‘শুল্ক-খ্যাপা’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সামলাতে পাল্টা চাল দেওয়া শুরু। ধীরে ধীরে যুযুধান চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে ভারত। অন্য দিকে, শত্রুতা সরিয়ে রেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বেজিংও। এই পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘জোঁকের মুখে নুন’ পড়ার শামিল বলে মনে করছেন কূটনীতিকদের একাংশ। যদিও ২০২০ সালের গলওয়ান সংঘর্ষকে মাথায় রেখে ড্রাগনকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা নিয়ে আপত্তি রয়েছে এ দেশের অধিকাংশ প্রাক্তন সেনা অফিসারের।
চলতি বছরের এপ্রিলে ট্রাম্প ‘শুল্কযুদ্ধ’ শুরু করা ইস্তক ভারতের কাছাকাছি আসতে মরিয়া হয়ে ওঠে চিন। এশিয়ায় মার্কিন আধিপত্য ভাঙতে ‘ড্রাগন ও হাতির নাচ’ জরুরি বলেও প্রতীকী শব্দবন্ধ ব্যবহার করে বেজিং। যদিও প্রাথমিক ভাবে সীমান্ত সংঘাতের কারণেই বিষয়টিকে আমল দেয়নি সাউথ ব্লক। কিন্তু, জুলাইয়ে এ দেশের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ কর চাপাতেই ঘুরতে থাকে খেলা। বাণিজ্যিক সম্পর্ক মজবুত করতে উত্তর ও উত্তর-পূর্বের প্রতিবেশীর সঙ্গে আলোচনায় বসেন নয়াদিল্লির কর্তাব্যক্তিরা।
কূটনীতিকদের দাবি, ঠিক এক মাসের মাথায় এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে কেন্দ্র। এত দিন পর্যন্ত ভারতে বিরল খনিজ রফতানি বন্ধ রেখেছিল চিন। কিন্তু, ট্রাম্পের ‘শুল্কবাণ’ ঠেকাতে এ বার সেই দরজা খুলতে রাজি হয়েছে বেজিং। এ ছাড়া রাসায়নিক সার এবং টানেল বোরিং মেশিনও নয়াদিল্লিকে সরবরাহ করবে ড্রাগনভূমির বিভিন্ন সংস্থা। মেট্রো রেলের সম্প্রসারণ এবং পাহাড়ি এলাকায় রাস্তা নির্মাণে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে এই যন্ত্র একান্ত ভাবে প্রয়োজন।
বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম বিরল খনিজের রফতানিকারী দেশ হল চিন। ভারতের আমদানি করা এই খনিজ সম্পদের ৬৬ শতাংশ পাঠায় ড্রাগন সরকার। মাঝে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেটা বেড়ে ৮৫ শতাংশে পৌঁছেছিল। বৈদ্যুতিন গাড়ি থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণা, এমনকি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণেও বিপুল পরিমাণে ব্যবহার হয়ে থাকে এই বিরল খনিজ। ২০২০ সালের পর এর রফতানিতে বেজিং রাশ টানায় বিপাকে পড়ে নয়াদিল্লি। গতি হারায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি।
গত ১৮ অগস্ট ভারত সফরে আসেন চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই। কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এর পরেই বিরল খনিজের রফতানি ফের পূর্ণ গতিতে বেজিং শুরু করবে বলে খবর প্রকাশ্যে আসে। নয়াদিল্লি অবশ্য এই ক্ষেত্রেও ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। বিরল খনিজের ভান্ডার খুঁজে বার করতে ‘জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ বা জিএসআই-কে নির্দেশ দিয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। এর জন্য মোটা টাকা বরাদ্দও করেছে কেন্দ্র।
দ্বিতীয় সাফল্যের জায়গাটি হল রাসায়নিক সার। বিরল খনিজের মতো ভারতের ক্ষেত্রে এটির রফতানিও বন্ধ রেখেছিল চিন। এ দেশের কৃষিতে ডায়মনিয়াম ফসফেটের গুরুত্ব অপরিসীম, যার সিংহভাগই আসত ড্রাগনভূমি থেকে। বেজিংকে বাদ দিলে রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণে সার আমদানি করে নয়াদিল্লি। কিন্তু, মস্কোর দূরত্ব বেশি হওয়ায় এর জন্য খরচ হয় অনেক বেশি। চিনা সারের সরবরাহ ফের শুরু হলে পুজোর মুখে এ দেশের চাষিদের মুখে যে হাসি ফুটবে, তা বলাই বাহুল্য। শীতের ফসলে এর সুফল দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দেশের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক টানেল বোরিং মেশিনের (টিবিএম) বরাত অবশ্য সরাসরি চিনকে দেয়নি নয়াদিল্লি। ভারতকে এই মেশিন সরবরাহ করার কথা রয়েছে জার্মানির। কিন্তু, সমস্যা হল বার্লিনের সংস্থা সংশ্লিষ্ট টিবিএম উৎপাদন করে থাকে ড্রাগনভূমির কারখানায়। এই মেশিন ব্যবহার করে কেন্দ্র সীমান্তবর্তী এলাকায় রাস্তা তৈরি করবে বলে জানতে পেরে এর সরবরাহ বন্ধ করে বেজিং। জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একে বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করেছিল চিন।
সংবাদসংস্থা ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি ড্রাগনভূমিতে বিপুল পরিমাণে ডিজ়েল পাঠিয়েছে গুজরাতের খনিজ তেল পরিশোধন সংস্থা ‘নায়রা এনার্জি’। চলতি বছরের জুলাইয়ে ট্রাম্পের ‘চাপে’ সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ। রাশিয়ার ‘তরল সোনা’ উরাল ক্রুড পরিশোধন করে ইউরোপীয় সংগঠনটির ২৭টি দেশকে বিক্রি করছিল তারা। সেই কারণে নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছে বলে স্পষ্ট করে ইইউ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘নায়রা’র থেকে পরিশোধিত পেট্রোপণ্য কেনা বন্ধ করতেই বিকল্প বাজারের খোঁজে কোমর বেঁধে লেগে পড়ে কেন্দ্রের মোদী সরকার। অন্য দিকে, ইইউয়ের পদক্ষেপকে ‘একতরফা’ এবং ‘প্রতিহিংসামূলক’ বলে কড়া সমালোচনা করেছিল গুজরাতের ওই পরিশোধন সংস্থা। শুধু তা-ই নয়, এই ইস্যুতে আইনি পদক্ষেপের হুঁশিয়ারিও দেয় তারা। তবে মাত্র এক মাসের মধ্যেই চিনের মতো বিশাল বড় একটি বিকল্প বাজারের হদিস যে ‘নায়রা এনার্জি’ পাবে, তা স্বপ্নেও ভাবেনি ২৭ দেশের ওই ইউরোপীয় সংগঠন।
মালবাহী জাহাজের অবস্থান নির্ণায়ক সংস্থা ‘কেপলার’কে উদ্ধৃত করে ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, গত ১৮ জুলাই ‘নায়রা’র টার্মিনাল থেকে চিনের দিকে রওনা হয় ‘ইএম জ়েনিথ’। সংশ্লিষ্ট জলযানটিতে ছিল প্রায় ৪ লক্ষ ৯৬ হাজার ব্যারেল অতি নিম্ন সালফার ডিজ়েল। প্রথমে দক্ষিণ দিকে গিয়ে তার পর পূর্বের মলাক্কা প্রণালী সংলগ্ন মালয়েশিয়ার একটি বন্দরে প্রায় ১২ দিন নোঙর করেছিল ওই জাহাজ। ‘জ়েনিথ’-এর গন্তব্য চিনের ঝোশান বলে জানিয়েছে ওই জনপ্রিয় মার্কিন গণমাধ্যম।
২০২১ সালের এপ্রিলের পর আর কখনওই চিনকে কোনও জ্বালানি সরবরাহ করেনি ভারত। চার বছর পর গুজরাতের সংস্থাটির বেজিংকে ডিজ়েল পাঠানো তাই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন কূটনীতিকদের একাংশ। ‘নায়রা এনার্জি’তে আবার রুশ সংস্থা ‘রসনেফ্ট’-এর ৪৯.১৩ শতাংশ অংশীদারি রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা চাপানোর নেপথ্যে একে সবচেয়ে বড় কারণ বলে জানিয়েছিল ইইউ।
অন্য দিকে, চিনের ‘প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি’ বা এফডিআইয়ের (ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) ক্ষেত্রে কিছুটা নরম অবস্থান নিচ্ছে নয়াদিল্লি। ২০২০ সালের গলওয়ান সংঘর্ষের পর এ দেশে বেজিঙের সংস্থাগুলির বিনিয়োগ নিয়ে কড়াকড়ি শুরু করে কেন্দ্র। গত বছরের এপ্রিলে ড্রাগনভূমির ৫২৬টি এফডিআই আবেদনের মধ্যে মাত্র ১২৪টির অনুমোদন দেয় মোদী সরকার। বাকিগুলির সব ক’টি বাতিল করা হয়। ফলে মান্দারিনভাষীদের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লেগেছিল।
সূত্রের খবর, জুলাইয়ে এই ইস্যুতে কেন্দ্রকে নিজের মতামত জানায় নীতি আয়োগ। সেখানে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে চিনা লগ্নির প্রয়োজনীয়তার কথা বলে তারা। গত আর্থিক বছরে (পড়ুন ২০২৪-’২৫) ভারতে নেট এফডিআই-এ ৯৬.৫ শতাংশের পতন দেখা গিয়েছে। এ দেশের শেয়ার বাজার থেকে মার্কিন এবং ইউরোপীয় বিনিয়োগকারীদের টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। ফলে বেজিং থেকে লগ্নি এলে সেনসেক্স-নিফটির সূচক ফের চাঙ্গা হয়ে উঠবে বলে আশাবাদী নীতি আয়োগ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতীয় সংস্থায় চিনা লগ্নিকারীদের ২৪ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার কেনার অনুমতি দিতে পারে কেন্দ্র। তবে ঘরোয়া প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলিতে প্রযোজ্য হবে না এই নিয়ম। পাশাপাশি, হাতিয়ার নির্মাণের ক্ষেত্রে যাবতীয় সরঞ্জাম বেজিং থেকে আনার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি রাখছে মোদী সরকার। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত নয়, ভারতে এমন পণ্য বিক্রির বাজার পেতে পারে ড্রাগনভূমির একাধিক সংস্থা।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকের পর চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, ‘‘আমাদের একে অপরকে প্রতিপক্ষ হিসাবে না দেখে অংশীদার মনে করা উচিত।’’ কেন্দ্রও বলেছে, দু’তরফই সম্পর্কের শীতলতা কাটিয়ে ‘ইতিবাচক’ দিকে এগোচ্ছে। একটি বিবৃতিতে জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘‘কঠিন সময় পেরিয়ে আমরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।’’
চিন অধিকৃত তিব্বতে কৈলাস-মানস সরোবর যাত্রা গলওয়ান সংঘর্ষের পর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ড্রাগন সরকার আবার সেই যাত্রা অনুমতি দিয়েছে। খুব শীঘ্রই নয়াদিল্লি ও বেজিঙের মধ্যে সরাসরি উড়ান পরিষেবা চালু হওয়ার কথাও রয়েছে। এ বছরের ৩১ অগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চিনের তিয়ানজ়িনে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিও-র (সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজ়েশন) বৈঠকে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সেখানে ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হতে পারে তাঁর। যদিও সরকারি ভাবে বিষয়টিকে নিশ্চিত করা হয়নি।
এসসিও ছাড়াও ব্রিকস গোষ্ঠীর সদস্যপদ রয়েছে ভারত ও চিনের। এ বছর কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭৫ বছর পূর্তি পালন করেছে দুই দেশ। নয়াদিল্লি ও বেজিঙের বাণিজ্যিক সম্পর্ক মজবুত হওয়ার ক্ষেত্রে কাঁটা একটি জায়গাতেই। সেটা হল সীমান্তসংঘাত। মাঝেমধ্যেই লাদাখ, সিকিম এবং অরুণাচল প্রদেশকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে থাকে ড্রাগন সরকার। আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা তৈরি করা নিয়েও অনীহা রয়েছে মান্দারিনভাষীদের।
১৯৬২ সালের যুদ্ধে ‘আকসাই চিন’ এলাকাটিকে দখল করে বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ। ২০২০ সালে পূর্ব লাদাখের ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ বা এলওসি-তে (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) আগ্রাসী মনোভাব দেখায় ড্রাগনভূমির লালফৌজ। তাঁদের অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারান ভারতীয় সেনার কর্নেল বি সন্তোষ বাবু-সহ ২০ জন জওয়ান। সূত্রের খবর, পাল্টা প্রত্যাঘাতে পিএলএ-র অন্তত ৪০ জন সৈনিকের মৃত্যু হয়। যদিও তা মানতে চায়নি বেজিং।
চলতি বছরের মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ বাধলে সরাসরি ইসলামাবাদকে সাহায্য করে চিন। কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক তথ্য থেকে শুরু করে হাতিয়ার সরবরাহ— কোনও কিছুতেই পিছিয়ে ছিল না বেজিং। ফলে ট্রাম্পের সঙ্গে শুল্কসংঘাতে এ সমস্ত কিছু ভুলে গেলে চলবে না, সতর্ক করেছেন সাবেক সেনাকর্তারা।
বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিম পাক প্রদেশের বালুচিস্তান থেকে খনিজ সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার ছক কষছেন ট্রাম্প। এর জন্য ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের সঙ্গে মাখামাখি শুরু করেছেন তিনি। ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে চিনের। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জন্য ওই এলাকা ছাড়তে হতে পারে ড্রাগনকে। আর তাই বেগতিক বুঝে নয়াদিল্লির কাছাকাছি আসছে ‘চালবাজ’ বেজিং, বলছেন বিশ্লেষকেরা।