Russia Germany Conflict

৮৪ বছর পর হিটলারের ‘বারবারোসা’র পুনরাবৃত্তি? রুশ হামলার আতঙ্কে বার্লিন- ফ্রাঙ্কফুর্টে যুদ্ধপ্রস্তুতির দামামা বাজাল জার্মানি!

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাব সত্ত্বেও পূর্ব ইউরোপে থামছে না রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে মস্কোর আক্রমণের ভয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে জার্মানি।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৫ ১৫:৫৩
Share:
০১ ২০

সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে এখনও নেবেনি যুদ্ধের আগুন। তেজ কমা দূরে থাক উল্টে সেই আগুনে পুড়ে খাক হওয়ার আশঙ্কায় কাঁপছে গোটা ইউরোপ! এ-হেন পরিস্থিতিতে ইন্ধন জোগানোর কাজটা শুরু করল জার্মানি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘাতে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বার্লিন। ফলে ইউক্রেন সংঘর্ষ গোটা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে।

০২ ২০

সম্প্রতি জনপ্রিয় মার্কিন গণমাধ্যম ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এ ফাঁস হয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে জার্মানির যুদ্ধপ্রস্তুতির যাবতীয় পরিকল্পনা। বার্লিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের প্রায় ১,২০০ পাতার গোপন নথি প্রকাশ্যে এনেছে তারা। আমেরিকার সংবাদসংস্থাটির দাবি, মস্কোর সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাতের কথা মাথায় রেখে আট লক্ষ সেনার একটা শক্তিশালী ফৌজ গড়ে তুলছে চ্যান্সেলার ফ্রিডরিখ মের্ৎজ়ের সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক জোট ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন’ বা নেটোর পতাকার নীচেই লড়াই করবে তারা।

Advertisement
০৩ ২০

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের আতঙ্কে গত আড়াই বছর ধরে একটি শক্তিশালী ফৌজ তৈরির কাজে হাত লাগিয়েছে জার্মানি। তাদের পরিকল্পনার সাঙ্কেতিক নাম ‘ওপেরাতসিওন প্লান ডয়েচলান্ড’। জার্মান ভাষায় জার্মানিকে বলা হয় ডয়েচলান্ড। মার্কিন গণমাধ্যমটির দাবি, ২০২৫ সালের শেষে পৌঁছে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গতি এনেছেন চ্যান্সেলার ফ্রিডরিখ মের্ৎজ়। কয়েক দিন আগে এই নিয়ে এক্স হ্যান্ডলে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পোস্ট দিয়েছে বার্লিনের বিদেশ মন্ত্রক।

০৪ ২০

জার্মান সরকারের দাবি, ইউক্রেন পুরো দখল হয়ে গেলে নেটো তথা পশ্চিম ইউরোপকে নিশানা করবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই একাধিক গোয়েন্দা রিপোর্ট হাতে এসেছে তাদের। বার্লিনের গুপ্তচরবাহিনীর অনুমান, ২০২৮ বা ২০২৯ সালের মধ্যে আরও আগ্রাসী হবে মস্কো। ওই সময়েই পশ্চিম ইউরোপকে ধ্বংস করার অভিযানে নামবেন পুতিন। সেই কারণেই প্রতিরক্ষামূলক বাহিনী নির্মাণে জোর দেওয়া হচ্ছে।

০৫ ২০

জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী, ‘ওপেরাতসিওন প্লান ডয়েচলান্ড’-এর একাধিক উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, এর মাধ্যমে দেশের সীমান্তেই রুশ ফৌজ়কে আটকে দিতে চাইছে বার্লিন। দ্বিতীয়ত, সংঘাত পরিস্থিতিতে সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, সেই লক্ষ্যেও একাধিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এককথায় কোনও রকমের আগ্রাসনমূলক মনোভাব না দেখিয়ে লড়াইয়ের যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে চাইছেন জার্মানির নেতা-মন্ত্রী থেকে শুরু করে সেনা কমান্ডারেরা।

০৬ ২০

উল্লেখ্য, গত শতাব্দীর ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ (পড়ুন কোল্ড ওয়ার) সময় এই ধরনের সামগ্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল জার্মানি। ওই সময়ে দু’ভাগে বিভক্ত ছিল ইউরোপের এই দেশ। এর পূর্ব দিকের অংশটিকে বলা হত জার্মান ডেমেক্র্যাটিক রিপাবলিক (ডয়েচে ডেমোক্রাটিশে রেপুবলিক)। এর উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া)। ফলে যখন-তখন রুশ আক্রমণের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত পশ্চিম জার্মানি তথা ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানি (বুন্দেশরেপুবলিক ডয়েচলান্ড)।

০৭ ২০

১৯৯০ সালে ফের এক হয়ে যায় দুই জার্মানি। ঠিক তার পরের বছরই পতন হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের। ফলে গত সাড়ে তিন দশকে সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের ভয় অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছিল ডয়েচলান্ড। কিন্তু, ২০২২ সালে পুতিনের নির্দেশে মস্কোর বাহিনী ইউক্রেন দখল করতে ঝাঁপিয়ে পড়লে নতুন দিকে বাঁক নেয় ইউরোপের রাজনীতি। এর জেরে আগ্রাসী ক্রেমলিনকে ঠেকাতে তড়িঘড়ি ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ সময়ের কৌশল পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে বার্লিন।

০৮ ২০

সূত্রের খবর, ‘ওপেরাতসিওন প্লান ডয়েচলান্ড’-এ শুধুমাত্র সামরিক পরিকাঠামোর দিকে নজর রাখা হয়েছে, এমনটা নয়। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমজনতার জীবনরক্ষার বিষয়টিতেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে জার্মান সরকার। পাশাপাশি মেটানো হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক বাধা এবং কর্মী ঘাটতি। ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর সময়কার বহু পুরনো অবকাঠামোকে নতুন করে সাজানোর নির্দেশ দিয়েছে বার্লিন। বলা বাহুল্য এর জেরে সংঘর্ষ প্রস্তুতির পরিকল্পনাটি যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে।

০৯ ২০

এ বছরের সেপ্টেম্বরে হামবুর্গের স্টেট কমান্ডে বড়সড় একটি সামরিক মহড়ার আয়োজন করে জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। এর পোশাকি নাম ছিল ‘রেড স্টর্ম ব্রাভো’। পরে বার্লিনের ফৌজি সদর দফতরের এক সেনা কমান্ডার বলেন, ‘‘ওই মহড়ায় ছিলেন নেটো বাহিনীর সৈনিকরাও। তাঁদের সঙ্গে নিয়ে পূর্ব দিকে কী ভাবে অগ্রসর হওয়া যায়, আমরা সেই অনুশীলন চালিয়েছি।’’ মাত্র দু’ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটারের বেশি পথ এগোনো গিয়েছে বলে স্পষ্ট করেন তিনি।

১০ ২০

জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে, ‘রেড স্টর্ম ব্রাভো’তে বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়েছে ড্রোন এবং আকাশ প্রতিরক্ষা (এয়ার ডিফেন্স) ব্যবস্থা। এ ছা়ড়া ছিল সাঁজোয়া গাড়ি, ট্যাঙ্ক এবং সৈনিক ট্রাকের কনভয়। তবে কামান, লড়াকু জেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র এতে ব্যবহার করা হয়নি। এই ধরনের মহড়া আগামী দিনে আরও বেশি পরিমাণে করা হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে বার্লিন।

১১ ২০

উল্লেখ্য, হামবুর্গের সামরিক মহড়ায় একাধিক বেসরকারি ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণকারী সংস্থাকে শামিল করেছিল জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। সৈনিকদের খাবার, হাতিয়ার ও গোলাবারুদ কী ভাবে সরবরাহ করতে হবে, সেই পাঠ দেওয়া হয় তাদের। পাশাপাশি, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আহত সৈনিকদের চিকিৎসার যাতে কোনও ত্রুটি না হয়, সে দিকেও নজর রেখেছে ‘ওপেরাতসিওন প্লান ডয়েচলান্ড’। সেইমতো হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।

১২ ২০

সংশ্লিষ্ট মহড়ায় হাজির ছিলেন জার্মান ড্রোন সংস্থা ‘কোয়ান্টাম সিস্টেম্‌স’-এর শীর্ষকর্তারা। পরে এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন প্রতিরক্ষা কোম্পানিটির মুখপাত্র পল স্ট্রোবেল। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা দু’টি জিনিসের উপর গুরুত্ব দিচ্ছি। এক, শক্তিশালী ইলেকট্রনিক্স যুদ্ধ পদ্ধতি গড়ে তোলা। এর মাধ্যমে আমরা রুশ ড্রোনগুলিকে দ্রুত চিহ্নিত এবং নষ্ট করতে পারব। আর দ্বিতীয় হল, দূরপাল্লার মানববিহীন উড়ুক্কু যান তৈরি।’’

১৩ ২০

‘কোয়ান্টাম সিস্টেম্স’-এর মুখপাত্র পল মনে করেন, রুশ ফৌজ খুব দ্রুত জার্মান সীমান্তে এগিয়ে এলে তাদের পিছনের সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে ফেলার দরকার হবে। তখনই দূরপাল্লার ড্রোনের প্রয়োজন পড়তে পারে। এর সাহায্যে হাতিয়ার, গোলা-বারুদ বা জ্বালানির ডিপো উড়িয়ে মস্কোর ফৌজের গতি শ্লথ করা যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। প্রসঙ্গত, আগামী বছর থেকে জার্মান সেনায় ড্রোনের বহর বাড়তে চলেছে বলে জানা গিয়েছে।

১৪ ২০

নভেম্বরের মাঝামাঝি ফ্রাঙ্কফুর্টের একটি গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেন জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই ক্রমাগত অস্ত্রাগার বড় করে চলেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। কিভ হাতে পেলেও তিনি শান্ত হবেন বলে মনে হয় না। এখন থেকে প্রস্তুতি না নিলে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, লড়াকু জেট এবং ড্রোনের শক্তিতে মস্কোর সঙ্গে এঁটে ওঠা কঠিন হবে।’’

১৫ ২০

এ প্রসঙ্গে পিস্টোরিয়াস বলেন, ‘‘আমাদের গুপ্তচরেরা ক্রেমলিনের হাঁড়ির খবর জোগাড় করে এনেছেন। পুতিনের পরবর্তী লক্ষ্য নেটোভুক্ত কোনও দেশ। তবে প্রথমেই সেটা জার্মানি হবে, এ কথা বলছি না। হয়তো পোল্যান্ড বা এস্টোনিয়ার উপর এই দুর্ভাগ্য নেমে আসবে। কিন্তু তার পর? উত্তরটা হল অবশ্যই বার্লিন। কারণ তখন তো মস্কোর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকব আমরা।’’

১৬ ২০

ইউরোপের রাজনীতিতে রুশ-জার্মান শত্রুতার লম্বা ইতিহাস রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-’১৮) চলাকালীন ট্যানেনবার্গের লড়াইয়ে মস্কোকে পর্যুদস্ত করে বার্লিন। যদিও জার্মান বাহিনীর আগ্রাসন ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয় ক্রেমলিন। তত দিনে অবশ্য দু’পক্ষেরই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। আর তাই বার্লিনের সঙ্গে সন্ধি করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বাহিনী সরিয়ে নেয় রাশিয়া।

১৭ ২০

২০ শতকে রুশ রাজাকে বলা হত জ়ার। জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধ থামতেই পতন হয় তাঁর শাসনের। ১৯১৭ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে মস্কোর ক্ষমতায় আসেন ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন। তাঁর হাত ধরেই গোড়াপত্তন হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের। ইতিহাসবিদদের কথায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের সঙ্গে লড়াই রুশ বিপ্লবকে তরান্বিত করেছিল।

১৮ ২০

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-’৪৫) সময় ছবিটা ছিল আরও জটিল। লড়াই শুরু হওয়ার আগে মস্কোর সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি করেন জার্মান ফ্যুয়েরার আডল্‌ফ হিটলার। কিন্তু ফ্রান্স দখলের পর সেই সমঝোতা ভেঙে রাশিয়া আক্রমণের নির্দেশ দেন তিনি। ফলে ১৯৪১ সালের ২২ জুন ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে নামে তাঁর নাৎজ়ি বাহিনী, যার পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন বারবারোসা’।

১৯ ২০

কিংবদন্তি ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের রাশিয়া অভিযানের ১২৯ বছর পর একই দিনে মস্কোর লালফৌজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হিটলারের নাৎজ়ি বাহিনী। লড়াইয়ের গোড়ার দিকে সাফল্য পায় তারা। যুদ্ধের প্রথম দিনেই হাজারের বেশি সোভিয়েত যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে জার্মান বায়ুসেনা। পূর্ব রণাঙ্গনে ৩০ লক্ষ সৈনিক এবং ছ’লক্ষ মোটরযান পাঠিয়েছিল বার্লিন। কিন্তু মরণপন লড়াই করে শেষ পর্যন্ত জয় ছিনিয়ে নেয় ক্রেমলিনের লালফৌজ।

২০ ২০

‘অপারেশন বারবারোসা’ ব্যর্থ হতেই পতন হয় হিটলারের। ওই সময়ে বার্লিনে ঢুকে পড়ে রুশ ফৌজ। সেই স্মৃতি এখনও ভোলেনি জার্মানরা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, প্রথম জীবনে মস্কোর গুপ্তচরবাহিনী কেজ়িবির এজেন্ট হিসাবে পূর্ব জার্মানিতে মোতায়েন ছিলেন পুতিন। ফলে তাঁর আগ্রাসন ঠেকানো বার্লিনের পক্ষে মোটেই সহজ হবে না, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement