India’s Multi Layered Air Defence

পাকিস্তানি ড্রোন শিকারে ‘বুড়ো হাড়ে ভেলকি’! ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’র অস্ত্রে মাঝ-আকাশেই ঠান্ডা ইসলামাবাদের ফন্দি

পাকিস্তানি ড্রোন শিকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’র সময়ে তৈরি হওয়া পুরনো আমলের তিনটি হাতিয়ার। সেগুলির নির্মাণকারী দেশ হল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সুইডেন।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১২ মে ২০২৫ ১৬:০০
Share:
০১ ২১

এ যেন বুড়ো হাড়ে ভেল্কি! ৬৫ বছর বয়সে যুদ্ধের ময়দানে নেমে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স! নিখুঁত নিশানায় একের পর এক ড্রোনকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করল সোভিয়েত জমানার জোড়া হাতিয়ার। রুশ অস্ত্রের এ হেন কার্যকারিতায় মুগ্ধ সাবেক ফৌজি অফিসারেরা। শুধু তা-ই নয়, আগামী দিনে প্রতিরক্ষা চুক্তির ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দের তালিকায় যে ফের মস্কোই থাকবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই তাঁদের।

০২ ২১

জ়ু-২৩এমএম অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্ট বন্দুক এবং জ়েডএসইউ-২৩-৪ শিল্কা। ভারতীয় ফৌজের অস্ত্রাগারে থাকা এই দুই হাতিয়ার যথেষ্টই প্রাচীন। ২১ শতকে নানা ধরনের অত্যাধুনিক ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) হাতে পাওয়ার পরেও সেগুলিকে এখনও বাতিল করেনি সেনা। পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতের পর বাহিনীর এই সিদ্ধান্তকেই ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।

Advertisement
০৩ ২১

গত ৮ এবং ৯ মে রাতে ঝাঁকে ঝাঁকে ড্রোন পাঠিয়ে ভারতের একাধিক বায়ুসেনা ঘাঁটিকে নিশানা করে ইসলামাবাদ। সঙ্গে সঙ্গেই সক্রিয় হয় নয়াদিল্লির ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’। ড্রোনের ঝাঁককে গুলি করে নামাতে পরিত্রাতার ভূমিকা নেয় জ়ু-২৩এমএম অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্ট বন্দুক এবং জ়েডএসইউ-২৩-৪ শিল্কা। পাক ফৌজের পাঠানো একটিও মানববিহীন উড়ুক্কু যানকে ছাউনিতে হামলা করতে দেয়নি ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’র সময়কার এই দুই অতন্দ্র প্রহরী।

০৪ ২১

জ়ু-২৩এমএম অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্ট বন্দুকের জন্ম ১৯৬০ সালে। এর নির্মাণকারী সংস্থা হল কেবিপি ইনস্ট্রুমেন্ট ডিজাইন ব্যুরো। অ্যাঙ্গোলা, লেবানন, ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান অভিযান। একগুচ্ছ ফৌজি অপারেশনে সমান দক্ষতায় কাজ করে গিয়েছে এই হাতিয়ার। লম্বা সময় ধরে এই অস্ত্রটি ব্যবহার করে আসছে ভারতীয় বায়ুসেনাও।

০৫ ২১

জ়ু-২৩এমএম অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্ট বন্দুকে রয়েছে ২৩ মিলিমিটারের দু’টি অটোকামান। এর মাধ্যমে আকাশে ২.৫ কিলোমিটার পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করা যায়। মাটিতে এর পাল্লা দু’কিলোমিটার। মূলত, নিম্ন উচ্চতায় উড়তে থাকা যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টারকে নিশানা করতে এর নকশা তৈরি করেছিলেন সোভিয়েত প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। পরবর্তী কালে তাতে সামান্য অদলবদল হলেও মূলগত ভাবে হাতিয়ারটিতে কোনও বদল আনা হয়নি।

০৬ ২১

জ়ু-২৩এমএমের জন্মের সময়ে বা পরবর্তী দশকগুলিতে দুনিয়ার তাবড় ফৌজি জেনারেলদের ড্রোন যুদ্ধের কোনও ধারণাই ছিল। ফলে অস্ত্রটি যে কখনও মানববিহীন উড়ুক্কু যান ধ্বংসের জন্য ব্যবহার হবে, তা স্বপ্নেও ভাবা হয়নি। কিন্তু বাস্তবে সেটাই করে দেখাল জ়ু-২৩এমএম। পাকিস্তানের পাঠানো সস্তার ‘সোয়ার্ম’ ড্রোনের ঝাঁককে নিমেষে গুলি করে নামিয়েছে সোভিয়েত জমানার এই হাতিয়ার।

০৭ ২১

জ়ু-২৩এমএমের মতোই শিল্কার জন্ম গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে। এর নির্মাণকারী সংস্থার নাম উলিয়ানভস্ক মেকানিক্যাল প্ল্যান্ট। ১৯৬৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্ত সংঘর্ষে প্রথম বার ব্যবহার হয় শিল্কা। এর পর বহু যুদ্ধে যোগ দিয়েছে এই হাতিয়ার। সেই তালিকায় রয়েছে ১৯৯০ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ থেকে শুরু করে গত তিন বছর ধরে ইউক্রেনে চলা রাশিয়ার বিশেষ সৈন্য অভিযান (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন)।

০৮ ২১

উল্লেখ্য, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শিল্কা যে এ বারই প্রথম ভারতীয় ফৌজ ব্যবহার করল, এমনটা নয়। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও রয়েছে সোভিয়েত জমানার এই হাতিয়ারের। তবে এটিকেও ‘ড্রোন কিলার’ হিসাবে তৈরি করেননি রুশ প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। সেই লক্ষ্যে পরবর্তী কালে এই অস্ত্রে বেশ কিছু সংস্কার করা হয়। আর তাই আধুনিক যুগের লড়াইয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিল্কার তেমন কোনও সমস্যা হয়নি।

০৯ ২১

রুশ শিল্কায় রয়েছে চারটি ২৩ মিলিমিটারের কামান। ট্যাঙ্ক আকারের ছোট গাড়ির উপর বসানো থাকে সেগুলি। এ ছাড়া হাতিয়ারটির সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে ২০ কিলোমিটার পাল্লার একটি রেডার। মিনিটে চার হাজার রাউন্ড গুলি ছুড়তে পারে শিল্কা। উন্নত অগ্নি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং প্রক্সিমিটি-ফিউজ় গোলাবারুদ অন্তর্ভুক্ত থাকায় এর শক্তি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তুল্যমূল্য বিচারে জ়ু-২৩এমএমের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী শিল্কা।

১০ ২১

এই দু’টি ছাড়া আরও একটি ‘বুড়ো’ অস্ত্র দিয়ে পাক ফৌজের পাঠানো ড্রোনের ঝাঁককে উড়িয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা। তার নাম এল-৭০। এটি ৪০ মিলিমিটারের বন্দুক। ১৯৫২ সালে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি তৈরি করে সুইডিশ সংস্থা বফোর্স। মিনিটে ২৫০ থেকে ৩৩০ রাউন্ড গুলি ছুড়তে সক্ষম এল-৭০-এর পাল্লা অবশ্য মাত্র চার কিলোমিটার। ইউক্রেন যুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে রুশ ফৌজকে।

১১ ২১

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মূলত যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার ধ্বংস করতে এল-৭০ তৈরি করে সুইডিশ সংস্থা বফোর্স। পরবর্তী কালে বাহিনীতে শামিল করে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটিকে উন্নত করার দিকে মন দেন ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। সেই লক্ষ্যে এতে বসানো হয় রেডার, ইলেকট্রো-অপটিক্যাল সেন্সর এবং অটো-ট্র্যাকিং সিস্টেম। এর জেরেই ‘ড্রোন-কিলার’ হয়ে উঠেছে বফোর্সের এল-৭০।

১২ ২১

সোভিয়েত আমলের এবং সুইডিশ সংস্থার তৈরি ‘বুড়ো’ অস্ত্রগুলিকে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াইয়ে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসাবে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা উল্লেখ করার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। তাঁদের যুক্তি, অত্যন্ত সস্তা দরের ‘সোয়ার্ম’ ড্রোনে ভারতের বায়ুসেনা ঘাঁটিগুলিকে নিশানা করে ইসলামাবাদ। সেগুলিকে নষ্ট করতে এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ বা বারাক-৮-এর মতো অত্যাধুনিক ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ ব্যবহার করলে আর্থিক দিক থেকে অনেকটাই লোকসান হত নয়াদিল্লির।

১৩ ২১

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, পাক ফৌজি জেনারেলরা চেয়েও ছিলেন তাই। সস্তার ‘সোয়ার্ম’ ড্রোন পাঠিয়ে ভারতের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’গুলির অবস্থান বুঝে নিতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু ইসলামাবাদের সেই পাতা ফাঁদে একেবারেই পা দেয়নি এ দেশের বায়ুসেনা। আর তার ষোলো আনা কৃতিত্ব অবশ্যই ‘বুড়ো হাড়ে ভেল্কি’ দেখানো এই তিন হাতিয়ারের।

১৪ ২১

তবে ভারত-পাক সংঘাতে এ-হেন প্রাচীন হাতিয়ারের কামাল করা পারফরম্যান্স নতুন নয়। ২০১৯ সালে ইসলামাবাদের একটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমানকে মাঝ-আকাশের লড়াইয়ে হারিয়ে দেন উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান। সোভিয়েত জমানার পুরনো মিগ-২১ বাইসন লড়াকু জেটের ককপিটে ছিলেন তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও মার্কিন অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানটিকে গুলি করে নামাতে কোনও অসুবিধা হয়নি তাঁর।

১৫ ২১

পাকিস্তানের এফ-১৬ লড়াকু জেট ধ্বংস করতে গিয়ে অবশ্য অভিনন্দনের মিগ-২১ ভেঙে পড়েছিল। তবে ককপিট থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে (পাকিস্তান অকুপায়েড কাশ্মীর বা পিওকে) তাঁকে গ্রেফতার করে ইসলামাবাদের সেনা। পরে অবশ্য নয়াদিল্লির চাপে অভিনন্দনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান।

১৬ ২১

ভারতীয় বায়ুসেনা সূত্রে খবর, ৮ ও ৯ মে পাকিস্তানের ড্রোন হামলা সামলাতে সোভিয়েত আমলের আরও একটি অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। তার নাম ‘পেচোরা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’। ৭০-এর দশক থেকে এটি ব্যবহার করে আসছে এ দেশের বিমানবাহিনী। এতে রয়েছে উন্নত রেডার এবং ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র।

১৭ ২১

‘পেচোরা’র ক্ষেপণাস্ত্রগুলির নাম ভি-৬০০। এতে রয়েছে ৪আর৯০ ইয়াতাগন নামের একটি রেডার ব্যবস্থা। এর মাধ্যমেই লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করে সেখানে আঘাত হানে ‘পেচোরা’। হাতিয়ারটির পাল্লা ৩০-৩৫.৪ কিলোমিটার। ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার উচ্চতায় উড়তে থাকা ড্রোন ও কপ্টারকে নিমেষে ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে এই অস্ত্রের।

১৮ ২১

১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ড্রোন বা কপ্টারকে চিহ্নিত করার ক্ষমতা রয়েছে সোভিয়েত আমলের ‘পেচোরা’র। যুদ্ধের ময়দানে এর সাফল্যের হার ৯২ শতাংশ।

১৯ ২১

কিছু দিনের মধ্যেই ভারত সফরে আসার কথা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। গত বছরের নভেম্বরে মস্কোর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অস্ত্র রফতানিকারক সংস্থা ‘রোজ়োবোরাএক্স’-এর সঙ্গে মউ স্বাক্ষর করে ‘ভারত ডায়নামিক্স লিমিটেড’। সেখানে ‘পন্টসার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’-এর কথা বলা হয়েছে। পুতিনের সফরে এই চুক্তি চূড়ান্ত রূপ পেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

২০ ২১

সমর বিশেষজ্ঞেরা ‘পন্টসার’কে বহুমুখী ও উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলেছেন। এটি বিমান ও ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে বহুস্তরীয় সুরক্ষা দিতে সক্ষম। এতে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও বিমানবিধ্বংসী কামান— এই তিন ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, যা উন্নত রেডার এবং ট্র্যাকিং সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত। ৩৬ কিমি দূর পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুকে শনাক্ত করতে এবং সেগুলিকে ধ্বংস করতে সক্ষম পন্টসার।

২১ ২১

ঘরের মাটিতে ‘পন্টসার’ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। সংশ্লিষ্ট হাতিয়ার বাহিনীতে শামিল হলে হয়তো অবসরে যাবে জ়ু-২৩এমএম, শিল্কা ও এল-৭০। তবে পুরোপুরি ইতিহাসে চলে যাওয়ার আগে যে ভাবে এই তিন অস্ত্র ক্ষমতা প্রদর্শন করল, তা অবশ্যই মনে রাখবে ভারতের সেনাবাহিনী।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement