পহেলগাঁও জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করে তলানিতে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তীব্র হচ্ছে সংঘাত। শুধু তা-ই নয়, এর জেরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এসেছে দোলাচল। এই আবহে পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির পরিবারের সদস্যদের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে খবর ছড়াতেই দানা বাঁধল নতুন জল্পনা। যদিও এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে ইসলামাবাদ।
সমাজমাধ্যমে ঝড়ের গতিতে ভাইরাল হওয়া খবর অনুযায়ী, পহেলগাঁও কাণ্ডের বদলার কথা কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার ঘোষণা করতেই ‘থরহরিকম্প’ পাক সেনা অফিসারদের একাংশ। আর তাই এক এক করে পরিবারের সদস্যদের বিদেশ পাঠাচ্ছেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, প্রাণভয়ে নাকি দেশত্যাগী হতে চলেছেন স্বয়ং জেনারেল মুনির। স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য ইউরোপের কোনও দেশ তিনি বেছে নেবেন বলে ওই সমস্ত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
জেনারেল মুনিরকে নিয়ে সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এই সমস্ত খবরের সত্যতা অবশ্য যাচাই করেনি আনন্দবাজার ডট কম। তবে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পাক সেনাপ্রধান বা অফিসারদের বিদেশে স্থায়ী ভাবে বসবাস করার লম্বা ইতিহাস রয়েছে। এ ছাড়া ভিন্দেশে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি কেনার ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। অবসরের পর ইসলামাবাদের ফৌজি জেনারেলদের দেশত্যাগের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ।
দেশভাগের পর গত ৭৮ বছরে মোট চারটি সেনা অভ্যুত্থান দেখেছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদের ফৌজি জেনারেলদের প্রায় কেউই ঘরোয়া রাজনৈতিক ব্যাপারে নাক না গলিয়ে থাকেননি। তাঁদের অঙ্গুলিহেলনেই পরিচালিত হয় সাধারণ নির্বাচন। বিশ্লেষকদের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে কে বসবেন বা বিদেশনীতি এবং অর্থনীতি কী হবে, তার সবটাই ঠিক করে দেন তাঁরা।
এ ছাড়া পাক সেনা অফিসারদের বিরুদ্ধে আমজনতার উপর নির্যাতনের অভিযোগও কম নয়। বালোচিস্তানে বিদ্রোহ দমনের নামে গণহত্যা বা গুমখুনের দাগ রয়েছে জেনারেল টিক্কা খান থেকে শুরু করে একাধিক ফৌজি অফিসারের উর্দিতে। পাশাপাশি, পাহাড়প্রমাণ আর্থিক কেলেঙ্কারিতেও জড়িয়েছেন তাঁরা। সেই কারণে অবসরের পর নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশত্যাগী হন ইসলামাবাদের ফৌজি জেনারেলদের একাংশ।
এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে প্রথমেই জেনারেল পারভেজ মুশারফের কথা বলা যেতে পারে। ১৯৯৮ সালে তাঁকে সেনাপ্রধান হিসাবে নিয়োগ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফ। পরের বছরই (পড়ুন ১৯৯৯ সাল) ভারতের বিরুদ্ধে কার্গিল যুদ্ধে নেমে পর্যুদস্ত হন তিনি। এর পর শরিফ তাঁকে পদ থেকে সরানোর চেষ্টা করলে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন মুশারফ।
২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন মুশারফ। এর পর রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে দেশ ছেড়ে চম্পট দেন সাবেক পাক সেনাপ্রধান। তাঁর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, দমন-পীড়ন এবং বিচার বিভাগকে ঠুঁটো করে রাখার মারাত্মক সব অভিযোগ উঠেছিল। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সংবিধান স্থগিত করেন মুশারফ। এর মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু, জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেও শেষরক্ষা হয়নি। ফলে পাকিস্তান ছেড়ে প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির দুবাই এবং পরে ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনে চলে যান মুশারফ। অন্য দিকে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করে পাক সরকার। পরবর্তী কালে লন্ডন থেকে ফের দুবাই ফেরেন মুশারফ। ২০২৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম এশিয়ার আরব মুলুকটিতে মৃত্যু হয় তাঁর।
একই কথা আশফাক পারভেজ় কায়ানির ক্ষেত্রেও সত্যি। ২০০৭ সালে মুশারফের স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। ২০১৩ সালের ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত সেনাপ্রধান পদে ছিলেন কায়ানি। পাক গুপ্তচর সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্স বা আইএসআইয়ের ডিরেক্টর থেকে ওই পদ পান তিনি।
চাকরিজীবনে বিদেশে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হন কায়ানি। পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের একাংশের দাবি, অস্ট্রেলিয়ার কাছে একটা আস্ত দ্বীপ কিনে সেখানে থাকছেন সাবেক পাক সেনাপ্রধান। যদিও অনেকেই একে অতিরঞ্জিত বলেছেন। তবে অবসরের পর অবশ্য রাওয়ালপিন্ডির অষ্টম সেনাপ্রধানকে আর সে ভাবে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। ফলে সন্দেহ থেকেই গিয়েছে।
সেনাপ্রধান থাকাকালীন প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত একটি জমি কেলেঙ্কারিতে কায়ানির নাম জড়ায়। যাবতীয় অভিযোগ সঙ্গে সঙ্গে উড়িয়ে দেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্য তদন্ত করার সাহস দেখায়নি পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ২০১১ সালে আল-কায়দার শীর্ষনেতা তথা কুখ্যাত জঙ্গি ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে কমান্ডো অপারেশন চালিয়ে নিকেশ করে আমেরিকা। ওই সময় সেনাপ্রধানের কুর্সিতে ছিলেন কায়ানি।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়া। স্ত্রী, পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়স্বজন মিলিয়ে তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১,২৭০ কোটি ডলারের বেশি বলে দাবি করেছিল পাক সংবাদমাধ্যমের একাংশ। অবসরের পর পাকাপাকি ভাবে লন্ডনেই থাকেন ইসলামাবাদের এই সাবেক ফৌজি জেনারেল।
ইতিহাস বলছে, দেশ ছাড়ার পর পাকিস্তানের সেনাপ্রধান বা সেনা অফিসারেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি বা পশ্চিম এশিয়ার অন্য কোনও দেশে স্থায়ী ভাবে পরিবার নিয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করেন। দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা রাশিয়া-সহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে কখনওই বেছে নিতে দেখা যায়নি তাঁদের।
বিশ্লেষকদের দাবি, সৈনিক জীবনে বিদেশনীতিতে ‘নাক গলানো’র কারণে বিশেষ একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন ইসলামাবাদের ফৌজি জেনারেলরা। অবসরের পর বা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সেটাকে কাজে লাগিয়েই পাততাড়ি গোটান তাঁরা। ১৯৪৭ সাল থেকেই পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে এই ধারা বজায় রয়েছে।
মুশারফ, কায়ানি বা বাজওয়ার দেখানো রাস্তায় হেঁটে জেনারেল মুনিরও অবসরের পর পাকিস্তান ছেড়ে পালাবেন কি না, সেটা স্পষ্ট নয়। তবে ভারতের সঙ্গে সংঘাত তীব্র হতেই তিনি রাওয়ালপিন্ডির বাঙ্কারে লুকিয়েছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এই গুজব অবশ্য বেশি দিন টেকেনি। সম্প্রতি হুডখোলা গাড়িতে প্রকাশ্যে এসে বাহিনীর মনোবল বাড়িয়েছেন জেনারেল মুনির।
পাশাপাশি, উত্তেজনার আবহে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে পাকিস্তান। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে ক্ষেপণাস্ত্রটির নাম ‘আবদালি’। পাক ফৌজের ‘সিন্ধু’ নামের মহড়ায় এর সফল উৎক্ষেপণ করা হয় বলে দাবি করেছে তারা।
ইসলামাবাদের এই ক্ষেপণাস্ত্রটি পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম কি না, তা স্পষ্ট নয়। তবে জানা গিয়েছে, এর উৎক্ষেপণের সময় উপস্থিত ছিলেন পাক সেনার বেশ কয়েক জন শীর্ষ পদাধিকারী। এর পাল্লা ৪৫০ কিলোমিটার বলে জানা গিয়েছে। তবে এই ঘটনাকে সীমান্তে প্ররোচনা সৃষ্টির চেষ্টা হিসাবেই দেখছে ভারত।
অন্য দিকে পাকিস্তান থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, সমস্ত আমদানি নিষিদ্ধ করেছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রক জারি করেছে বিজ্ঞপ্তি। জাতীয় নিরাপত্তা এবং সরকারি নীতির স্বার্থে এই নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নিল নয়াদিল্লি। এই নির্দেশিকার কোনও ব্যতিক্রমের জন্য অবশ্যই ভারত সরকারের আগাম অনুমতি নিতে হবে।