বদলেছে সময়, বদলাচ্ছে যুদ্ধকৌশল। ‘জেন জ়েড’ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অত্যাধুনিক হাতিয়ারে তাই ফৌজকে সাজাচ্ছে ভারত। কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) চালিত স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান থেকে হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র। কিংবা নজরদারি বিমান ও দূরপাল্লার রকেট লঞ্চার। আগামী দিনে এই সমস্ত মারণাস্ত্র হাতে পাবে বাহিনী। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, চিন-পাকিস্তানের ঘুম উড়িয়ে এগুলি ঘরের মাটিতে তৈরির উপর জোর দিয়েছে নয়াদিল্লি।
‘জেন জ়েড’ যুগের অস্ত্রগুলির মধ্যে প্রথমেই বলতে হবে এআই চালিত নেগেভ লাইট মেশিনগানের (এলএমজি) কথা। সম্প্রতি হিমালয়ের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এর সফল পরীক্ষা চালান প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। সূত্রের খবর, প্রথম পরীক্ষায় নজরকাড়া পারফরম্যান্স করেছে কৃত্রিম মেধার এলএমজি। প্রতিরক্ষা গবেষকদের দাবি, স্বয়ংক্রিয় হাতিয়ারটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হল নিজে থেকে শত্রুকে চিনে নিয়ে নিমেষে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার ক্ষমতা।
এআই চালিত এই লাইট মেশিনগানের নির্মাণকারী সংস্থার নাম বিএসএস মেটেরিয়াল লিমিটেড। উত্তরাখণ্ডের দেহরাদূনে রয়েছে এদের সদর দফতর। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে এই হাতিয়ারটিকে তৈরি করেছে তারা। এ হেন কৃত্রিম মেধাভিত্তিক এলএমজির পরীক্ষা ১৪ হাজার ফুট উচ্চতায় হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। বাহিনীতে শামিল হওয়ার আগে নেগেভ এলএমজিকে আরও কয়েকটা কঠিন হার্ডল পেরোতে হবে বলে সেনা সূত্রে মিলেছে খবর।
নির্মাণকারী সংস্থাটির দাবি, সংশ্লিষ্ট লাইট মেশিনগানটিতে রয়েছে কৃত্রিম মেধাভিত্তিক মাল্টি সেন্সর। দুর্গম এলাকায় কনভয় এবং ঘাঁটির সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে এর নকশা তৈরি করা হয়েছে। এর সাহায্যে ছোট ড্রোনকেও ধ্বংস করতে পারবে বাহিনী। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, এর স্বয়ংক্রিয় ভাবে শত্রুকে চিনে নেওয়ার দক্ষতা। পাহাড়ের গায়ে লুকিয়ে থাকা সৈনিকদেরও অনায়াসে চিনে নিতে পারে নেগেভ এলএমজি।
নতুন প্রজন্মের হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির দিকে নজর দিয়েছে ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন)। সম্প্রতি এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন এর চেয়ারম্যান সমীর ভি কামাত। তাঁর দাবি, ‘‘আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে তিন থেকে চার শ্রেণির ‘রুদ্রম’ ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীকে উপহার দেব আমরা। আর সেগুলি সবই হবে হাইপারসোনিক ক্ষমতাসম্পন্ন।’’
কোনও বস্তু শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতিশীল হলে, বিজ্ঞানের পরিভাষায় তাঁকে বলে হাইপারসোনিক। বর্তমানে এই প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি দেশের হাতে। সেই তালিকায় আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চিনের নাম। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত কোনও হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে পারেননি। সেই আক্ষেপ চলতি বছরেই মিটিয়ে ফেলা যাবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ডিআরডিওর চেয়ারম্যান।
একটি খবরের চ্যানেলকে দেওয়ার সাক্ষাৎকারে কামাত জানিয়েছেন, বর্তমানে খুব দ্রুত গতিতে ‘রুদ্রম-৩’ ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরির কাজ চলছে। এ বছরের শেষের দিকে এর পরীক্ষা চালানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে ডিআরডিও। যুদ্ধবিমান থেকে নিখুঁত নিশানায় শত্রুর উপর হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে ‘রুদ্রম-৩’-এর নকশা এঁকেছেন প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। সংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্রটি হাইপারসোনিক হতে চলেছে বলে জানা গিয়েছে।
কামাতের দাবি, ‘রুদ্রম’ ১ থেকে ৪ পর্যন্ত মোট চার ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র একসঙ্গে তৈরি করছেন তাঁরা। ফৌজের তিনটি শাখা, অর্থাৎ স্থলসেনা, বায়ুসেনা ও নৌসেনার কথা মাথায় রেখে এগুলিকে নির্মাণ করা হচ্ছে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলি তৈরিতে ভারত ডায়নামিক্স লিমিটেড, ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড এবং আদানি ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেসের সাহায্য নিচ্ছে ডিআরডিও। যদিও ‘রুদ্রম-৩’-এর সর্বোচ্চ গতি কত হবে, তা নিয়ে মুখ খোলেননি গবেষণা সংস্থাটির চেয়ারম্যান কামাত।
‘রুদ্রম’ ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চারের (এমবিআরএল) পাল্লা বৃদ্ধির চেষ্টাও চালাচ্ছে ডিআরডিও। সেই কাজ প্রায় শেষের পথে বলে জানিয়েছেন ডিআরডিও চেয়ারম্যান। তাঁর কথায়, ‘‘বাহিনীর হাতে এ বার আমরা পিনাকা-৩ তুলে দেব। এর রকেটগুলির পাল্লা হবে ১২০ কিলোমিটার। শুধু তা-ই নয়, ২৫০ কেজি বিস্ফোরক নিয়ে উড়ে যাবে নতুন পিনাকার রকেট।’’
ডিআরডিও সূত্রে খবর, এ বছরের একেবারে শেষে বা আগামী বছরের গোড়ায় পিনাকার পরবর্তী ভ্যারিয়েন্টের পরীক্ষা করা হবে। তবে বিপুল সংখ্যায় এর উৎপাদনের জন্য তিন থেকে চার বছর সময় লাগতে পারে। এই সময়সীমার মধ্যে ২৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার পিনাকা-৪ এমবিআরএল তৈরি করে ফেলতে পারেন ভারতের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। কারণ, সেই প্রকল্পের কাজও সমান তালে চলছে বলে জানা গিয়েছে।
সংবাদ সংস্থা এএনআই সূত্রে খবর, ভারতীয় বায়ুসেনার জন্য তিনটে অত্যাধুনিক গুপ্তচর বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। এর জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করবে কেন্দ্রের মোদী সরকার। এ বছরের জুন মাসে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের নেতৃত্বাধীন ‘প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি’ (ডিফেন্স অ্যাকুইজ়িশন কমিটি বা ডিএসি) ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের অন্তর্গত এই পদক্ষেপে আনুষ্ঠানিক ছাড়পত্র দিতে চলেছে বলে জানা গিয়েছে।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর বহরে শামিল হতে চলা গুপ্তচর উড়োজাহাজগুলির পোশাকি নাম ‘ইন্টেলিজেন্স, সার্ভিল্যান্স, টার্গেট অ্যাকুইজ়িশন অ্যান্ড রিকনাইসেন্স’ বা আইস্টার। ‘এয়ার টু গ্রাউন্ড ইন্টেলিজেন্স’ সরবরাহ করার জন্য এগুলিকে তৈরি করা হচ্ছে। সেই তথ্য ব্যবহার করে শত্রুপক্ষের রাডার স্টেশন, এয়ার ডিফেন্স ইউনিটগুলিতে আরও নিখুঁত হামলা চালাতে পারবে ফৌজ।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও-র ‘সেন্টার ফর এয়ারবোর্ন সিস্টেমস’-এর বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই আইস্টারের সফল পরীক্ষা করেছেন। বর্তমানে আমেরিকা, ব্রিটেন, ইজ়রায়েল, রাশিয়া এবং চিনের মতো হাতেগোনা কয়েকটি দেশের কাছে এই ধরনের গুপ্তচর বিমান রয়েছে। এ বার সেই ক্লাব শামিল হবে নয়াদিল্লিও।
এ ছাড়া দেশীয় প্রযুক্তিতে রাশিয়ার ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’-এর মতো উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা এয়ার ডিফেন্স নির্মাণে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে ডিআরডিও। এর জন্য ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড বা বিইএলের সাহায্য নিচ্ছেন প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা ‘যুদ্ধে’ পাকিস্তানের ড্রোন হামলা প্রতিহত করে রাতারাতি নায়ক হয়ে গিয়েছে এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার তৈরি ‘আকাশতির’।
বর্তমানে ডিআরডিও এবং ভারত ইলেকট্রনিক্স কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ‘প্রকল্প কুশ’-এ (পড়ুন প্রজেক্ট কুশ) কাজ করছে। এটি সফল হলে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’-এর সমতুল্য হাতিয়ার পাবে ভারতীয় ফৌজ। অস্ত্রটির একটি নমুনা তৈরি হতে ১২ থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। সব কিছু ঠিক থাকলে ৩৬ মাসের মাথায় গিয়ে এর ট্রায়াল বা পরীক্ষা চালাবে ডিআরডিও। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি।
সূত্রের খবর, ‘প্রকল্প কুশ’-এ প্রতিরক্ষা গবেষকেরা যে হাতিয়ার তৈরি করতে চলেছেন, তা দিয়ে শত্রুর ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র এবং যুদ্ধবিমানকে ধ্বংস করা যাবে। এতে থাকবে দূরপাল্লার ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র (লং রেঞ্জ সারফেস টু এয়ার মিসাইল)। হাতিয়ারটির একাধিক অংশ তৈরি করবে বিইএল। তার মধ্যে রেডার এবং কন্ট্রোল সিস্টেম থাকবে বলে জানা গিয়েছে।
গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পর সিন্ধু জল চুক্তিকে স্থগিত করে ভারত। নয়াদিল্লির এই ‘জল যুদ্ধ’ মোকাবিলা করতে নেমে দিশেহারা হয়ে পড়েছে পাকিস্তান। ভারত সিন্ধুর জল বন্ধ করলে তাকে ‘যুদ্ধ’ বলে বিবেচনা করা হবে বলে হুঁশিয়ার দিয়েছে ইসলামাবাদ। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, সেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির সেনা ও সরকার।
সম্প্রতি মার্কিন সফরে গিয়ে পাক ফেডারেলমন্ত্রী মুসাদিক মালিক বলেন, ‘‘আমাদের কাছে ভাল কোনও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই। বিভিন্ন দেশের থেকে নয়াদিল্লি যে হাতিয়ার কিনেছে, সেগুলি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত। সেই কারণেই আমাদের আর্জি যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক অস্ত্র-প্রযুক্তি আমাদের বিক্রি করুক। সেগুলো আমরা কিনে নেব। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটা আমাদের খুবই প্রয়োজন।’’
সূত্রের খবর, আগামী ১৪ জুন আমেরিকার ‘সেনা দিবস’-এ যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, আগামী দিনে ফের ওয়াশিংটনের থেকে বিপুল পরিমাণে হাতিয়ার কিনতে পারে ইসলামাবাদ। তার আগে ‘জেন জ়েড’ অস্ত্র বাহিনীর হাতে তুলে দিতে পারলে শত্রুর থেকে ভারত যে অনেকটাই এগিয়ে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।