Indian Economy’s Dutch Disease

শরীরে বাসা বেঁধেছে ‘ডাচ রোগ’, ফুটে উঠেছে লক্ষণ, শিল্পোৎপাদনে পিছিয়ে গিয়ে ‘রক্তাল্পতা’য় ভুগছে ভারতীয় অর্থনীতি?

বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও শিল্পোৎপাদনে পিছিয়ে থাকার কারণে ‘ডাচ রোগে’ ভুগছে ভারত। কেন এই অসুস্থতা চিন্তা বাড়াচ্ছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের? কী ভাবেই বা হবে এর নিরাময়?

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:০৪
Share:
০১ ১৮

বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও আজব অসুস্থতায় ভুগছে ভারত। এর ফলে শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে চিন, ‘রিপাবলিক অফ কোরিয়া’ বা আরওকে (পড়ুন দক্ষিণ কোরিয়া) এবং জাপানের মতো দেশগুলির চেয়ে বহু গুণ পিছিয়ে আছে নয়াদিল্লি। বিশ্লেষকদের দাবি, এ দেশের আর্থিক শরীরে যে ভাইরাস বাসা বেঁধেছে তার পোশাকি নাম ‘ডাচ রোগ’ (ডাচ ডিজ়িজ)। এর জন্যেই দিন দিন বাড়ছে বাণিজ্যিক ঘাটতি। পরিস্থিতির বদল না হলে আগামী দিনে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের কপালের ভাঁজ যে আরও চওড়া হবে, তা বলাই বাহুল্য।

০২ ১৮

ভারতের ‘ডাচ অসুস্থতা’র লক্ষণ প্রথম নজরে আসে অর্থনীতিবিদ দেবেশ কপূর এবং অরবিন্দ সুব্রহ্ম্যণমের। ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হয় তাঁদের লেখা বই ‘আ সিক্সথ অফ হিউম্যানিটি: ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইন্ডিয়াজ় ডেভেলপমেন্ট ওডিসি’। সেখানেই এই রোগের উপসর্গ থেকে অন্যান্য সমস্যার বিস্তারিত বর্ণনা দেন তাঁরা। ব্যবহার করেন ‘ডাচ ডিজ়িজ়’ শব্দবন্ধ। ২০২৫ সাল আসতে আসতে তা ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। বিষয়টিতে উদ্বেগ বেড়েছে কেন্দ্রের মোদী সরকারের।

Advertisement
০৩ ১৮

কী এই ‘ডাচ রোগ’? এটি প্রকৃতপক্ষে দুই ভারতীয় অর্থনীতিবিদের তৈরি করা একটি নতুন তত্ত্ব বলা যেতে পারে। সেখানে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এ দেশের শিল্পোৎপাদন কেন চিন, দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপানের চেয়ে অনেক কম, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন দেবেশ ও অরিন্দম। তাঁদের দাবি, সরকারি চাকরি এবং পরিষেবামূলক বেসরকারি ক্ষেত্রে উচ্চ বেতন হওয়ায় উৎপাদনক্ষেত্রের দিকে ঝুঁকতে চাইছেন না কেউই। ফলে সেখানে দক্ষ শ্রমিক এবং যোগ্য পেশাদারের অভাব হচ্ছে। এর জেরে বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপারে বিদেশি নির্ভরশীলতা কাটাতে ব্যর্থ হচ্ছে নয়াদিল্লি।

০৪ ১৮

দেবেশ ও অরিন্দম জানিয়েছেন, পরিষেবা ক্ষেত্রে বিশ্বের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে ফেলেছে ভারত। এই খাতে চড়া মুনাফা করছে এ দেশের তাবড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। ফলে উপেক্ষিত হচ্ছে পণ্য উৎপাদন। সেখানকার পরিস্থিতি যথেষ্টই নেতিবাচক। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ১৯৫৯ সালের গ্রোনিঞ্জেন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের কথা বলেছেন তাঁরা। এর ফলে মারাত্মক প্রভাবিত হয়েছিল ডাচ শিল্পোৎপাদন। ওই সময় সরকার থেকে উদ্যোগপতি, সকলের নজর গিয়ে পড়ে ওই গ্যাস ক্ষেত্রে। ফলে সামঞ্জস্য হারায় ইউরোপের দেশটির অর্থনীতি।

০৫ ১৮

নিজেদের বইয়ে প্রাঞ্জল ভাষায় ‘ডাচ রোগ’-এর বর্ণনা দিয়েছেন দেবেশ ও অরিন্দম। তত্ত্বটি বোঝাতে গিয়ে তাঁরা লিখেছেন, ‘‘এমন একটি অর্থনীতি কল্পনা করুন যেখানে কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। সেটা অপরিশোধিত তেল বা অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ হতে পারে। যখনই তার উত্তোলন শুরু হবে, তখনই সংশ্লিষ্ট দেশের যাবতীয় শ্রমকে শুষে নেবে ওই খনিজ সম্পদ। কারণ, অর্থনীতির ওই অংশে মজুরি বৃদ্ধির সর্বাধিক সম্ভাবনা রয়েছে।’’

০৬ ১৮

দেবেশ ও অরিন্দম জানিয়েছেন, এই অবস্থা একটি দেশের অর্থনীতিতে ‘ডাচ অসুস্থতা’ ডেকে আনতে পারে। কারণ, সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রটি তখন কেবলমাত্র খনিজ সম্পদ রফতানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা ঘরে তুলতে চাইবে। ফলে ঘরোয়া খুচরো বাজারের অধিকাংশ সামগ্রীই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে তাঁকে। এতে এক দিকে যেমন দেশীয় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকছে, অন্য দিকে তেমনই বিদেশি বাজার তুলনামূলক ভাবে ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে পারে। এই সমস্ত সমস্যাই গত কয়েক বছরে ভারতের ক্ষেত্রে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।

০৭ ১৮

এ দেশের অর্থনীতিতে ‘ডাচ রোগ’-এর প্রকোপ কতটা প্রকট হয়েছে, তা বোঝাতে গিয়ে একাধিক যুক্তি দিয়েছেন দেবেশ এবং অরিন্দম। তাঁদের দাবি, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়েও মূলত কৃষিভিত্তিক রয়ে গিয়েছে ভারতের অর্থনীতি। অর্থাৎ, এ দেশের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশই জড়িত আছেন চাষাবাদের সঙ্গে। পেশা বদল করে উৎপাদনক্ষেত্রে চলে আসার ব্যাপারে বেশ অনীহা আছে তাঁদের। তার পরেও যাঁরা কৃষিকাজ ছাড়ছেন, তাঁদের সিংহভাগকে হয় সরকারি চাকরি বা বেসরকারি পরিষেবা ক্ষেত্রে যোগ দিতে দেখা যাচ্ছে, শিল্পোৎপাদনে নয়।

০৮ ১৮

বিশ্লেষকদের যুক্তি, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের তুলনায় সরকারি ক্ষেত্রে আধিকারিক এবং কর্মচারী মিলিয়ে এখনও বিপুল পরিমাণে নিয়োগ করে থাকে এ দেশের প্রশাসন। কেন্দ্র হোক বা রাজ্য, সরকারি চাকরিতে নিরাপত্তা এবং বেতন বেশি হওয়ায় তার পিছনে ছোটার একটা প্রবণতা রয়েছে। একই কথা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সেখানকার বেতনকাঠামো তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই ভাল হওয়ায় টেক জায়ান্টগুলিতে চাকরি করতে চাইছেন এ দেশের মেধাবী ছেলে-মেয়েরা।

০৯ ১৮

এই ‘ডাচ রোগ’-এর জেরে ভারতীয় অর্থনীতির দ্বিমুখী সমস্যা হচ্ছে। প্রথমত, সরকারি চাকরির মতো বেতনকাঠামো উৎপাদনক্ষেত্রে কখনওই সম্ভব নয়। সেখানে পণ্য উৎপাদনের পরিমাণ, তার দাম এবং বাজারের চাহিদার উপর শ্রমিকদের মজুরি নির্ভর করে থাকে, যা পূরণ করা কখনও উদ্যোগপতিদের পক্ষে সম্ভব নয়। সেই কারণেই দক্ষ শ্রমিক এবং যোগ্য পেশাদারদের সমস্যায় ভুগছেন তাঁরা।

১০ ১৮

এ দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়াদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি, কম্পিউটার ও কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) নিয়ে পড়ার একটা চাহিদা রয়েছে। এর মূলেও আছে ভারতীয় টেক জায়ান্টগুলির উচ্চ বেতনকাঠামো। এ ছাড়া সেখানকার চাকরিরতেরা বিদেশে বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের নানা দেশে কাজ এবং গবেষণা করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। এই লোভনীয় সুযোগ উৎপাদনক্ষেত্রে একেবারেই নেই।

১১ ১৮

‘ডাচ রোগ’-এর কথা বলতে গিয়ে দেবেশ ও অরিন্দম আরও কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। তাঁদের দাবি, সংশ্লিষ্ট রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় মেকানিক্যাল বা ইলেকট্রিক্যালের মতো মূল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রগুলিতে মেধাবী পড়ুয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে শুরু করেছে। উৎপাদনক্ষেত্রে নয়াদিল্লির পিছিয়ে পড়ার সেটাও একটা বড় কারণ বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা।

১২ ১৮

১৯৯১ সালে ‘উদার অর্থনীতি’ চালু করে ঘরোয়া বাজার বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় কেন্দ্র। এর ফলে এক দিকে যেমন বিপুল পরিমাণে বিদেশি লগ্নি আসতে শুরু করে, অন্য দিকে তেমনই সস্তা পণ্যে ভরে যায় ভারতের খুচরো বাজার। সেই প্রতিযোগিতার মুখে দেশীয় শিল্প সংস্থাগুলির পক্ষে টেকা সম্ভব ছিল না। ফলে উৎপাদনের মাত্রা অনেকটাই কমিয়ে দেয় তারা। এতে দীর্ঘ মেয়াদে অনেকটাই আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে নয়াদিল্লি।

১৩ ১৮

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত আর্থিক বছরে (২০২৪-’২৫) চিনে এ দেশের পণ্য রফতানির পরিমাণ ১৪.৫ শতাংশ কমে ১,৪২৫ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০২৩-’২৪ সালে তা ছিল ১,৬৬৬ কোটি ডলার। অন্য দিকে, গত আর্থিক বছরে বেজিং থেকে আমদানি বৃদ্ধি পায় ১১.৫২ শতাংশ। সেখানকার পণ্যের জন্য ১১ হাজার ৩৪৫ কোটি ডলার খরচ করতে হচ্ছে নয়াদিল্লিকে। ফলে বাণিজ্যিক ঘাটতি বেড়ে ৯,৯২০ কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছোয়।

১৪ ১৮

নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ ড্যারন এসেমোগলু আবার জানিয়েছেন, ‘ডাচ রোগ’-এ আক্রান্ত হলে সেখানে থেকে বেরিয়ে আসার একটা সহজ উপায় রয়েছে। সেটা হল, প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিল্পোৎপাদের একটা বড় অংশকে পুরোপুরি যন্ত্রনির্ভর করে ফেলা। ঠিক যেমনটা চিন, জাপান, জার্মানি বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলি করেছে। কিন্তু সেখানে অন্য সমস্যায় ভুগছে ভারত। ফলে এখনও এই রাস্তা ধরতে পারেনি নয়াদিল্লি।

১৫ ১৮

ভারতীয় শিল্পপতিরা অনেক বেশি মানবশ্রমের উপর নির্ভরশীল। সেটা রাতারাতি পাল্টে ফেলা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে দক্ষ পেশাদারের প্রয়োজন। সেটাও বর্তমানে বিপুল মাত্রায় হাতে পাচ্ছেন না উদ্যোগপতিরা। ফলে ওই ধরনের প্রযুক্তির বিকাশও যে খুব দ্রুত গতিতে হচ্ছে, এমনটা নয়।

১৬ ১৮

যে কোনও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত গবেষণা ও উন্নয়ন (পড়ুন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) খাতে অনেক কম অর্থ খরচ করে ভারত সরকার। বেসরকারি শিল্প সংস্থাগুলির মধ্যেও সেই প্রবণতা রয়েছে। ফলে নতুন প্রযুক্তির উন্মেষ দ্রুত এ দেশে হয় না। পণ্য উৎপাদনে পিছিয়ে পড়া বা স্থবিরতা আসার নেপথ্যে একেও অন্যতম বড় কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতিবিদ দেবেশ ও অরিন্দম।

১৭ ১৮

২১ শতকের প্রথম ২৫ বছরে ভারতীয় কোটিপতির সংখ্যা নিঃসন্দেহে বেড়েছে। এ দেশের বেশ কিছু স্টার্ট আপ পেয়েছে ইউনিকর্নের ট্যাগ। তার পরেও টেক জায়ান্টগুলির প্রাথমিক স্তরের বেতন খুব কম বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলি সবই বেসরকারি ক্ষেত্রে বৃদ্ধির সূচককে পুরোপুরি একমুখী করে ফেলেছে। বাড়াচ্ছে পণ্য উৎপাদন শিল্পের বৈষম্য।

১৮ ১৮

এই পরিস্থিতির বদল ঘটাতে ২০২০ সালে ‘উৎপাদনভিত্তিক উৎসাহ ভাতা’ বা পিএলআই (প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেনটিভ) প্রকল্প চালু করে মোদী সরকার। এর মূল লক্ষ্য হল বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম, বৈদ্যুতিন গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং সৌরশক্তির মতো মোট ১৪টি ক্ষেত্রে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি। আগামী দিনে সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলি ব্যাপক হারে রফতানি করার ইচ্ছা রয়েছে নয়াদিল্লির। আর তাই এগুলি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত দেশীয় সংস্থাগুলিকে নানা ভাবে উৎসাহ ভাতা দিচ্ছে কেন্দ্র।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement