেয় জগেশ্বরের জীবন। ওই সংস্থারই এক কর্মী অশোককুমার বর্মা জগেশ্বরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। অভিযোগ ছিল ১০০ টাকা ঘুষ নেওয়ার।
একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, অশোক একটি কাজের জন্য তাঁর বকেয়া বিল পরিশোধ করতে চাপ দিচ্ছিলেন জগেশ্বরকে। কিন্তু উপযুক্ত নিয়ম দেখিয়ে জগেশ্বর সেই বিল পরিশোধ করতে রাজি হননি।
অশোক ভেবেছিলেন জগেশ্বরকে ঘুষ দিয়ে কাজ আদায় করবেন। তাই প্রথমে ২০ টাকার ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু সে টাকা জগেশ্বর ফিরিয়ে দেন। এতেই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন অশোক।
তার পর ওই বছরেরই ২৪ অক্টোবর ফন্দি আঁটেন অশোক। জগেশ্বরকে ফের একটি কাজের জন্য ১০০ টাকা ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করেন। জোরাজুরির সময় নজরদারি কর্মকর্তারা চলে আসেন।
কোনও কিছু বিচার না করেই সঙ্গে সঙ্গে জগেশ্বরকে গ্রেফতার করা হয়। জগেশ্বর বার বার নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও কেউ শোনেননি তাঁর কথা। জগেশ্বর অভিযোগ করেছিলেন, এই ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। তাঁর হাতে জোর করে টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে ফাঁসানো হচ্ছে। তবে ওই মুহূর্তে তাঁর কোনও কথাই কেউ শোনেননি।
এই ঘটনা জগেশ্বর ও তাঁর পরিবারকে একেবারে শেষ করে দিয়েছিল। চাকরি থেকে সাসপেন্ড করে দেওয়া হয় ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। এর পর চলে আরও টানাপড়েন। চাকরির জায়গা স্থানান্তরিত করে দেওয়া হয়, বেতনও অর্ধেক পাচ্ছিলেন জগেশ্বর। পদোন্নতি, বেতনবৃদ্ধি-সহ অন্যান্য সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয় তাঁকে।
একে তো সমাজের কাছে তাঁর পরিবার ঘুষখোর হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল, সেই সঙ্গে ছিল আর্থিক অনটন। অবসর গ্রহণের পর জগেশ্বরের পেনশনও বন্ধ করে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত একজন প্রহরীর চাকরি করে সংসার খরচ বহন করছিলেন জগেশ্বর।
দীর্ঘ ৩৯ বছর ধরে আদালতে মামলা চলে। অবশেষে জয় হয় সত্যের। বিচারক জগেশ্বরকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে ঘোষণা করেন। জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে যে কপাল থেকে ঘুষখোরের তকমা সরাতে পেরেছেন তাতেই শান্তি জগেশ্বরের। এখন তাঁর একটাই আবেদন, তিনি যেন তাঁর চাকরির আটকে থাকা টাকাগুলি ফেরত পান।