স্মার্টফোনের দুনিয়ায় বুলেট গতিতে দৌড়চ্ছে ভারত। ইউরোপ এবং আমেরিকার বাজারে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ মুঠোবন্দি ডিভাইসের চাহিদা এখন তুঙ্গে! ফলে চলতি আর্থিক বছরের (পড়ুন ২০২৫-’২৬) মধ্যেই স্মার্টফোনের রফতানিকে ৩,২০০ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে নয়াদিল্লি। এ দেশের এ-হেন অভূতপূর্ব উত্থানে কপাল পুড়েছে চিনের। হু-হু করে কমছে তাদের রফতানির সূচক। আর তাই কাঁকড়ার মতো পিছন থেকে টেনে ধরতে লাগাতার ‘অবৈধ’ নিষেধাজ্ঞার খোঁচায় বিপদ বাড়াচ্ছে ড্রাগন।
গত কয়েক বছর ধরে ভারতে স্মার্টফোন উৎপাদনের ব্যাপারে উৎসাহী হয়েছে অ্যাপ্ল বা গুগ্লের মতো বহুজাতিক মার্কিন টেক জায়ান্ট। এ দেশের মাটিতে মুঠোফোন ডিভাইস তৈরি করে বিশ্ব বাজারে বিক্রি করছে তারা। একই কথা মোটোরোলা, ফক্সকন, ভিভো, ওপো, লাভা, ডিক্সন, ফ্লেক্স এবং টাটা ইলেকট্রনিক্সের মতো সংস্থার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ফলে ভারতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে স্মার্টফোনের উৎপাদন। বিশ্লেষকদের দাবি, সেই কারণেই বিষয়টি চক্ষুশূল হয়েছে চিনের।
ভারতের স্মার্টফোন উৎপাদন অনেকাংশেই চিনের উপর নির্ভরশীল। মুঠোফোন ডিভাইস তৈরির জন্য সেখান থেকে কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতি আমদানি করে থাকে এ দেশের যাবতীয় শিল্প সংস্থা। পাশাপাশি, ওই যন্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও বেজিঙের বিশেষজ্ঞেরা দিয়ে থাকেন। ভারতীয় শিল্প সংস্থাগুলির অভিযোগ, সেখানেই ‘অবৈধ’ ভাবে নিষেধাজ্ঞা চাপাচ্ছে ড্রাগন। আর গোটা ব্যাপারটাই হচ্ছে কোনও রকমের সরকারি ঘোষণা ছাড়া। ফলে ভারতে মাঝেমধ্যেই মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন।
সরকারি ভাবে ভারতের উপরে নেই কোনও চিনা নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু এ দেশের স্মার্টফোন উৎপাদনকারী শিল্প সংস্থাগুলির দাবি, মাঝেমধ্যেই ইচ্ছাকৃত ভাবে কাঁচামাল থেকে যন্ত্রপাতি সরবরাহ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করছে না বেজিং। ফলে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে ইউরোপ বা আমেরিকার বাজারে চাহিদা অনুযায়ী স্মার্টফোন রফতানি। ভারতীয় শিল্প সংস্থাগুলির অভিযোগ, পর্দার আড়ালে থেকে এ ব্যাপারে কলকাঠি নাড়ছে ড্রাগনভূমির শি জিনপিঙের সরকার।
স্মার্টফোন তৈরির জন্য দু’টি যন্ত্র একান্ত ভাবে প্রয়োজন। সেগুলি হল, প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড এবং সেমিকন্ডাক্টার মেশিন। এ ছাড়া সারফেস মাউন্ট টেকনোলজ়ি এবং রোবটসদৃশ যন্ত্রের এতে বহুল ব্যবহার রয়েছে। বর্তমানে এগুলির সবই চিন থেকে আমদানি করে থাকে ভারতের স্মার্টফোন উৎপাদনকারী যাবতীয় ফার্ম। সংশ্লিষ্ট যন্ত্রগুলি ছাড়া দ্রুত গতিতে মুঠোফোন ডিভাইস তৈরি করা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট যন্ত্রগুলির সরবরাহে বেজিং দেরি করছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হল বিরল খনিজ পদার্থ (পড়ুন রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস)। স্মার্টফোনের ভিতরের একাধিক অতি ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ বা সার্কিটে এগুলিকে ব্যবহার করতে হয়। স্মার্টফোনের স্পিকার, ক্যামেরা এবং ব্যাটারিতে থাকে বিরল খনিজ, যার প্রায় পুরোটাই ভারতে আসে চিন থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে কিছুটা রাশ টেনেছে বেজিং। ফলে বিপাকে পড়েছেন এ দেশের ফোন উৎপাদনকারীরা।
এ ছাড়া ভারত থেকে চিনা প্রশিক্ষক এবং কর্মীদেরও ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ভারতে অ্যাপ্লের আইফোন তৈরি করছে তাইওয়ানের বৈদ্যুতিন বহুজাতিক ফক্সকন। সূত্রের খবর, গত দু’মাসে এ দেশের বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত ৩০০ জনেরও বেশি চিনা কর্মীকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেছে সংস্থা। তাঁদের অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রযুক্তিবিদ। ফলে ভারতের আইফোন তৈরির কাজ কিছুটা ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট মহল। ফক্সকনের এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে বেজিঙের চাপকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকেরা।
স্মার্টফোন উৎপাদনের ক্ষেত্রে কাঁকড়ার মতো ভারতকে পিছন থেকে টেনে ধরার চিনা ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বুঝে নেওয়া যেতে পারে। একটা সময়ে শুধুমাত্র ড্রাগনভূমিতেই আইফোন তৈরি করত অ্যাপ্ল। কিন্তু বর্তমানে সেখান থেকে ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে ভারতের মাটিতে সংশ্লিষ্ট স্মার্টফোনটির উৎপাদন শুরু করেছে ওই মার্কিন টেক জায়ান্ট। ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে বিশ্বব্যাপী আইফোনের ১৪ শতাংশ অ্যাসেম্বলিংয়ের কাজ হয় ভারতে। গত অর্থবর্ষে (পড়ুন ২০২৪-’২৫) সেই সূচক বেড়ে ২০ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, এই গতি বজায় থাকলে ২০২৬ আর্থিক বছরের মধ্যে ভারতে আইফোন উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৭ থেকে ৩০ শতাংশে। অ্যাপ্ল অবশ্য চাইছে শুধু অ্যাসেম্বলিংয়ের কাজ নয়, পুরোপুরি ভাবে এ দেশের মাটিতেই তৈরি হোক আইফোন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এখানকার কারখানায় তৈরি হওয়া আইফোনের ৭০ শতাংশ বিদেশে রফতানি করে থাকে সংশ্লিষ্ট মার্কিন টেক জায়ান্ট।
তথ্য বলছে, মার্কিন স্মার্টফোনের বাজারে চিনকে সরিয়ে ধীরে ধীরে জায়গা পাকা করছে নয়াদিল্লি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের দাবি, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমেরিকায় আমদানি করা প্রতি তিনটি স্মার্টফোনের মধ্যে একটি ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’। এ বছরের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বিদেশ থেকে আমদানি করা স্মার্টফোন সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে আমেরিকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশন বা ইউএসআইটিসি (ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশন)। এটি রক্তচাপ বাড়িয়েছে চিনের।
ইউএসআইটিসি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ভারত থেকে আমেরিকায় স্মার্টফোনের আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে তিন গুণ! গত বছর (পড়ুন ২০২৪) নয়াদিল্লি থেকে ওয়াশিংটনের স্মার্টফোন আমদানির পরিমাণ ছিল ১১ শতাংশ। এ বছরে ইতিমধ্যেই সেই সূচক ৩০ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ২ কোটি ১৩ লক্ষ ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ স্মার্টফোন আমদানি করেছে আমেরিকা। ২০২৪ সালে ৭০০ কোটি ডলারের স্মার্টফোন ভারত থেকে পৌঁছেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। এ বছরে ইতিমধ্যেই সেটা ১৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯৩৫ কোটি ডলার স্পর্শ করেছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে ভারতের মাটিতে মোট স্মার্টফোন উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪.১ লক্ষ কোটি, যার বাজারমূল্য ছিল ৬,৪০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ২,৪১৪ কোটি ডলারের স্মার্টফোন বিদেশের বাজারে রফতানি করছে নয়াদিল্লি। এই অঙ্ককে ২০২৫-’২৬ অর্থবর্ষের মধ্যে তিন হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া নিয়েছে কেন্দ্র। সে ক্ষেত্রে বছর থেকে বছরের হিসাবে এতে ৫৫ শতাংশের বৃদ্ধি দেখা যাবে।
ভারত থেকে স্মার্টফোন সবচেয়ে বেশি রফতানি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইটালি, জাপান এবং চেক প্রজাতন্ত্রে। ২০২২-’২৩ আর্থিক বছরে আমেরিকায় এই রফতানির পরিমাণ ছিল ২২০ কোটি ডলার। কিন্তু ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে সেটা বেড়ে পৌঁছোয় ১,০৬০ কোটি ডলারে। জাপানের ক্ষেত্রে ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে মাত্র ৮০ কোটি ডলারের স্মার্টফোন রফতানি করেছিল নয়াদিল্লি। কিন্তু, ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে সেই সূচক বেড়ে পৌঁছেছে ১২০ কোটি ডলারে।
‘ইন্ডিয়া ব্র্যান্ড ইক্যুইটি ফাউন্ডেশন’ বা আইবিইএফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ভারতের রফতানি পণ্যগুলির মধ্যে স্মার্টফোনের র্যাঙ্কিং ছিল ১৬৭। কিন্তু, ১০ বছরের মধ্যেই (পড়ুন ২০২৫ সাল) বাড়তে বাড়তে সেটা দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। স্মার্টফোন উৎপাদনে বিদেশি নির্ভরতা কমাতে এ বছরের মার্চে ২২ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করে কেন্দ্র। এই অর্থ ঘরের মাটিতেই যন্ত্রাংশ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরিতে খরচ করা হবে বলে জানা গিয়েছে।
ভারত থেকে সর্বাধিক বিদেশে রফতানি হওয়া মুঠোফোন হল আইফোন। এর সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রকে দেশের মাটিতে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। সেই কারণে ২০২৮ সালের মধ্যে সংশ্লিষ্ট স্মার্টফোনটির ৩০ শতাংশ সরঞ্জাম এ দেশে তৈরি করার ব্যাপারে অ্যাপ্লকে রাজি করিয়েছে মোদী সরকার। টিম কুকের সংস্থা সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে অ্যাপ্লকে পিএলআই প্রকল্পের বাইরে ঠেলতে পারে প্রশাসন। এতে আর্থিক লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কা বাড়বে মার্কিন বহুজাতিক টেক জায়ান্টটির।
বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য মনে করেন, বর্তমানে চিনের জন্য যে সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুখে ভারতকে পড়তে হচ্ছে, তা কাটিয়ে উঠতে সরকারকে বেশ কিছু পদক্ষেপ করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হল বিরল খনিজ পদার্থের খোঁজ এবং তার উত্তোলন। এর জন্য ইতিমধ্যেই জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াকে কাজে নেমে পড়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র। সেই কাজে গতি আনার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে স্মার্টফোনের সেমিকন্ডাক্টরের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বেজিং থেকে আমদানি করেছিল নয়াদিল্লি। এখনও পর্যন্ত এই অঙ্কে আসেনি কোনও বদল।
দ্বিতীয়ত, গবেষণা এবং উন্নয়ন বা আরএনডি (রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট) খাতে এখনও খুব কম খরচ করছে নয়াদিল্লি। কেন্দ্রের এই মানসিকতায় বদল আসার খুব প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক্স প্রোডাক্টস) মাত্র ০.৭ শতাংশ এই খাতে বরাদ্দ করে সরকার। সেখানে চিন জিডিপির ২.৮ শতাংশ খরচ করে গবেষণা এবং উন্নয়নের জন্য।
পাশাপাশি, স্মার্টফোনের বাজারে বড় খেলোয়াড় হতে গেলে প্রশিক্ষিত কর্মীর প্রয়োজন। সে দিকেও নজর দিতে হবে সরকারকে। ভারতের যুব জনসংখ্যা অনেকটাই বেশি। সেখানে চিনের থেকে কিছুটা এগিয়ে রয়েছে নয়াদিল্লি। আর তাই যাবতীয় চ্যালেঞ্জকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা উচিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।