মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘শুল্কযুদ্ধে’ নতিস্বীকার নয়! বরং পাল্টা প্রত্যাঘাত শানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যাবতীয় সংস্থার উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিক কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে এ বার এমনই আর্জি জানালেন দেশের ‘অন্নদাতা’রা। এতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি ঘরোয়া রাজনীতিতেও বিজেপির লাভ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
চলতি বছরের এপ্রিলে নতুন শুল্কনীতি চালু করা ইস্তক ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি সেরে ফেলার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি এবং দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য এ দেশের বাজারে বিক্রি করতে চাইছেন তিনি। কিন্তু, এ ব্যাপারে তীব্র আপত্তি রয়েছে নয়াদিল্লির। কেন্দ্রের যুক্তি, এতে মারাত্মক আর্থিক লোকসানের মুখে পড়বেন এ দেশের ডেয়ারি শিল্প এবং কৃষকসমাজ। ফলে দীর্ঘ আলোচনা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কোনও সমঝোতায় আসেনি দুই দেশ।
কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের এ-হেন পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করছেন হরিয়ানার কৃষকনেতারা। গত ৯ অগস্ট এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের কাছে বিবৃতি দেন ‘ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন (চাদুনি)’-এর সভাপতি গুরনাম সিংহ চাদুনি। তিনি বলেন, ‘‘যে সমস্ত মার্কিন সংস্থা ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, অবিলম্বে তাদের বহিষ্কার করা উচিত। ওরা আমাদের ধ্বংস করতে চায়। আমরা কেন ছেড়ে দেব? এখানে কেন ওদের জায়গা দেব?’’
গত জুলাইয়ে ভারতীয় পণ্যের উপরে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন ট্রাম্প। ফলে মার্কিন বাজারে এ দেশের সামগ্রীগুলির উপর মোট করের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘একতরফা’ সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছেন চাদুনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমেরিকার মতো দেশ ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে নিজের পছন্দমতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। এটা কখনওই মেনে নেওয়া যায় না। নইলে ভবিষ্যতে ওরা ফের আমাদের হুমকি দেবে।’’
প্রায় একই সুর শোনা গিয়েছে ‘পাগড়ি সম্বল জট্টা কিসান সংগ্রাম সমিতি’র সভাপতি মনদীপ নাথওয়ানের গলাতেও। তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি যদি সত্যি হয়, তা হলে অবিলম্বে এ দেশে ব্যবসা করা যাবতীয় মার্কিন সংস্থার উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিক কেন্দ্র।’’ যদিও সরকারি তরফে এই নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি।
কৃষক সংগঠনগুলির সাফ কথা, এ দেশের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা এখনও চাষের উপরে নির্ভরশীল। মৎস্যজীবী এবং দুধ ও দুগ্ধজাত শিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এই পরিস্থিতিতে বৃহৎ পুঁজির সংস্থাকে সামনে রেখে সেই জায়গা পুরোপুরি দখল করতে চাইছে আমেরিকা। আর তাই বার বার ভারতের বাজার খুলে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের উপরে চাপ সৃষ্টি করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন।
সূত্রের খবর, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে পঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষক সংগঠনগুলি প্রতীকী বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেখান থেকে মার্কিন পণ্য বয়কটের ডাক দিতে পারেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে ভারতের অবস্থান বদলের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে সংশ্লিষ্ট চুক্তি চিরতরে ঠান্ডা ঘরে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
অন্য দিকে, ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে দেওয়া ভাষণে এই নিয়ে মুখ খোলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বলেন, ‘‘স্বাধীনতার পর সকলের জন্য খাদ্য নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু আমাদের কৃষকেরা আমাদের স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। তাই ভারত সরকার কৃষকদের স্বার্থের সঙ্গে কোনও আপস করবে না। দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকব আমি।’’
মার্কিন কৃষি ব্যবস্থার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি রয়েছে। প্রথমত, আমেরিকায় ফসলের চাষ অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। সেই সুবিধা থেকে এখনও অনেকটা দূরে রয়েছেন এ দেশের কৃষকেরা। দ্বিতীয়ত, কৃষিতে বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। ফলে বাজার খুলে গেলে ব্যাপক সস্তা দরে খাদ্যশস্য বিক্রি করতে পারবেন ও দেশের চাষিরা। সে ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে টিকে থাকাই কঠিন হবে ভারতীয় কৃষকসমাজের।
দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের ক্ষেত্রে আবার অন্য সমস্যা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের দাবি, ‘আমিষ দুধ’ ভারতের বাজারে বিক্রি করতে চাইছে আমেরিকা। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে অন্য প্রাণীর রক্ত-মাংস মেশানো খাবার খাইয়ে গরুকে হৃষ্টপুষ্ট করে তোলার রেওয়াজ রয়েছে। ফলে ওই দুধ পুজো বা যজ্ঞের কাজে ব্যবহার করা যাবে না। নিরামিষভোজী হিন্দুরাও ‘আমিষ গোদুগ্ধ’ মুখে তুলতে পারবেন না।
গত ফেব্রুয়ারিতেই সঙ্ঘ পরিবারের এই যুক্তি মেনে নিয়ে আমেরিকাকে বিশেষ বার্তা পাঠায় মোদী সরকার। সেখানে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয় যে, কোনও ভাবেই আমিষভোজী গরুর দুধ বা অন্যান্য ডেয়ারি পণ্য এ দেশের বাজারে পাঠাতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র। সূত্রের খবর, এই ইস্যুতে বাণিজ্যচুক্তিতেও কোনও সমাধান সূত্র বার করতে পারেনি দু’পক্ষ।
২০২০ সালে তিনটি কৃষি আইন প্রণয়ন করে কেন্দ্র। সেগুলি হল, কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যে ব্যবসা ও বাণিজ্য সংক্রান্ত আইন, অত্যাবশ্যক পণ্য আইন এবং কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ ও কৃষি পরিষেবা সংক্রান্ত কৃষক চুক্তি আইন। এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলনে নামে পঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকসমাজ। ফলে প্রবল অস্বস্তির মুখে পড়ে মোদী সরকার।
কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন নিয়ে আন্দোলনকারী চাষিদের যুক্তি ছিল, এতে গোটা বিষয়টা ভেঙে পড়বে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রান্তিক এবং ছোট কৃষকেরা। মধ্যস্বত্বভোগী এবং পুঁজিবাদী বড় সংস্থার হাতে শোষিত হওয়ারও রয়েছে প্রবল আশঙ্কা। কৃষকদের ওই দাবি সমর্থন করে কংগ্রেস-সহ প্রায় সমস্ত বিরোধী দল।
২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারির মধ্যে সাত দফায় কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করেও সমাধানসূত্রে পৌঁছোতে ব্যর্থ হয় সরকার। এর মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন। ওই বছরের ২৬ জানুয়ারি ট্র্যাক্টর মিছিল নিয়ে রাজধানী দিল্লিতে ঢুকে পড়ে আন্দোলনকারী চাষিদের একাংশ। লালকেল্লার উপর থেকে জাতীয় পতাকা নামিয়ে দেন তাঁরা। দফায় দফায় লাঠিচার্জ এবং কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়েও বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি স্থানীয় পুলিশ।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, কেন্দ্রের কৃষি আইনের বিরুদ্ধে চলা আন্দোলনকে সমর্থন জানান তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের বোনঝি মীনা এবং পপ তারকা রিহানা। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই নিয়ে কড়া বিবৃতি দেয় কেন্দ্র। বলা হয়, সঠিক বিষয়ে না জেনেই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করছেন তাঁরা। ওই সময়ে আমেরিকার সরকার অবশ্য এ ব্যাপারে নিশ্চুপ ছিল।
২০২১ সালের জুলাইয়ে বাদল অধিবেশন চলাকালীন সংসদ ভবন চত্বরেই আন্দোলনে বসেন কৃষকেরা। সেখানে ‘কিসান সংসদ’ শুরু করেন তাঁরা। পরে অগস্টে দিল্লির যন্তর মন্তরে চাষিদের এই আন্দোলনে যোগ দেন ১৪টি বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা। ফলে কেন্দ্রের উপর চাপ বেড়েছিল।
ওই বছরের অগস্টে করনালে কৃষকদের উপর লাঠি চালায় হরিয়ানা পুলিশ। এতে গুরুতর জখম হন আন্দোলনরত বহু চাষি। অক্টোবরে উত্তরপ্রদেশের লখীমপুর খীরীতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রের ছেলের দ্রুতগামী গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় চার কৃষকের। ঘটনার পর মন্ত্রী-পুত্রের গাড়ি পুড়িয়ে দেন বিক্ষোভরত চাষিরা।
২০২১ সালের নভেম্বরে তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহার করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। এ ব্যাপারে বিবৃতি দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের উদ্দেশ্য সৎ ছিল। কিন্তু কৃষি আইনের সুফলের কথা কিছু কৃষককে আমরা বোঝাতে পারিনি।’’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, কৃষি আন্দোলনের আঁচ ২০২৪ সালের নির্বাচনে কিছুটা টের পায় বিজেপি। পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশের একাধিক কেন্দ্রে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয় গেরুয়া শিবিরকে। ফলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে বেশ কিছুটা দূরে বিজয়রথ থেমে যায় তাদের। ২৪০টা আসন পাওয়ায় শরিক দলের সমর্থন নিয়ে ফের সরকার গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ওই ঘটনার থেকে শিক্ষা নিয়েই নিজেকে ‘কৃষকবন্ধু’ হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আর তাই কোনও অবস্থাতেই আমেরিকার সামনে মাথা নোয়াতে রাজি নন তিনি। এই অনড় মনোভাবের জেরে কৃষকসমাজ তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালে ভোটের হাওয়া ফের গেরুয়া শিবিরের দিকে ঘুরতে পারে বলে স্পষ্ট করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।