চোখের নিমেষে যুদ্ধের রং বদলাতে ক্রমাগত ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তি বৃদ্ধি করছে ভারত। সেই লক্ষ্যে এ বার বড় লাফ দিল কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন)। ‘প্রলয়’ ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ‘এয়ার ভার্সান’ তৈরিতে হাত দিয়েছে তারা। ভারতীয় বিমানবাহিনীর শিরদাঁড়া হিসাবে পরিচিত রুশ লড়াকু জেট ‘এসইউ-৩০ এমকেআই’ থেকে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটিকে ছোড়া যাবে বলে জানা গিয়েছে। তবে তার জন্য একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে ডিআরডিও-র বিজ্ঞানীদের।
এ দেশের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা ‘প্রলয়’ ক্ষেপণাস্ত্রের যে ‘এয়ার ভার্সান’ তৈরি করতে চলেছেন, তার দৈর্ঘ্য হবে ৯.০৬ মিটার। ওজন দাঁড়াতে পারে প্রায় পাঁচ টন। এতটা ভারী ক্ষেপণাস্ত্রকে ‘এসইউ-৩০ এমকেআই’ যুদ্ধবিমানের লঞ্চারে বসানো যে বেশ কঠিন হবে, তা বলাই বাহুল্য। কারণ, সংশ্লিষ্ট জেটটির দৈর্ঘ্য মেরেকেটে ২২ মিটার বলে জানা গিয়েছে। বর্তমানে এই ব্যারিকেড টপকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে ডিআরডিও।
সাবেক সেনাকর্তারা জানিয়েছেন, যুদ্ধবিমান থেকে ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া বেশ কঠিন। বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশের কাছে রয়েছে এই প্রযুক্তি। ‘প্রলয়’-এর এয়ার ভার্সান তৈরিতে সাফল্য এলে সেই সক্ষমতা অর্জন করবে ভারত। এ দেশের বিমানবাহিনী অবশ্য লড়াকু জেট থেকে ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রে হামলা করতে বেশ দক্ষ। যদিও যুদ্ধবিমান থেকে নিখুঁত নিশানায় শত্রুর উপরে ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কৌশল তার চেয়ে অনেকটাই আলাদা।
২০১৫ সালে ‘প্রলয়’ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কাজে হাত দেয় ডিআরডিও। প্রাথমিক ভাবে এই প্রকল্পে ৩৩২.৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করে কেন্দ্র। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির সফল পরীক্ষা করেন এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। এর মাধ্যমে ‘ভূমি থেকে ভূমি’তে (পড়ুন সারফেস টু সারফেস) আক্রমণ করতে পারবে ভারতের স্থলসেনা। ২০২৩ এবং ২০২৫ সালে আরও দু’বার ‘প্রলয়’ ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায় এ দেশের ফৌজ এবং ডিআরডিও।
বর্তমানে ভারতীয় সেনার ক্ষেপণাস্ত্রের বহরে শামিল হয়েছে ‘প্রলয়’। ১৫০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরের শত্রুঘাঁটি ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে এই মারণাস্ত্রের। ৫০০ থেকে হাজার কেজি পর্যন্ত বিস্ফোরক বহন করতে পারে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তির এই ক্ষেপণাস্ত্র। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ একে আধা-ব্যালেস্টিক গোত্রের ব্রহ্মাস্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। ‘হাইপারসনিক’ গতিতে (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি) ছোটার ক্ষমতা রয়েছে ডিআরডিও-র ‘প্রলয়’-এর।
সূত্রের খবর, সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ৬.১ ম্যাক। অর্থাৎ, শব্দের চেয়ে ৬.১ গুণ বেশি গতিতে উড়ে গিয়ে শত্রুঘাঁটিতে আছড়ে পড়ার ক্ষমতা রয়েছে ‘প্রলয়’-এর। বিশ্লেষকদের দাবি, ক্ষেপণাস্ত্রটির ‘এয়ার ভার্সান’ তৈরি করতে হলে কমাতে হবে ওজন। কারণ, সর্বোচ্চ আট টন পর্যন্ত ওজন নিয়ে উড়তে পারে ‘এসইউ-৩০ এমকেআই’ লড়াকু জেট। পাঁচ টনের ‘প্রলয়’কে নিয়ে আক্রমণের সময়ে মাঝ-আকাশে ডগফাইটে সমস্যা হবে যোদ্ধা পাইলটের। সে ক্ষেত্রে উল্টে শত্রুর ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র বা গুলির শিকার হতে পারেন তিনি।
‘এসইউ-৩০ এমকেআই’তে যে ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়, তার ওজন ২.৫ টন। সংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্রের চেয়ে ‘প্রলয়’-এর দৈর্ঘ্য এবং ওজন— দুটোই বেশি। আর তাই এর ‘এয়ার ভার্সানে’ ক্ষেপণাস্ত্রটির ভিতরে একাধিক পরিবর্তন করতে হবে ডিআরডিও-কে। প্রপালশন সিস্টেম এবং গাইডেন্স ইলেক্ট্রনিক্সে বদলের প্রয়োজন রয়েছে, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
যুদ্ধবিমানের উপযোগী হিসাবে ‘প্রলয়’কে তৈরি করতে এর নকশাতেও আনতে হবে বড় বদল। সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির আকার লড়াকু জেটে ব্যবহারের মতো নয়। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, নকশার পাশাপাশি এর ভরকেন্দ্র পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে। নইলে ছোড়ার সময় ‘প্রলয়’ যে শক্তি উৎপন্ন করবে, তা সামলাতে গিয়ে ধ্বংস হতে পারে যুদ্ধবিমানও। এই চ্যালেঞ্জ টপকাতে বর্তমানে কোমর বেঁধে লেগে প়ড়েছেন ডিআরডিও-র বিজ্ঞানীরা।
রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য কয়েক বছর আগে ‘এসইউ-৩০ এমকেআই’ যুদ্ধবিমানে বেশ কিছু বদল করেন এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। এই পরিস্থিতিতে ফের ‘প্রলয়’-এর জন্য ওই লড়াকু জেটগুলিতে পরিবর্তন আনা বেশ কঠিন। সে ক্ষেত্রে এর জ্বালানি নেওয়ার পরিমাণ এবং মাঝ-আকাশে কসরত দেখানোর সক্ষমতা অনেকটা হ্রাস পেতে পারে, যা চাইছে না ভারতীয় বায়ুসেনা।
দ্বিতীয়ত, ‘প্রলয়’-এর জন্য ‘এসইউ-৩০ এমকেআই’ যুদ্ধবিমানে পরিবর্তন করতে হলে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করতে হবে কেন্দ্রকে। বর্তমানে লড়াকু জেটের সঙ্কটে ভুগছে ভারতীয় বিমানবাহিনী। এই পরিস্থিতিতে পুরনো যুদ্ধবিমানের জন্য মোটা টাকা খরচ করতে রাজি না-ও হতে পারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
১৯৯৭ সালে ভারতীয় বায়ুসেনার বহরে শামিল হয় ‘এসইউ-৩০ এমকেআই’। রাশিয়ার জনপ্রিয় প্রতিরক্ষা সংস্থা সুখোইয়ের নকশায় তৈরি সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোভুক্ত (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) দেশগুলি চেনে ‘ফ্ল্যাঙ্কার-এইচ’ নামে। প্রথম পর্যায়ে এই যুদ্ধবিমান নয়াদিল্লিকে সরবরাহ করেছিল মস্কো। পরে এর নির্মাণের লাইসেন্স ‘হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড’ বা হ্যালকে দেয় ক্রেমলিন।
রুশ প্রতিরক্ষা সংস্থা সুখোই প্রযুক্তি হস্তান্তরের পর ঘরের মাটিতে ‘এসইউ-৩০ এমকেআই’ তৈরি করা শুরু করে কেন্দ্র। তবে এর ইঞ্জিন-সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ নির্মাণের অনুমতি হ্যালকে দেয়নি মস্কো। চুক্তিমাফিক পরবর্তী দশকগুলিতে নয়াদিল্লিকে সেগুলি সরাসরি সরবরাহ করে গিয়েছে ক্রেমলিন। ফলে ইঞ্জিন-সহ সংশ্লিষ্ট যন্ত্রাংশ জুড়ে এ দেশের কারখানায় সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটির নির্মাণে সে ভাবে সমস্যার মুখে পড়েনি হ্যাল।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ২৭২টি ‘এসইউ-৩০ এমকেআই’ হাতে পেয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা। দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট এই যুদ্ধবিমানকে একাধিক কাজে ব্যবহার করে থাকে এ দেশের বিমানবাহিনী। চলতি বছরে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা পাকিস্তানের সঙ্গে ‘যুদ্ধে’ সংশ্লিষ্ট জেটটি ব্যবহার হয়েছে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর।
‘প্রলয়’ ছাড়াও এ বছরের অগস্টে আরও একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করবে ডিআরডিও। এর জন্য ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় সতর্কতামূলক ‘নোটিস টু এয়ার মিশন’ বা নোটাম জারি করেছে কেন্দ্র। ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার সময় বিমান চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সেই জন্যেই আগাম সতর্কতা হিসাবে এই নোটাম জারি করার নিয়ম রয়েছে। নয়াদিল্লি নোটামের এলাকা বৃদ্ধি করায় হাতিয়ারটির পাল্লা নিয়ে ইতিমধ্যেই তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
‘ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স’-এর বিশ্লেষক ড্যামিয়েন সাইমন জানিয়েছেন, প্রথমে নোটামে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় ২,৫৩০ কিলোমিটারের কথা বলেছিল নয়াদিল্লি। কিন্তু পরে পাল্লা বাড়িয়ে সেটা করা হয় ৪,৭৯০ কিলোমিটার। ২০ থেকে ২১ অগস্ট পর্যন্ত এই সতর্কতা জারি থাকবে বলে জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, ওই দু’দিনে ‘অগ্নি-৬’ আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ইন্টার-কন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল) পরীক্ষা করতে পারে ডিআরডিও। এর সর্বোচ্চ পাল্লা আট থেকে ১২ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির গতিবেগ ২১ ম্যাক হবে বলে ইতিমধ্যেই দাবি করেছে একাধিক গণমাধ্যম। বর্তমানে আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিন ছাড়া আর কোনও দেশের কাছে পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম এতটা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নেই।
কেউ কেউ আবার মনে করেন ওই দু’দিনে বর্ধিত পাল্লার ‘ব্রহ্মস’ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা করবে ভারত। বর্তমানে ৩৫০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরের শত্রু ঘাঁটি ধ্বংস করতে পারে এই ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র। সেটা বাড়িয়ে ৮০০ কিলোমিটার করতে চলেছেন এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। আগামী দিনে ‘ব্রহ্মস’কে হাইপারসনিক গতিসম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। তবে এ ব্যাপারে রাশিয়ার অনুমতির প্রয়োজন হবে কেন্দ্রের।
বিশ্বের দ্রুততম ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের বর্তমান গতিবেগ ৪ ম্যাক। অর্থাৎ, ঘণ্টায় ৪,৯০০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে এই মারণাস্ত্র। ব্রহ্মসের দ্বিতীয় বিশেষত্ব হল স্থল, যুদ্ধবিমান এবং রণতরী— তিনটি জায়গা থেকেই একে শত্রুর উপরে ছুড়়তে পারে সেনা। এর ডুবোজাহাজ শ্রেণিও রয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রটি হাইপারসনিক স্তরে উন্নীত হলে এর গতিবেগ দাঁড়াবে ৮ ম্যাক, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
সূত্রের খবর, যাবতীয় চ্যালেঞ্জ টপকে ২০২৮ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে ‘প্রলয়’ ক্ষেপণাস্ত্রের ‘এয়ার ভার্সান’ তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে ডিআরডিও। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার হাতে যুদ্ধবিমান থেকে হাইপারসনিক ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার প্রযুক্তি রয়েছে। ওয়াশিংটনের হাতিয়ারটির পোশাকি নাম ‘এয়ার টু গ্রাউন্ড মিসাইল-১৩৬ ট্যাকটিক রেনবো’। মস্কোর একই প্রজাতির অস্ত্রটিকে দুনিয়া চেনে ‘কিনজ়েল’ হিসাবে। ইউক্রেন যুদ্ধে এটি ব্যবহার করেছে ক্রেমলিনের ফৌজ।