সারা বছর ধরে বিভিন্ন উপায়ে নিজের বয়স কমানোর হাজারো চেষ্টা চালান তিনি। দীর্ঘ দিন ধরে চলছে সেই প্রচেষ্টা। তার জন্য ঘন ঘন খবরের শিরোনামেও উঠে আসেন। এ বার তাঁর মালিকানাধীন ‘অমরত্বের’ ওষুধ বিক্রির সংস্থা বন্ধ করার সিদ্ধান্তের কারণে আরও এক বার খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন তিনি। কথা হচ্ছে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা তথা ব্যবসায়ী ব্রায়ান জনসনের।
বয়স কমানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার আড়ালে ‘বয়স কমানোর’ ওষুধের ব্যবসা চালাতেন ব্রায়ান। নাম ‘ব্লুপ্রিন্ট’। বিশ্ব জুড়ে চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল সেটি। এ বার হঠাৎ সেই সংস্থা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা করেছেন তিনি।
ব্রায়ান বলেছেন, ‘‘আমি এখন যে কোনও মুহূর্তে সংস্থাটি বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবছি, নয়তো তা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছি। আমার আর টাকা চাই না।’’ কিন্তু কেন এমন ঘোষণা করলেন ব্রায়ান?
জানা গিয়েছে, দার্শনিক চিন্তাভাবনার পরিবর্তনের কারণেই ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ব্রায়ান। দীর্ঘায়ু হতে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ‘ব্লুপ্রিন্ট’ চালু করেছিলেন তিনি।
কিন্তু ব্রায়ান জানিয়েছেন, সংস্থাটিকে নিয়ে তিনি বিরক্ত এবং তাঁর যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটি। তাঁর কথায়, ‘‘এই ব্যবসার জন্য মানুষ আমার দর্শনে বিশ্বাস করছে না। তারা ভাবছে, আমি সবই করছি ব্যবসার জন্য। আমি চাই না, সেই ধারণা তৈরি হোক।’’
বয়স কমানোর জন্য কখনও বদ্ধ ট্যাঙ্কে ৫৪০০ মিনিট কাটিয়ে আবার কখনও নিজের পুত্রের শরীর থেকে প্লাজ়মা টেনে নিয়ে আয়ুবৃদ্ধির চেষ্টা করেছেন ব্রায়ান। পুত্রের যৌবন কাজে লাগানোর জন্য পুরাণের রাজা যযাতির সঙ্গেও তুলনা করা হয় তাঁর। তাঁর সেই প্রচেষ্টা নিয়ে তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র। লেখা হয়েছে বই।
ব্রায়ান অমরত্বে বিশ্বাসী। আর তার জন্যই যৌবন অটুট রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। ‘ব্লুপ্রিন্ট’-এ প্রতি বছরে প্রায় ২০ লক্ষ ডলার খরচ করে যৌবন ধরে রাখার গবেষণা এবং চিকিৎসা চলে। পাশাপাশি ব্রায়ানের সংস্থা মানুষকে বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়া মন্থর করার নানা পণ্যও বিক্রি করে।
তবে সংবাদমাধ্যম এবং মানুষের এত মনোযোগ আকর্ষণ করা সত্ত্বেও সেই ব্যবসা এ বার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ব্রায়ান। এ কালের যযাতির দাবি, মৃত্যুকে অস্বীকার করার তাঁর যে লক্ষ্য, সেই লক্ষ্যের পরিপন্থী হয়ে উঠছে ব্যবসা। অমরত্ব পাওয়ার তাঁর যে চেষ্টা বা দর্শন, তাকেও কলুষিত করছে ব্যবসাটি।
কঠোর খাদ্যনীতি, শত শত পরীক্ষা, এমনকি ‘প্লাজ়মা ট্রান্সফিউশন’ করে বয়স কমানোর জন্য খ্যাতি অর্জন করা ব্রায়ান জানিয়েছেন, ‘ব্লুপ্রিন্ট’ থেকে সরে দার্শনিক চিন্তার উপর বেশি জোর দিতে চান তিনি এবং তাঁর সেই দর্শন হল— ‘ডোন্ট ডাই’ (মোরো না)।
১৯৭৭ সালের ২২ অগস্ট আমেরিকার উটার প্রোভোয় জন্ম ব্রায়ানের। বড় হন স্প্রিংভিলেতে। কৃষক পরিবারের সন্তান ব্রায়ানেরা চার ভাইবোন। তবে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর তিনি মা এবং সৎবাবার সঙ্গে থাকতেন।
১৯ বছর বয়সে ইকুয়েডরে চলে গিয়েছিলেন ব্রায়ান। সেখানে দু’বছর কাটিয়ে আবার আমেরিকায় ফিরে আসেন। আমেরিকায় ফিরে ২০০৩ সালে ব্রিগহাম ইয়ং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। ২০০৭ সালে এমবিএ করেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বুথ স্কুল অফ বিজ়নেস’ থেকে।
২০০৭ সালে ‘ব্রেনট্রি’ নামে একটি সংস্থা শুরু করেছিলেন ব্রায়ান। মোবাইল এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে টাকা লেনদেনকারী সেই সংস্থা শীঘ্রই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বড় বড় অনেক সংস্থা ‘ব্রেনট্রি’র পরিষেবা নিতে শুরু করে।
কিন্তু ২০১৩ সালে সংস্থাটি ‘পেপ্যাল’-এর কাছে ৮০ কোটি ডলারে বিক্রি হয়ে যায়। জনসন আয় করেন প্রায় ৩০ কোটি ডলার। ‘ব্রেনট্রি’ বিক্রির পর বৈজ্ঞানিক উদ্যোগে মন দেন ব্রায়ান।
২০১৬ সালে ‘কার্নেল’ নামে একটি সংস্থা চালু করেন ব্রায়ান। লক্ষ্য ছিল, মস্তিষ্কের কার্যকলাপ, গতিবিধি নজর রাখতে এবং তা রেকর্ড করতে সক্ষম একটি যন্ত্র তৈরি করা।
ব্যবসায়িক উদ্যোগের পাশাপাশি, অমরত্ব লাভ করতে সেই সময় থেকেই নিজের শরীরের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু করেছিলেন ব্রায়ান। সেখান থেকেই ‘ব্লুপ্রিন্ট’-এর শুরু। বার্ষিক ২০ লক্ষ ডলার খরচ করে বয়স কমানোর গবেষণা চালায় সংস্থাটি। ‘বয়স কম করার’ ওষুধও বিক্রি করে।
‘ব্লুপ্রিন্ট’-এ নিরামিষ খাবার এবং দৈনিক ১০০টিরও বেশি বড়ি খাওয়া থেকে শুরু করে ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, যকৃতের চর্বি ও মস্তিষ্কের কার্যকারিতার উপর নজর রাখা হয়। ব্রায়ানের দাবি, ওই পদ্ধতিতেই ৪০ বছর বয়সে ১৮ বছর বয়সির মতো রূপ এবং শরীর অর্জন করেছেন তিনি। বহু সমালোচনা সত্ত্বেও শরীরকে জীবন্ত পরীক্ষাগারের পরিণত করেছেন।
২০২৫ সালের মার্চে ‘ডোন্ট ডাই’ প্রকল্প চালু করেন ব্রায়ান। সেটিকে একটি দার্শনিক ভাবনা হিসাবে চিহ্নিত করেন তিনি। দাবি করেন, বেঁচে থাকাই জীবনের একমাত্র ধর্ম এবং ‘ব্লুপ্রিন্ট’ সেই দর্শনের বিচ্যুতি।
ব্রায়ান মনে করেন, বয়স কমানোর পণ্য বিক্রি করে তাঁর উদ্দেশ্য এবং বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। আর সে কারণেই সংস্থাটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
ব্রায়ান জানিয়েছেন, লাভের জন্য তাঁর দর্শন এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে ব্যবসা করতে চান না তিনি। এ যুগের যযাতির দাবি, মৃত্যুর সঙ্গে মানবতার সম্পর্ক পুনর্গঠনের তাঁর যে লক্ষ্য, ব্যবসার জন্য সেখান থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন তিনি। যদিও বিশেষজ্ঞদের একাংশের অনুমান, ব্রায়ানের ওই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে রয়েছে আর্থিক ক্ষতি।
যদিও সমালোচকদের অনেকে আবার মনে করছেন, ব্রায়ানের বয়স কমানোর সংস্থার সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সম্প্রতি বিশদ রিপোর্ট বেরিয়েছে সংবাদমাধ্যমে। সেই প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে ‘ব্লুপ্রিন্ট’-এর বিক্রি করা ‘বয়স কমানো’র পণ্য নিয়ে। আর তার পরেই ব্রায়ানের ওই ঘোষণা।
‘ব্লুপ্রিন্ট’ বন্ধের পর ব্রায়ানের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক প্রশ্ন উঠে আসতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ী স্পষ্ট করছেন, ‘ব্লুপ্রিন্ট’ সম্পূর্ণ রূপে বিক্রি অথবা বন্ধ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়ে ফেলেছেন তিনি। ভবিষ্যতে তাঁর মনোযোগ হবে ‘ডোন্ট ডাই’ নামে তাঁর দর্শনকে সম্প্রসারিত করার।