India’s Oil Reserve

সঙ্কটে বহু দিন পর্যন্ত মিলবে জ্বালানি! হঠাৎ ‘তরল সোনা’র বিরাট ভান্ডার গড়ছে ভারত, কোন বিপদের আশঙ্কায়?

আপৎকালীন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে জ্বালানি নিরাপত্তায় ‘তরল সোনা’র বিরাট মজুত ভান্ডার গড়ে তুলছে ভারত। অন্তত ৯০ দিনের অপরিশোধিত তেল সংরক্ষণের ব্যবস্থা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। বর্তমানে ৯-১০ দিনের তেল মজুত রাখতে পারে কেন্দ্র।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৫ ১৪:৫৯
Share:
০১ ২০

কখনও পশ্চিম এশিয়া। কখনও আবার পূর্ব ইউরোপ। কিংবা ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা। গত কয়েক বছরে বার বার অস্থির হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত। শুধু তা-ই নয়, সীমান্ত সংঘাত থেকে শুরু করে নানা ইস্যুতে সরাসরি যুদ্ধ বেধে যাওয়ার ঘটনাও কম ঘটেনি। এর আঁচ সবচেয়ে বেশি পড়েছে জ্বালানি অর্থনীতিতে। আর তাই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ‘তরল সোনা’ মজুতে এ বার জোর দিল ভারত। কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের ‘সুফল’ যে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে মিলবে, তা বলাই বাহুল্য।

০২ ২০

বিশেষজ্ঞদের দাবি, যুদ্ধের সময়ে সামরিক এবং আর্থিক দিক থেকে বাঁচতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জ্বালানির। পেট্রল-ডিজেলের জোগান ঠিকমতো না হলে রণাঙ্গনে এক চুলও এগোতে-পিছোতে পারবে না ফৌজ। অন্য দিকে, ‘তরল সোনা’র অভাবে শিল্প উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হলে দু’দিনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে অর্থনীতি। সেটা বুঝতে পেরেই বর্তমান সময়ে অপরিশোধিত তেল মজুতের বিশাল ভান্ডার গড়ে তুলেছে আমেরিকা-সহ বিশ্বের তাবড় ‘সুপার পাওয়ার’ দেশ।

Advertisement
০৩ ২০

কূটনীতিকদের কথায়, কিছুটা দেরিতে হলেও আধুনিক লড়াইয়ের এই সারসত্য বুঝেছে ভারত। আর তাই অত্যন্ত সন্তর্পণে তিনটি নতুন তেল মজুত কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে ফেলেছে নয়াদিল্লি। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের মোট পেট্রোলিয়ামের চাহিদার ৮০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করে কেন্দ্র। আর তাই জ্বালানি নিরাপত্তায় বিকল্প ব্যবস্থাগুলির উপরেও জোর দিয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। দিল্লির এ-হেন ‘কৌশলগত’ পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন বিশ্লেষকেরা।

০৪ ২০

বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই সংবাদসংস্থা রয়টার্সের কাছে মুখ খুলেছেন ‘ইন্ডিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পেট্রোলিয়াম রিজ়ার্ভ লিমিটেড’-এর চিফ এক্‌জ়িকিউটিভ অফিসার বা সিইও এলআর জৈন। তিনি জানিয়েছেন, প্রকৌশলগত পরামর্শদাতা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড’কে নতুন মজুত ভান্ডার তৈরির জন্য সমীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সেই কাজ চলছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির রিপোর্ট জমা পড়লে মূল নির্মাণকাজ শুরু হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন জৈন।

০৫ ২০

বর্তমানে দেশে মোট তিনটি অশোধিত তেলের মজুত ভান্ডার আছে। সেখানে ৫৩ লক্ষ ৩০ হাজার টন পর্যন্ত ‘তরল সোনা’ রাখতে পারে নয়াদিল্লি। কৌশলগত মজুত ভান্ডারগুলি আছে কর্নাটকের পেদুর ও ম্যাঙ্গালুরু এবং অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে। সূত্রের খবর, নতুন তিনটি কেন্দ্র রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ওড়িশায় তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। যদিও এ ব্যাপারে এখনও মোদী মন্ত্রিসভার সবুজ সঙ্কেত মেলেনি।

০৬ ২০

‘ইন্ডিয়ান স্ট্র্যাটেজ়িক পেট্রোলিয়াম রিজ়ার্ভ লিমিটেড’-এর সিইও জৈন জানিয়েছেন, রাজস্থানের মরু এলাকার বিকানেরের লবণ গুহায় একটি মজুত কেন্দ্র গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা করা হয়েছে। সেখানে ৫২ থেকে ৫৩ লক্ষ অশোধিত তেল রাখা যাবে। এ ছাড়া ম্যাঙ্গালুরুর মজুত ভান্ডারের আয়তন আরও বাড়াবে সরকার। সেখানকার নতুন রিজ়ার্ভারটিতে ১৭ লক্ষ ৫০ হাজার টন ‘তরল সোনা’ রাখতে পারবে কেন্দ্র।

০৭ ২০

এ ছাড়া মধ্যপ্রদেশের বিনা এলাকায় একটি মজুত ভান্ডার তৈরির পরিকল্পনা করছে সরকার। ওই রিজ়ার্ভারের ধারণক্ষমতা অবশ্য এখনও ঠিক হয়নি। ‘তরল সোনা’ মজুতের দু’টি কৌশলগত ভান্ডার নির্মাণের অনুমোদন অবশ্য ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র। কর্নাটকের পাদুর এবং ওড়িশার চান্দিখোলে অচিরেই শুরু হবে সেগুলির নির্মাণকাজ। সংশ্লিষ্ট রিজ়ার্ভার দু’টির অশোধিত তেল ধারণ ক্ষমতা যথাক্রমে ২৫ লক্ষ এবং ৪০ লক্ষ টন বলে জানা গিয়েছে।

০৮ ২০

বিশেষজ্ঞদের দাবি, বর্তমানে কৌশলগত পেট্রোলিয়াম মজুতের ব্যাপারে নীতিগত দিক থেকে বেশ কিছুটা পরিবর্তন এনেছে ভারত। ফলে এই ক্ষেত্রে বেড়েছে বেসরকারি সংস্থাগুলির অংশগ্রহণ। এ ব্যাপারে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নীতি যে নয়াদিল্লি অনুসরণ করছে, তা বলা যেতে পারে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় ওই দুই দেশে অপরিশোধিত তেল এবং পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য ব্যবসার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে একাধিক বেসরকারি কোম্পানি।

০৯ ২০

জ্বালানি নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে অপরিশোধিত তেল আমদানিতে বেশ কিছু বদল করেছে ভারত। একটা সময়ে এ ব্যাপারে শুধুমাত্র আরব দুনিয়ার ‘পেট্রোলিয়াম রফতানিকারী দেশগুলির সংগঠন’ বা ওপেকের (অর্গানাইজ়েশন অফ পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ়) উপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল ছিল নয়াদিল্লি। কিন্তু, সেই জায়গা থেকে সরে এসে এখন বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকেও বিপুল পরিমাণে ‘তরল সোনা’ কিনছে মোদী সরকার।

১০ ২০

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়ার উপর বিপুল পরিমাণে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। এর পরই অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে ভারতকে সস্তা দরে কাঁচা তেল বিক্রির মেগা অফার দেয় মস্কো। এই সুযোগ গ্রহণ করতে দ্বিতীয় বার ভাবেনি নয়াদিল্লি। ফলে গত তিন বছরে সর্বাধিক ‘তরল সোনা’ পূর্ব ইউরোপের দেশটি থেকেই আমদানি করেছে মোদী প্রশাসন।

১১ ২০

পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে আমদানি করা খনিজ তেলের ৩৬ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইরাক এবং সৌদি আরব। এই দুই আরব মুলুক থেকে যথাক্রমে ২১ এবং ১৩ শতাংশ ‘তরল সোনা’ কিনছে কেন্দ্র। এই তালিকায় চতুর্থ এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারতে আমদানি করা তেলের ন’শতাংশ আসে আবু ধাবি থেকে। আর এ ক্ষেত্রে আমেরিকার তিন শতাংশ অবদান রয়েছে।

১২ ২০

ভারতকে খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি করার ব্যাপারে বহু বার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ইরান। একটা সময়ে অবশ্য তেহরানের থেকে এই দুই জ্বালানি কিনত নয়াদিল্লি। কিন্তু, সাবেক পারস্য দেশের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকায় বর্তমান শিয়া মুলুকটির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে কেন্দ্র। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ভবিষ্যতে এই সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে মোদী সরকার।

১৩ ২০

পাশাপাশি, অপরিশোধিত তেলের ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্র। সেই তালিকায় রয়েছে ইকুয়েডর এবং ভেনেজুয়েলা। আফ্রিকার অপরিশোধিত তেলের ভান্ডারের দিকেও নজর রেখেছে মোদী সরকার। বর্তমানে সারা দেশে দিনে ৪৩ থেকে ৪৭ লক্ষ ব্যারেল ‘তরল সোনা’ খরচ হয় বলে জানিয়েছে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক।

১৪ ২০

চলতি বছরের ১৩ থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত চলা ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধের মধ্যে পারস্য উপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ় প্রণালী বন্ধ করার হুমকি দেয় তেহরান। ফলে তেলবাহী দুই ‘সুপার ট্যাঙ্কার’কে গতিপথ বদলে পারস্য এবং ওমান উপসাগরের সংযোগরক্ষাকারী ওই প্রণালী ছেড়ে সরে যেতে হয়েছিল। আমিরশাহি এবং ইরানের মধ্যে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার চওড়া হরমুজ় প্রণালী বিশ্ব জুড়ে ‘তেলের করিডর’ হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের ২০ শতাংশ ওই জলপথের মাধ্যমে পশ্চিম এশিয়া থেকে বহির্বিশ্বে রফতানি করা হয়।

১৫ ২০

একই কথা লোহিত সাগরের ক্ষেত্রেও বলা যেতে পারে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজ়রায়েলে ঢুকে ভয়ঙ্কর আক্রমণ শানায় ইরান মদতপুষ্ট প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ফলে হামাসের গড় হিসাবে পরিচিত প্যালেস্টাইনের গাজ়ায় লাগাতার বোমাবর্ষণ চালাতে থাকে তেল আভিভের বিমানবাহিনী।

১৬ ২০

এই পরিস্থিতিতে হামাসের সমর্থনে এগিয়ে আসে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। ইরান মদতপুষ্ট এই সশস্ত্র গোষ্ঠী ইজ়রায়েলের বেশ কয়েকটি শহর লক্ষ্য করে পরপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ফলে লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজ চলাচল বিঘ্নিত হয়েছিল। এই সমুদ্রপথও জ্বালানি তেল আমদানি-রফতানির গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা হিসাবে পরিচিত।

১৭ ২০

গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে দ্বিতীয় আরব-ইজ়রায়েল যুদ্ধের সময়ে প্রায় পাঁচ মাস বন্ধ ছিল সুয়েজ খাল। ফলে লোহিত সাগর পেরিয়ে ভূমধ্যসাগরে যেতে পারেনি কোনও পণ্যবাহী জাহাজ। ইতিহাসে এই ঘটনা সুয়েজ সঙ্কট হিসাবে পরিচিত। সংশ্লিষ্ট খালটি বন্ধ ছিল ১৯৫৬ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৫৭ সালের মার্চ পর্যন্ত। সুয়েজ সঙ্কটের জেরে আকাশ ছুঁয়েছিল অপরিশোধিত তেলের দাম।

১৮ ২০

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন পশ্চিম এশিয়ায় ইহুদিভূমি ইজ়রায়েলকে কেন্দ্র করে যে ভাবে অস্থিরতা বাড়ছে তাতে ফের ওই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই সমস্ত কারণেই কৌশলগত জ্বালানি ভান্ডার গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে ভারত। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা বা আইইএ-র (ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি) স্থায়ী সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছে নয়াদিল্লি। সেটা পেতে গেলেও জ্বালানি সংরক্ষণ বাড়াতে হবে কেন্দ্রকে।

১৯ ২০

বর্তমানে খনিজ তেলের সর্বাধিক মজুত ভান্ডার রয়েছে আমেরিকার। প্রায় ১০০ দিনের বেশি জ্বালানি সংরক্ষিত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় স্থানে আছে চিন। বেজিঙের জ্বালানি ভান্ডারে মজুত আছে ৯০ দিনের তেল। অন্য দিকে, বর্তমান পরিকাঠামোয় মাত্র ৯ থেকে ১০ দিনের মতো তেল মজুত রাখতে পারছে ভারত।

২০ ২০

জৈন বলেছেন, ‘‘আইইএ-র স্থায়ী সদস্যপদ পেতে হলে আমাদের কৌশলগত মজুতকে ৯০ দিনের সমকক্ষ করতে হবে। এটা আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন।’’ সূত্রের খবর, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের মজুত ভান্ডারের তেলধারণের ক্ষমতা ৩০ থেকে ৪০ দিনের দাঁড়াবে। ২০৪৭ সালের মধ্যে সেটা ৯০ দিনের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছোতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement