মাত্র চার দিনের লড়াইয়ে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ দশা! পাকিস্তানের বায়ুসেনাঘাঁটিগুলিতে আগুন ঝরিয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনী। সেই তালিকায় রয়েছে রাজধানী ইসলামাবাদ সংলগ্ন পঞ্জাব প্রদেশের চকলালার নূর খান ছাউনি। নয়াদিল্লি সেখানে আঘাত হানতেই কি সংঘর্ষবিরতিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা? লড়াই থামতেই এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
গত ৮ এবং ৯ মে রাতে ভারতের একাধিক বায়ুসেনাঘাঁটিকে নিশানা করে পাকিস্তানের বিমানবাহিনী। এর পরই পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির আকাশসীমায় ঢুকে একের পর এক ছাউনিতে হামলা চালান এ দেশের যোদ্ধা পাইলটেরা। ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে ইসলামাবাদ। বেশ কিছু গণমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমে হামলার সময়কার ভিডিয়ো ভাইরাল হয়। সেখানে পাক বায়ুসেনাছাউনিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা গিয়েছে।
১০ মে এই ইস্যুতে বিবৃতি দেন ভারতীয় সেনার কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহ। তাঁরা বলেন, ‘‘পাকিস্তানের রফিকি, মুরিদকে, চকলালা এবং রহিম ইয়ার খান বায়ুসেনাঘাঁটিতে আকাশপথে হামলা চালানো হয়েছে। এ ছাড়া নিশানা করা হয় সুক্কুর এবং চুনিয়ায় পাক সেনাঘাঁটি, পসরুর এবং সিয়ালকোটের বিমানঘাঁটি।’’ যুদ্ধবিমান থেকে এই আক্রমণ শানানো হয়েছে বলে স্পষ্ট করেন তাঁরা।
পাক বিমানবাহিনীর এই ঘাঁটিগুলির মধ্যে চকলালার নূর খান ছাউনিটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে এর দূরত্ব মেরেকেটে ১০ কিলোমিটার। একে পাক বায়ুসেনার সদর দফতর বললে অত্যুক্তি করা হবে না। শুধু তা-ই নয়, অধিকাংশ বড় অপারেশনে মুখ্য ভূমিকা থাকে নূর খান ঘাঁটির। সংশ্লিষ্ট ছাউনিটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দফতর রাওয়ালপিন্ডির গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে।
আকাশ থেকে মাটিতে (এয়ার টু সারফেস) আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে নূর খান ঘাঁটিটিকে নিশানা করে ভারতীয় বিমানবাহিনী। এই ছাউনির এক পাশে নাকি রয়েছে ইসলামাবাদের পরমাণু অস্ত্র ভান্ডার। সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ায় সকলের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, আণবিক অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানের মনে যথেষ্ট ভয় রয়েছে। ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটি মনে করে যে কোনও দিন তাঁদের থেকে ওই হাতিয়ার ছিনিয়ে নেবে নয়াদিল্লি। সূত্রের খবর, সেই কারণে নূর খানে হামলা হতেই প্রমাদ গোনে ইসলামাবাদ। ফলে সংঘর্ষবিরতির বিষয়ে আলোচনা চালাতে থাকেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা।
পাক বিমানবাহিনীর লড়াকু জেটের বিরাট বহর রয়েছে নূর খান ঘাঁটিতে। মাঝ-আকাশের জ্বালানি সরবরাহের বিমানও এই ছাউনিতে রেখেছে ইসলামাবাদ। সংঘর্ষবিরতির পর সংশ্লিষ্ট ঘাঁটির উপগ্রহচিত্র প্রকাশ করে ভারতীয় বায়ুসেনা। সেখানে নূর খানের একাংশ উড়ে যাওয়ার স্পষ্ট ছবি দেখা গিয়েছে।
কৌশলগত দিক থেকে নূর খান ঘাঁটির গুরুত্ব অপরিসীম। বেনজির ভুট্টো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটিকে ঘিরে রেখেছে এটি। সংশ্লিষ্ট ছাউনির ভিতরে রয়েছে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ কলেজ।
বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, পাক বায়ুসেনার রসদ সরবরাহের প্রাণকেন্দ্র হল নূর খান বিমানঘাঁটি। সারাবছর এখানে মোতায়েন থাকে সি-১৩০ হারকিউলিস এবং সিএন-২৩৫-এর মতো মালবাহী ফৌজি বিমান। এগুলির মাধ্যমে এখান থেকেই পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের (পাকিস্তান অকুপায়েড কাশ্মীর বা পিওজেকে) রসদ এবং সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে থাকে ইসলামাবাদের বিমানবাহিনী।
পাশাপাশি, আকাশপথে নজরদারি ও প্রত্যাঘাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘এয়ার মোবিলিটি উইং’ এবং ‘এয়ার ডিফেন্স কমান্ড’-এর সদর দফতরও রয়েছে নূর খান বিমানঘাঁটিতে। সেখানে আঘাত হানায় পাক বায়ুসেনার কোমর ভেঙে গিয়েছে বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ। ইসলামাবাদ ইতিমধ্যেই চিনের তৈরি দু’টি জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান ধ্বংস হওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছে।
নূর খানের পাশাপাশি পাকিস্তানের সরগোধা বায়ুসেনাঘাঁটিতেও হামলা চালায় ভারতীয় বিমানবাহিনী। এই ছাউনি সংলগ্ন কিরানা পাহাড়েও (পড়ুন কিরানা হিল্স) নাকি রয়েছে ইসলামাবাদের পরমাণু হাতিয়ারের অস্ত্রাগার। সেখানেও নয়াদিল্লির আকাশ-যোদ্ধারা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে বলে সমাজমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে। যদিও তা খারিজ করেছে ভারতীয় বায়ুসেনা।
বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ খোলেন ডিরেক্টর জেনারেল অফ এয়ার অপারেশন্স পদে থাকা এয়ার মার্শাল একে ভারতী। তিনি বলেন, ‘‘কিরানা পাহাড় হোক বা অন্য কোনও জায়গা, পাকিস্তান যেখানেই পরমাণু হাতিয়ার রেখে থাকুক না কেন, সেখানে কোনও হামলা চালানো হয়নি। সেগুলো আমাদের লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল না।’’
বিশ্লেষকেরা অবশ্য মনে করেন, একের পর এক বায়ুসেনার ছাউনি গুঁড়িয়ে যাওয়ায় চাপে পড়ে পাকিস্তান। নূর খানে হামলা আটকাতে ব্যর্থ হওয়ায় রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতরও যে মোটেই নিরাপদ নয়, তা স্পষ্ট বুঝে যান ইসলামাবাদের ফৌজি অফিসারেরা। সেই কারণে ১০ মে ভারতের ডিজিএমও-কে (ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশন্স) ফোন করেন পাকিস্তানের ডিজিএমও।
ওই ফোনালাপেই পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের সংঘর্ষবিরতির রাস্তা খুলে যায়। এতে অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আমেরিকা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ সংঘর্ষবিরতির কথা জানিয়ে একটি পোস্ট করেন। তার কিছু ক্ষণ পর এই নিয়ে সরকারি ভাবে বিবৃতি দেন ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রী।
কিন্তু, এক দিনের মাথাতেই গোটা বিষয়টি অস্বীকার করে পাকিস্তান। ইসলামাবাদের দাবি, সংঘর্ষবিরতির জন্য তাদের তরফে কোনও আবেদন করা হয়নি। পাক ফৌজের জনসংযোগ শাখার (ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন বা আইএসপিআর) মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধরি বলেন, ‘‘লিখে রাখুন যে, আমরা সংঘর্ষবিরতির জন্য কোনও অনুরোধ করিনি।’’
পাক সেনাবাহিনীর দাবি, পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের জায়গা থাকতে পারে না। আর তাই সংঘাতের পরিস্থিতি ‘পরিণত ভাবে’ সামলেছে ইসলামাবাদ। আক্রমণের ‘তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করে জবাব’ দেওয়া হয়েছে। ভারতের বায়ুসেনা ঘাঁটিতে হামলা করা হয়েছে বলেও দাবি করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধরি।
অন্য দিকে ভারতীয় সেনা জানিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানের কোনও যুদ্ধবিমান এ দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করতে পারেনি। ইসলামাবাদের যাবতীয় ড্রোন হামলা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। অর্থাৎ, এককথায় ভারতের সামরিক সম্পত্তির তেমন কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতির পর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ। তিনি মনে করেন দুই দেশের বিবাদের মূলেই রয়েছে সন্ত্রাসবাদ, কাশ্মীর এবং জল— এই তিন সমস্যা। আলোচনার মাধ্যমে এগুলি সমাধানের বার্তা দিয়েছেন তিনি। এতে নয়াদিল্লি আদৌ রাজি হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।