পশ্চিমে পাকিস্তানে। উত্তর-পূর্বে চিন। জোড়া শত্রুর ঘেরাটোপে থেকে ফের ‘বন্ধু’ ইজ়রায়েলকে পাশে পাচ্ছে ভারত। নয়াদিল্লির বিমানবাহিনীর হাতে এ বার লরা ক্ষেপণাস্ত্র তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ইহুদিদের। এই অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধের সময় শত্রুকে পুরোপুরি ‘অন্ধ’ করে ফেলতে পারবে ভারতীয় বায়ুসেনা। এই খবরে ঘুম উড়েছে ইসলামাবাদ ও বেজিঙের।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, চলতি বছরের গোড়ায় ইহুদিদের থেকে লরা ক্ষেপণাস্ত্র কেনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে ভারতীয় বায়ুসেনা। সংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্রটির নির্মাণকারী সংস্থার নাম ‘ইজ়রায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ়’ বা আইএআই। নয়াদিল্লির কাছে এটিকে ঘরের মাটিতে তৈরি করার সুযোগ রয়েছে। লরার পুরো কথাটি হল ‘লং রেঞ্জ আর্টিলারি’। ইহুদিদের এই ক্ষেপণাস্ত্রটির একাধিক শ্রেণিবিভাগ রয়েছে।
ভারতীয় বিমানবাহিনী ইজ়রায়েলের থেকে যে হাতিয়ারটি কিনতে চাইছে তার পোশাকি নাম এয়ার লরা। একে ছোড়ার জন্য প্রয়োজন যুদ্ধবিমানের। বিশেষজ্ঞদের দাবি, মূলত শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে উড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এর নকশা তৈরি করেছেন ইহুদি গবেষকেরা। অর্থাৎ, এর ব্যবহারে লড়াইয়ের গোড়াতেই চিন বা পাকিস্তানের আকাশ দখল করার সুযোগ পেয়ে যাবে ভারতীয় বায়ুসেনা।
ক্ষেপণাস্ত্রটির নির্মাণকারী সংস্থা ‘ইজ়রায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ়’-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, লরার পাল্লা ৪০০ থেকে ৪৩০ কিলোমিটার। একে সুপারসনিক আধা ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বলা যেতে পারে। শব্দের পাঁচ গুণ গতিতে (পড়ুন পাঁচ ম্যাক) ছুটতে পারে ইহুদিদের লরা। ৫৭০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক নিয়ে নিখুঁত নিশানায় হামলা করতে সক্ষম সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র। এর মোট ওজন ১,৬০০ কেজি এবং দৈর্ঘ্য ৫.২ মিটার।
ইজ়রায়েলের এই ক্ষেপণাস্ত্রে দ্বৈত দিক নির্ণয়ের ক্ষমতা রয়েছে। গ্লোবাল পজ়িশনিং সিস্টেম (জিপিএস) এবং ইনার্শিয়াল নেভিগেশন সিস্টেম (আইএনএস) মেনে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বেছে নেয় ইহুদিদের লরা। অত্যাধুনিক হাতিয়ারটিতে অ্যান্টি-জ্যামিং প্রযুক্তি থাকায় ইলেকট্রনিক যুদ্ধে একে কাবু করা সম্ভব নয়। বিমানঘাঁটি, কমান্ড সেন্টার, রণতরী, স্থলবাহিনীর বাঙ্কার এবং সেতুর মতো কৌশলগত সামরিক সম্পদ ধ্বংস করতে সিদ্ধহস্ত ইজ়রায়েলের তৈরি লরা ক্ষেপণাস্ত্র। ইজ়রায়েলের এই ক্ষেপণাস্ত্রে দ্বৈত দিক নির্ণয়ের ক্ষমতা রয়েছে। গ্লোবাল পজ়িশনিং সিস্টেম (জিপিএস) এবং ইনার্শিয়াল নেভিগেশন সিস্টেম (আইএনএস) মেনে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বেছে নেয় ইহুদিদের লরা। অত্যাধুনিক হাতিয়ারটিতে অ্যান্টি-জ্যামিং প্রযুক্তি থাকায় ইলেকট্রনিক যুদ্ধে একে কাবু করা সম্ভব নয়। বিমানঘাঁটি, কমান্ড সেন্টার, রণতরী, স্থলবাহিনীর বাঙ্কার এবং সেতুর মতো কৌশলগত সামরিক সম্পদ ধ্বংস করতে সিদ্ধহস্ত ইজ়রায়েলের তৈরি লরা ক্ষেপণাস্ত্র।
ইহুদিদের তৈরি মারণাস্ত্রটির আরও কিছু সুবিধা রয়েছে। এতে ক্রুজ় এবং ব্যালেস্টিক দু’ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রেরই কিছু কিছু করে বৈশিষ্ট্য রয়েছে। হাতিয়ারটিকে ‘ফায়ার অ্যান্ড ফরগেট’ মোডে চালাতে হয়। অর্থাৎ, এক বার ছোড়়ার পর আর থামানোর কোনও উপায় নেই। তবে লক্ষ্যের দিকে ছুটে যাওয়ার সময়ে লরাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া যাবে। লক্ষ্যবস্তু নিজের জায়গা থেকে অন্যত্র সরে গেলে তাকে তাড়া করে ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে ইজ়রায়েলি লরার।
এ-হেন বিপজ্জনক ক্ষেপণাস্ত্রটিকে পছন্দ করার নেপথ্যে ভারতীয় বায়ুসেনার একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, এ দেশের বিমানবাহিনী সর্বাধিক ব্যবহার করে রাশিয়ার তৈরি এসইউ-৩০ এমকেআই নামের লড়াকু জেট। সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটি চারটি করে লরা ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে সক্ষম। অর্থাৎ, ইহুদিদের মারণাস্ত্র হাতে পেলে একাধিক লক্ষ্যবস্তুকে একসঙ্গে ধ্বংস করতে পারবে বায়ুসেনা।
বর্তমানে ভারতীয় ফৌজের অস্ত্রগারে রয়েছে ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র। রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি তৈরি করেছে নয়াদিল্লি। সূত্রের খবর, গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ চলাকালীন এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে পাকিস্তানের নুর খান-সহ একাধিক বিমানঘাঁটিকে ধ্বংস করে এ দেশের বাহিনী। তা সত্ত্বেও লরা কেন প্রয়োজন, তা অবশ্য ইতিমধ্যেই ব্যাখ্যা করেছেন সাবেক সেনাকর্তারা।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ব্রহ্মসের সঙ্গে লরার কিছু মূলগত পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, গতির নিরিখে অনেকটাই এগিয়ে আছে ইহুদিদের এই ক্ষেপণাস্ত্র। পাল্লার দিক থেকে আবার ব্রহ্মসের শক্তি বেশি। তবে রুশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে তৈরি ক্ষেপণাস্ত্রটির নকশা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য করা হয়নি। বরং এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়ে শত্রুব্যূহে ঢুকে হামলা চালানোই সংশ্লিষ্ট ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রটির মূল বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, লরা হাতে পেলে চিন বা পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে সীমান্তের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না ভারতীয় বায়ুসেনার। এ দেশের আকাশসীমার মধ্যে থেকেই শত্রুর উপর আক্রমণ শানাতে পারবে ফৌজ।
২০১৮ সালে ইজ়রায়েলের থেকে লরা ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বিষয়টি প্রকাশ্যে আনে মধ্য এশিয়ার দেশ আজারবাইজ়ান। তবে সেটা ক্ষেপণাস্ত্রটির ‘এয়ার ভার্সান’ ছিল না। সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি চলে যায় বাকুর স্থলবাহিনীর অস্ত্রাগারে। এর ঠিক দু’বছরের মাথায় (পড়ুন ২০২০) বিতর্কিত নাগোরনো-কারাবাখকে কব্জা করতে প্রতিবেশী আর্মেনিয়াকে আক্রমণ করে আজারবাইজ়ান। সেই যুদ্ধে নিজের জাত চিনিয়েছিল লরা।
২০২০ সালের নাগোরনো-কারাবাখের যুদ্ধের একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে আর্মেনিয়ার লাচিন করিডোরের একটি সেতুকে উড়িয়ে দিতে ইহুদিদের তৈরি ক্ষেপণাস্ত্রটি ব্যবহার করে বাকুর স্থলবাহিনী। চোখের নিমেষে সেতুটি উড়ে যাওয়ায় আর্মেনীয় সেনাদল রণক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কৌশলগত অবস্থান নিতে পারেনি। ফলে হার মানতে হয় তাদের।
গত ১৩ জুন ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলিকে নিশানা করে ইহুদি বিমানবাহিনী। ইজ়রায়েলের অভিযোগ ছিল, ওই গুপ্তঘাঁটিগুলিতে আণবিক হাতিয়ার তৈরি করছে তেহরান, যা তাঁদের অস্তিত্বের সঙ্কট ডেকে আনবে। এই অভিযানের নাম ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’ রাখে তেল আভিভ। এর গোড়াতেই সাবেক পারস্য দেশের আকাশ দখলের পরিকল্পনা ছিল ইহুদি বায়ুসেনার।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, এই কাজে ১০০ শতাংশ সাফল্য পায় ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। সূত্রের খবর, বেছে বেছে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলিকে ধ্বংস করতে লরাকে কাজে লাগায় ইহুদি বিমানবাহিনী। ফলে তেহরানের আকাশে বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াতে পেরেছে তাদের লড়াকু জেট। সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার পরই সংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্র নিয়ে আরও বেশি আগ্রহী হয় ভারত।
২০২৩ সালের জুনে ‘অ্যারো ইন্ডিয়া’ প্রদর্শনীতে লরাকে নয়াদিল্লির সামনে তুলে ধরে ইজ়রায়েল। তখন থেকেই সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটি নিয়ে ইহুদিদের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে নয়াদিল্লি। ওই বছর লরার নির্মাণকারী সংস্থা ‘ইজ়রায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ়’-এর সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক বা এমওইউ (মেমরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং) সই করে এ দেশের হাতিয়ার নির্মাণকারী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভারত ইলেকট্রনিক্স।
লরাকে নিয়ে নয়াদিল্লির ওই সিদ্ধান্তকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। ওই মউ চুক্তির ফলে ভারতের মাটিতেই ক্ষেপণাস্ত্রটিকে তৈরির লাইসেন্স রয়েছে ভারত ইলেকট্রনিক্সের কাছে। এর প্রতিটি ইউনিটের খবর ১০ থেকে ৫০ লক্ষ ডলার পর্যন্ত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
দেশের মাটিতে লরাকে তৈরি করার ক্ষেত্রে ভারতের আরও একটি স্বার্থ রয়েছে। ইজ়রায়েলের সঙ্গে মিলে ভবিষ্যতে এই ক্ষেপণাস্ত্রটিকে রফতানি করার পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। সেই মর্মেই ইহুদিদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলতে চাইছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। চলতি বছরের শেষের দিকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে দুই দেশ, খবর সূত্রের।
তবে লরা হাতে পেলেও ব্রহ্মসকে বাতিল করছে না ভারতীয় বায়ুসেনা। বরং বাহিনীর উদ্দেশ্য হাতিয়ারের ক্ষেত্রে বৈচিত্র নিয়ে আসা। এর আগেও ইজ়রায়েলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে স্কাইস্ট্রাইকার নামে আত্মঘাতী ড্রোন এবং বারাক-৮ নামের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছে নয়াদিল্লি। সেই তালিকায় লং রেঞ্জ আর্টিলারি ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত হওয়া এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা বলছেন বিশ্লেষকেরা।