ঘোর সঙ্কটে বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের শিল্পপতি ইলন মাস্ক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ‘ঝগড়া’য় মহা বিপাকে পড়েছেন তিনি। হু-হু করে নেমেছে তাঁর সংস্থাগুলির শেয়ারের দর। রাতারাতি গায়েব হয়ে গিয়েছে ৩৮ হাজার কোটি ডলার। এই পরিস্থিতিতে ভারতের বাজারে পা রেখেছেন ইলন। এখানে ফের ভাগ্যলক্ষ্মী সহায় হবে তাঁর? না কি সর্বস্ব হারাতে হবে? ধনকুবের শিল্পপতির মেগা এন্ট্রিকে ঘিরে তীব্র হচ্ছে জল্পনা।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর মাস্ককে ‘কিচেন ক্যাবিনেট’-এর সদস্য করে নেন ট্রাম্প। ধনকুবের শিল্পপতির জন্য বিশেষ একটি দফতর তৈরি করেন তিনি। নাম, ‘ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’ বা ডজ। কিন্তু, ১৩০ দিনের মাথায় মোহভঙ্গ হয় ইলনের। সেখান থেকে ইস্তফা দেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, প্রকাশ্যেই বর্ষীয়ান রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে থাকেন ধনকুবের শিল্পপতি।
মাস্কের ‘পা হড়কানো’র সেই শুরু। ট্রাম্পকে ক্রমাগত আক্রমণ করতে থাকায় পাল্টা মুখ খোলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সরাসরি ধনকুবের শিল্পপতিকে দেন হুঁশিয়ারি। বলেন, বৈদ্যুতিন গাড়ি নির্মাণের জন্য সরকারের থেকে তিনি যে ভর্তুকি পাচ্ছেন, অচিরেই তা বন্ধ হতে পারে। তাঁর ওই হুমকির পরই লাফিয়ে লাফিয়ে পড়তে থাকে মাস্কের যাবতীয় সংস্থাগুলির শেয়ারের দাম। এর মধ্যে অন্যতম হল বৈদ্যুতিন গাড়ি বা ইভি (ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল) নির্মাণকারী সংস্থা টেসলা।
গত এপ্রিলে মাস্কের সংস্থার তৈরি ইভির বিক্রি কমে যায় ১৩ শতাংশ। ঠিক তার পরের মাসেই ট্রাম্পের ‘কিচেন ক্যাবিনেট’ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। ফলে টেসলার ইভি বিক্রির সূচক আর কখনওই ঊর্ধ্বমুখী হয়নি। এই পরিস্থিতিতে তাঁর ভারতের বাজারে পা রাখার সিদ্ধান্তকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, এ দেশ থেকে যাবতীয় খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারেন মাস্ক।
বিশ্লেষকদের দাবি, বর্তমানে ইলনের কোম্পানি টেসলার সঙ্গে একেবারে কাঁটায় কাঁটায় টক্কর চলছে চিনা বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা ‘বিওয়াইডি’-র। মাস্কের সংস্থার তৈরি মডেল ৩-র বাজার খেয়ে নিতে সম্প্রতি নতুন একটি সেডান লঞ্চ করেছে বেজিঙের এই ইভি সংস্থা, নাম কিউইন এল। গাড়িটির দাম অনেকটাই কম হওয়ার কারণে ইতিমধ্যেই তা চারচাকা-প্রেমীদের নজর কেড়েছে। টেসলার বিক্রি কমার নেপথ্যে একে অন্যতম বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
এ-হেন খাদের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ভাগ্য ফেরাতে কেন ভারতের বাজার বেছে নিলেন মাস্ক? বিশ্লেষকদের দাবি, এর নেপথ্যে প্রধান কারণ হল এ দেশের দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকা অর্থনীতি। তা ছাড়া গাড়ির বাজারের নিরিখে দুনিয়ায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের নাম। প্রথম দু’টি স্থান ধরে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিন। ফলে এখানে চার চাকা গাড়ির ব্যবসায় সাফল্য পাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা যে রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
সমীক্ষকদের দাবি, গত ১০ বছরে এ দেশের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে গাড়ির চাহিদা। ২০১৫ সালে বিক্রি হওয়া চারচাকার সংখ্যা ছিল ২৬ লক্ষ। ২০২৪ সালে সেটাই বেড়ে ৪২ লক্ষে পৌঁছোয়। এ দেশের প্রতি হাজার জনে মাত্র ৪৪ জন গাড়ি ব্যবহার করেন। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চিনে এই অঙ্কটা যথাক্রমে ৫০২, ৪২২ এবং ২৫১। বিশ্লেষকেরা তাই মনে করেন, আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির কারণে ভারতে আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে গাড়ি বিক্রির সূচক।
বিশেষজ্ঞদের দেওয়া পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এ দেশে বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রির সূচক বছরে ৬.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২৫ লক্ষ থেকে ৪৫ লক্ষ টাকা দামের গাড়ির ক্ষেত্রে এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তাঁরা। চলতি বছরে ভারতের বাজারে বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রির সূচক পৌঁছোতে পারে ১৩২ কোটি ডলারে। ২০৩০ সালের মধ্যে সেটা বেড়ে ১৮২ কোটি ডলারে পৌঁছোনোর সম্ভাবনা রয়েছে।
একাধিক সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছরে এ দেশের বাজারে ঘণ্টায় ছ’টি করে ৫০ লক্ষ টাকা বা তার বেশি দামের বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রি হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ভারতে ইভি উৎপাদনের সূচককেও ২০২৪ সাল থেকে ক্রমাগত উপরের দিকে উঠতে দেখা যাচ্ছে। চলতি বছরে এতে পাঁচ শতাংশের বৃদ্ধি দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী বছর দ্বিগুণ হয়ে ইভির উৎপাদন বাড়তে পারে ১০ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ২৫ শতাংশে পৌঁছোবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
গত বছরের ১৫ মার্চ বৈদ্যুতিক যাত্রিবাহী গাড়ি উৎপাদনকে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ প্রকল্পের ঘোষণা করে কেন্দ্র। নাম, ‘স্কিম টু প্রোমোট ম্যানুফ্যাকচারিং অফ ইলেকট্রিক প্যাসেঞ্জার কারস ইন ইন্ডিয়া’ বা এসপিএমইপিসিআই। এর মাধ্যমে ভারতের মাটিতে ইভি উৎপাদন বাড়াতে মাস্কের টেসলার মতো সংস্থার জন্য দরজা খুলে দিয়েছে সরকার। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির আওতায় বৈদ্যুতিন গাড়ি বা তার সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক ১৫ শতাংশ কমিয়েছে প্রশাসন।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ভারতকে ইভি উৎপাদনের নতুন হাব হিসাবে গড়ে তুলতে চাইছে কেন্দ্র। এর জন্য একগুচ্ছ প্রকল্প ঘোষণা করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। উদাহরণ হিসাবে গত বছরের ইলেকট্রিক মোবিলিটি প্রোমোশন স্কিম এবং দু’টি প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেনটিভ স্কিমের কথা বলা যেতে পারে। এগুলির জন্য বরাদ্দ হয়েছে যথাক্রমে ৭৭৮ কোটি, ২৫ হাজার ৯৩৮ কোটি এবং ১৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
ভারতের মাটিতেই মাস্কের টেসলা উৎপাদন শুরু করুক, সেটা চাইছে কেন্দ্র। ধনকুবের মার্কিন শিল্পপতি অবশ্য এখনই এ ব্যাপারে কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত দেননি। তবে তাঁর বিনিয়োগ টানতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে গুজরাট এবং তামিলনাড়ু প্রশাসন। দৌড়ে আছে মহারাষ্ট্র সরকারও। অর্থাৎ, সে দিক থেকে মাস্ক কিছুটা ‘পাটা পিচে’ ব্যাটিং করার সুযোগ পাবেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
টেসলার ভাগ্য পরিবর্তন ইস্যুতে সমীক্ষকদের একাংশ আইফোনের উদাহরণ দিয়েছেন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ভারতের বাজারে মার্কিন টেক জায়ান্ট সংস্থা অ্যাপ্লের তৈরি ফোনটির পাইকারি রাজস্ব বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র গুণমানের কারণে বহুজাতিক দক্ষিণ কোরীয় সংস্থা স্যামসাংকে পিছনে ফেলে দিয়েছে তারা। মাস্কের টেসলার ক্ষেত্রেও একই ছবি দেখতে পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বৈদ্যুতিন গাড়ির পাশাপাশি ভারতের বাজারে পা রাখতে চলেছে মাস্কের উপগ্রহভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা স্টারলিঙ্ক। এর জন্য কোনও নিলামের মুখোমুখি হতে হবে না তাঁকে। ফলে ইন্টারনেটের গতির নিরিখে এ দেশের অন্য টেলিকম সংস্থাগুলিকে স্টারলিঙ্ক অচিরেই পিছনে ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারতে কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করতে এ দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর (ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজ়েশন) সঙ্গে চুক্তি করে মাস্কের সংস্থা ‘স্পেসএক্স’। গত বছর যৌথ ভাবে জিস্যাট-এন২ নামের কৃত্রিম উপগ্রহকে মহাশূন্যে পাঠায় তারা। আগামী দিনে আরও কাছাকাছি আসতে পারে এই দুই সংস্থা।
বর্তমানে মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সংস্থা নাসার (ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে মাস্কের ‘স্পেসএক্স’। তাঁর সংস্থার তৈরি একাধিক কৃত্রিম উপগ্রহকে প্রায়ই অন্তরীক্ষে পাঠিয়ে থাকা নাসা। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে নভশ্চরদের নিয়ে যাওয়ার কাজও করছে ‘স্পেসএক্স’। আর তাই ইসরোর থেকেও একই রকমের প্রকল্পে তাদের একাধিক বরাত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ভারতের বাজারে টেসলা যুগের সূচনার জন্য ২০০ থেকে ৩০০ কোটি ডলার পর্যন্ত লগ্নি করতে পারেন মাস্ক। এ দেশে বছরে পাঁচ লক্ষ ব্যাটারিচালিত গাড়ি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। এতে হাজারের বেশি কর্মীর সরাসরি হবে কর্মসংস্থান। এ ছাড়া স্টারলিঙ্কে ৫০ হাজারের বেশি প্রযুক্তিবিদ কাজ পেতে পারেন। ২০৩৩ সালের মধ্যে উপগ্রহভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবাকে শক্ত ভিতের উপরে দাঁড় করাতে মাস্কের সংস্থার বিনিয়োগ ৪,৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত ১৫ জুলাই মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বইয়ের বান্দ্রা কুর্লা কমপ্লেক্সে প্রথম বিপণির উদ্বোধন করে টেসলা। সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, ওয়াই মডেলের বৈদ্যুতিক গাড়ি ভারতীয় বাজারে আনছে তাদের সংস্থা। এর রিয়ার-হুইল ড্রাইভ সংস্করণটি ৫৯.৮৯ লক্ষ টাকায় (অন-রোড) বিক্রি করবে তারা। অন্য দিকে, ওয়াই মডেলের লং রেঞ্জ গাড়িটির মূল্য হবে ৬৭.৮৯ লক্ষ টাকা (অন-রোড)।