‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা সংঘর্ষে পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রভান্ডারকে নিশানা করেছে নয়াদিল্লি? ভারতীয় বায়ুসেনার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে শুরু হয়েছে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ? বিষয়টি নিয়ে ইসলামাবাদ মুখে কুলুপ এঁটেছে। পরমাণু অস্ত্রভান্ডারে হামলা করা হয়নি বলে জানিয়েছে ভারতীয় সেনাও। কিন্তু ‘যুদ্ধ’ থামতেই এই সমস্ত প্রশ্নে সরগরম গোটা দুনিয়া।
‘অপারেশন সিঁদুর’-পরবর্তী সংঘাতে একাধিক পাক বায়ুসেনাঘাঁটিকে নিশানা করে ভারতীয় বিমানবাহিনী। সেই তালিকায় ছিল নূর খান এবং সরগোধা। এর মধ্যে প্রথমটি রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। সূত্রের খবর, সেখানে রয়েছে ইসলামাবাদের অন্যতম বড় আণবিক অস্ত্রভান্ডার। এ হেন নূর খান ঘাঁটিতে হামলা হওয়ায় উদ্বিগ্ন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ।
পাক বিমানবাহিনীর সরগোধা ছাউনিটির গুরুত্বও নেহাত কম নয়। এর ২০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে কিরানা পাহাড় (কিরানা হিল্স) এবং মুশাফ বিমানঘাঁটি। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ওই এলাকাতেও রয়েছে ইসলামাবাদের পরমাণু অস্ত্রভান্ডার। সেই কারণেই সেখানে এফ-১৬ এবং জেএফ-১৭র মতো অত্যাধুনিক লড়াকু জেট মোতায়েন রেখেছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারেরা।
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, নিখুঁত নিশানায় ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফলে ক্ষতি হয়েছে নূর খান ছাউনির ভূগর্ভস্থ পরমাণু অস্ত্রভান্ডারের। সেখানে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হওয়ার আশঙ্কাকে একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা। তবে সরগোধা বা কিরানা হিল্সের আণবিক অস্ত্রভান্ডার থেকে এই ধরনের বিকিরণের আশঙ্কা কম বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে পাকিস্তানে কোনও আণবিক বিকিরণ হয়েছে কি না, তা নিয়ে সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি দেয়নি ‘আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা’ (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি বা আইএইএ)। স্থানীয় অনলাইন ব্যবহারকারী এবং ‘ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স’-এর বিশ্লেষকদের দাবি, ওই এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাব দেখা গিয়েছে। সেই কারণে দ্রুত তাঁদের অন্যত্র স্থানান্তরিত করছে ইসলামাবাদ।
এই আবহে আমেরিকার বিচক্রাফ্ট বি৩৫০ ‘এরিয়াল মেজারিং সিস্টেম’ বিমান ইসলামাবাদে অবতরণ করায়, অনেকেই দু’য়ে দু’য়ে চার করেছেন। সংশ্লিষ্ট বিমানটির গতিবিধি ‘ফ্লাইটট্রেডার২৪’ নামের ট্র্যাকারে ধরা পড়ে। সাধারণত কোনও জায়গায় পরমাণু বিস্ফোরণ বা দুর্ঘটনা ঘটলে, বিপদের গুরুত্ব বুঝতে এই বিমানটি ব্যবহার করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এই সমস্ত তথ্যের সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার ডট কম। কোনও দেশের তরফেই এই বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
সূত্রের খবর, মার্কিন জ্বালানি বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন যে বিচক্রাফ্ট বিমানটি ইসলামাবাদে নামে, তার নম্বর ছিল ‘এন১১১এসজেড’। জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু বিপর্যয়ের সময় এটিকে ব্যবহার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিমানটিতে রয়েছে গামা রে সেন্সর এবং রিয়্যাল টাইম ম্যাপিংয়ের সরঞ্জাম। যদিও পাকিস্তানে এর অবতরণ নিয়ে সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি দেয়নি ওয়াশিংটন।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, কম উচ্চতায় ওড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন যুক্তরাষ্ট্রের বিচক্রাফ্ট বিমানটি স্থল এবং বাতাসে তেজস্ক্রিয় দূষণ শনাক্ত করতে সক্ষম। পরমাণু বিস্ফোরণ বা তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটলে বাতাসে মিশে যায় বেশ কিছু তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ। সেগুলিকেও সহজে চিনতে পারে মার্কিন জ্বালানি বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন ওই বিমান। হঠাৎ করে তার ইসলামাবাদে যাওয়ার খবরকে কেন্দ্র করে সন্দেহ দানা বেঁধেছে।
এ ব্যাপারে নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে মুখ খুলেছেন মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএর সাবেক অফিসার ডেরেক গ্রসম্যান। তাঁর কথায়, ‘‘নূর খানে যে ভাবে ভারত নিখুঁত নিশানায় একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, তাতে এর পরমাণু অস্ত্রভান্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ষোলো আনা আশঙ্কা রয়েছে।’’ সেখানে আণবিক ‘লিকেজ’ শুরু হয়েছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, পাক বায়ুসেনা ছাউনিগুলিতে ভারতের হামলার পরই সেখানে যায় মিশরের একটি সামরিক পরিবহণ বিমান। ইসলামাবাদ থেকে বেশ কিছুটা দূরে মুড়ি ঘাঁটিতে অবতরণ করে সেটি। সমাজমাধ্যমের একাধিক পোস্টে দাবি করা হয়েছে, ওই বিমানে বোরন ছিল, যা তেজস্ত্রিয় বিকিরণ বন্ধ করতে বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়।
পাক সেনা ছাউনিগুলির মধ্যে কিরানা পাহাড়কে সবচেয়ে সুরক্ষিত বলে মনে করা হয়। সূত্রের খবর, সেখানে ১০টির বেশি ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক সুড়ঙ্গ রয়েছে। খুশাব পারমাণবিক কমপ্লেক্স থেকে এর দূরত্ব মেরেকেটে ৭৫ কিলোমিটার। ওই ঘাঁটিতে প্লুটোনিয়াম বোমা উৎপাদনের যাবতীয় সুব্যবস্থা রয়েছে বলে মনে করা হয়।
গত ৮ এবং ৯ মে মধ্যরাতে পাকিস্তানের একাধিক বায়ুসেনা ছাউনিতে হামলা চালায় ভারতীয় বিমানবাহিনী। পরে তার ভিডিয়ো এবং উপগ্রহচিত্র প্রকাশ করে নয়াদিল্লি। সেখানে নূর খান এবং সরগোধা ছাউনিতে যে ভাল রকমের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। বিষয়টি মেনেও নিয়েছে রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারেরা।
তবে ওই হামলার সময়ে পরমাণু অস্ত্রভান্ডারকে নিশানা করা হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা। ডিরেক্টর জেনারেল অফ এয়ার অপারেশন এয়ার মার্শাল ভারতী জানিয়েছেন, লক্ষ্য নির্দিষ্ট হওয়ার পর হামলা করা হয়। তবে কিরানা হিল্সে কোনও আক্রমণ শানানো হয়নি।
অন্য দিকে, ভারত-পাকিস্তান সংঘাত ‘নাটকীয় মোড়’ নিতে পারে বলে গোয়েন্দা তথ্য পায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে সে কথা জানায় তারা। এর পরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স। তাঁর ওই পদক্ষেপের এক দিনের মাথাতেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে পরমাণু শক্তিধর দুই দেশ।
মার্কিন প্রশাসনের একাংশ সিএনএনকে জানিয়েছে, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের উপর কড়া নজর রাখছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভান্স, বিদেশ সচিব মার্কো রুবিয়ো, হোয়াইট হাউস চিফ অফ স্টাফ সুসি উইলিস। প্রাথমিক ভাবে এ ব্যাপারে ‘নাক না গলানো’র সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই গোয়েন্দা রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরই নড়েচড়ে বসে ওয়াশিংটন। দ্রুত লড়াই থামাতে উদ্যোগী হন তাঁরা।
এর পরই ওই গোয়েন্দা রিপোর্টে কী ছিল, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে যায়। ট্রাম্প প্রশাসনের কেউই অবশ্য এই নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। তাঁদের সাফ কথা, বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। আর তাই এ ব্যাপারে তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের বড় অংশই মনে করেন নূর খান বায়ুসেনাঘাঁটিতে হামলার জেরে পাক বিমানবাহিনীর কোমর ভেঙে যায়। সেই কারণে তড়িঘড়ি ভারতের ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশনসকে (ডিজিএমও) ফোন করে যুদ্ধবিরতির দাবি জানান ইসলামাবাদের ডিজিএমও। ফলে ১০ মে লড়াইয়ে দাঁড়ি টানে দুই দেশ। যদিও ডিজিএমও পর্যায়ে ফোনালাপে সংঘর্ষবিরতির আবেদনের কথা অস্বীকার করেছে পাকিস্তান।
ইসলামাবাদে মার্কিন এবং মিশরীয় ফৌজি বিমান যাওয়ার আবার অন্য একটি ব্যাখ্যাও সামনে এসেছে। সেটা হল, ভারতীয় বিমানবাহিনীর তাণ্ডবে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাকিস্তানের একাধিক বায়ুসেনাঘাঁটি। সেই লোকসানের হিসাব কষতেই বহির্শক্তির সাহায্য নিয়েছে ইসলামাবাদ।
কিন্তু, এত কিছুর পরেও সন্দেহ যাচ্ছে না। যুদ্ধবিরতির পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, ‘‘পাকিস্তানের পরমাণু হুমকি আর সহ্য করবে না ভারত।’’ এ বারও কি সেটা দেওয়ার চেষ্টা করে ইসলামাবাদ? আর তখনই তাদের পরমাণু অস্ত্রভান্ডারকে নিশানা করে রাফাল-সুখোইয়ের ককপিটে থাকা ভারতের যোদ্ধা-পাইলটেরা? এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।