ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখার কথা চিন্তা করে অনেকেই আয়ের কিছুটা অংশ বিমায় বিনিয়োগ করে থাকেন। বাজারে এমন বহু সংস্থা রয়েছে, যারা বিমা করানোর জন্য মুখিয়ে থাকে। তবে সাবধান! বাজারে এমন প্রতারক ঘুরছে যাদের কাছ থেকে বিমা করলে প্রাণ যেতে পারে আপনার।
বেশ কিছু বছর ধরে এমনই কিছু ঘটনা সামনে এসেছে উত্তরপ্রদেশের সম্ভল, অমরোহা, বদায়ুঁ, মুরাদাবাদে। কোটি কোটি টাকার বিমা করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন বেশ কয়েক জন।
অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের বিমা-প্রতারণার মূল নিশানা করত একটি সংগঠিত চক্র। মূলত অনাথ, পরিবারহীন মানুষকেই নিশানা করত ওই জালিয়াতি দলের সদস্যেরা। প্রতারকদলের কাছে থাকত বহু ভুয়ো মানুষের ভুয়ো নথিও।
নিম্নবিত্ত নিরাশ্রয় মানুষকে প্রথমে ভরসা দিত ওই জালিয়াতি দল। কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করে দিত তাঁরা। তার পরই কোটি, দু’কোটি টাকার জীবনবিমা করানো হত। কিন্তু দেখা যেত, বিমা করানোর কিছু মাস পরেই সেই ব্যক্তির মৃত্যু ঘটছে।
উত্তরপ্রদেশের সম্ভল জেলাতেই মূলত এমন একটি বিমা প্রতারণার কাণ্ড ফাঁস হয়েছে। যেখানে ভুয়ো পলিসি, নকল নথি, এমনকি মানুষ খুন করেও বিমা সংস্থার কাছ থেকে মোটা টাকা হাতানোর অভিযোগও উঠেছে।
শুধু জীবনবিমা নয়, স্বাস্থ্যবিমার ক্ষেত্রেও জালিয়াতির খবর উঠে এসেছে। তথ্য বলছে, ওই চক্রের সদস্যেরা কখনও মৃত ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে, কখনও ভুয়ো নামের কোনও ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে টাকা আদায়ের নথি বিমা সংস্থার কাছে জমা দিত। বিমা সংস্থাগুলিও বুঝতে পারত না ওই নথিগুলি সব ক’টিই জাল।
প্রাথমিক ভাবে সম্ভল ও আশপাশের জেলায় চলতে থাকা বিমা জালিয়াতি চক্র পুলিশের নজরে আসেনি। কিছু সময় পরে একই এলাকায় দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকে। কিছু মৃত্যুকে দুর্ঘটনা দেখানোর চেষ্টা হলেও মৃত্যুর ধরন দেখে পুলিশ সন্দেহ করতে শুরু করে। পুলিশের মনে হচ্ছিল এই ঘটনাগুলি আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত।
পুলিশ তখন আবার সব দুর্ঘটনার তদন্ত শুরু করে। আর তাতেই উঠে আসে চমকে যাওয়ার মতো তথ্য। সন্দেহভাজনদের ওপর কড়া নজরদারি শুরু করা হয়। হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকর্মী ও আশাকর্মীদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বিমা সংস্থাগুলির কাছ থেকেও নথি চাওয়া হয়।
সেখানেই উঠে আসে একাধিক তথ্য। জানা যায়, জালিয়াতির কাণ্ডে কোনও ছোট দল কাজ করছে না। বরং এঁদের বিস্তৃতি অনেকটা। সূত্রের খবর, হাসপাতালের আশাকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মীরাও নাকি যুক্ত রয়েছেন এই প্রতারণা কাণ্ডে।
পুলিশ সূত্রে খবর, ২০২২ সালে সালিম খান নামে উত্তরপ্রদেশের এক ব্যক্তিকে খুন করে এই জালিয়াতি সংগঠন। ২২ বছরের ছেলেটির প্রথমে জীবনবিমা করানো হয়েছিল। তার কিছু দিন পরেই একটি গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। পরে প্রতারকেরা এই ঘটনাকে দুর্ঘটনা হিসাবে দেখিয়েছিল।
একই ঘটনা ঘটেছিল অমন কুমারের সঙ্গে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে অমন নাকি চক্রের সদস্যদের মধ্যে কারও আত্মীয় ছিলেন। বিমা করানোর কিছু দিন পর সালিমের মতো তাঁকেও গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলা হয়।
এমনই আরও অনেক হত্যাকাণ্ডের তথ্য উঠে এসেছে। বিমা সংস্থা থেকে পাওয়া নথি খতিয়ে দেখে পুলিশ জানতে পারে যে, সব ক’টি খুনের ঘটনারই কিছু না কিছু মিল রয়েছে।
সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত চারটি হত্যা সংক্রান্ত এফআইআর দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে দু’টি হত্যাকাণ্ড নিশ্চিত ভাবে খুন প্রমাণিত হয়েছে। তা ছাড়া ২৯টি ভুয়ো মৃত্যু সনদও ধরা পড়েছে। যদিও এখনও তদন্ত পুরোপুরি শেষ হয়নি।
একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ভুয়ো চক্রব্যূহে প্রতারকেরা প্রতিটি আক্রান্ত বা নিহত ব্যক্তির নামে ৫১ লাখ থেকে ৯৫ লাখ টাকার দাবি করেছে বিমা সংস্থা থেকে। যদিও সঠিক তথ্য তদন্ত শেষের পরই সামনে আসবে।
চলতি বছরের শুরু থেকেই এই চক্রের উপর নজরদারি চালাচ্ছিল পুলিশ। এখনও পর্যন্ত ৫২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে খবর। পুলিশের অনুমান, পলাতক এখনও ৫০ জনের বেশি। প্রতারণার আকার ১০০ কোটি ছাড়াতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই ঘটনায় তল্লাশি চালাচ্ছেন ইডির তদন্তকারী আধিকারিকেরাও। অর্থ লেনদেন খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ ছাড়াও আর কোন কোন রাজ্যে এই চক্রান্তকারী দল হানা দিয়েছে সেই খোঁজে রয়েছে ইডি।