অবসরের পর অনেকই পড়েন আর্থিক সঙ্কটে। মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংসার চালানো ষাটোর্ধ্বদের পক্ষে বেশ কঠিন। আর তাই চাকরিজীবনের পরের ২৫ বছরের কথা মাথায় রেখে আগে থেকে লগ্নির পরামর্শ দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। কারণ, এতে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আরামে জীবন কাটাতে পারবেন তাঁরা।
বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট একটি জায়গায় লগ্নি করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। তাঁদের কথায়, গ্রাহকের পোর্টফোলিওতে সব সময় বৈচিত্র থাকতে হবে। তা ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করলে ভাল রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা।
সাধারণ ভাবে অবসরের ২৫ বছর পর্যন্ত রিটার্ন বাবদ কত টাকা হাতে আসবে, সেটা মাথায় রেখে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। এ ক্ষেত্রে অবসরের পর ছ’শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির হার বজায় থাকবে ভেবে নিয়ে লগ্নিতে এগিয়ে যেতে বলছেন তাঁরা।
অবসর-পরবর্তী জীবনের কথা ভেবে লগ্নি করতে চলা গ্রাহকের বিনিয়োগকে মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন আর্থিক বিশেষজ্ঞেরা। সেগুলি হল, ঋণপত্র, হাইব্রিড মিউচুয়াল ফান্ড এবং ইকুইটি বা শেয়ার। ষাট-পরবর্তী জীবন দুর্দান্ত ভাবে কাটাতে ৩.৬৫ কোটি টাকা লগ্নির পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
অবসর-পরবর্তী প্রথম দু’বছরের কথা ভেবে লগ্নিকারী ঋণপত্রে ৫০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন। এর দু’বছর এবং শেষের চার বছর (অর্থাৎ ২১ থেকে ২৫ তম বছর পর্যন্ত) হাইব্রিড মিউচুয়াল ফান্ড থেকে টাকা তুলে আরামে জীবন কাটাতে পারেন তিনি। এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে এক কোটি টাকা।
এ ছাড়া মাঝের ১৮ বছরের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ২.২৫ কোটি টাকা ইকুইটি বা শেয়ারে বিনিয়োগ করা উচিত বলে মনে করেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তবে মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধি পেলেও অবসরের পর খুব একটা সমস্যায় পড়বেন না তিনি। প্রতি মাসে বা নির্ধারিত সময় অন্তর মোটা টাকা তুলতে বা খরচ করতে পারবেন ওই ব্যক্তি।
বিশ্লেষকেরা অবশ্য বিনিয়োগের আগে রিটার্নের বিষয়টি হিসাব করতে বলেছেন। ঋণপত্র থেকে পাঁচ শতাংশ, হাইব্রিড মিউচুয়াল ফান্ড থেকে সাত শতাংশ এবং ইকুইটি থেকে অন্তত ১০.৫ শতাংশ লাভ করতে হবে সংশ্লিষ্ট লগ্নিকারীকে।
মুদ্রাস্ফীতির হার অনুযায়ী, একটি আর্থিক বছরের প্রতি মাসে দু’লক্ষ টাকা করে খরচ হবে এটা ধরে নিয়ে লগ্নি করা উচিত। কারণে মুদ্রাস্ফীতির হার বছরে ছ’শতাংশ হলে ওই খরচের অঙ্ক মাসে দাঁড়াবে ৩.৩৭ লক্ষ টাকা। গ্রাহক নিজের তহবিল থেকে যত টাকা তুলে নেবেন, ততই সেটি দুর্বল হয়ে পড়বে। ফলে বিনিয়োগ করা তহবিলটিকেও উচ্চ হারে বৃদ্ধি পেতে হবে।
বিশেষজ্ঞেরা বলেছেন, ইকুইটি বা শেয়ার থেকে ভাল অঙ্কের রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ধরা যাক অবসরপ্রাপ্ত কোনও ব্যক্তির ৪.৩ কোটি টাকার একটি তহবিল রয়েছে। সেখান থেকে তিনি নিয়মিত টাকা তুলে নিলে সময়ে সময়ে মোটা অঙ্কের লগ্নিও করতে হবে তাঁকে।
বিনিয়োগকারী ইচ্ছা করলে রিয়েল এস্টেটে লগ্নি করতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে তাঁর আরও বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে। রিয়েল এস্টেটের শেয়ারের দর বৃদ্ধি বা কমার নেপথ্যে থাকে একাধিক কারণ। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এর থেকে লাভের সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ছাড়া অবসরের পর কিছু টাকা প্রথাগত জায়গায় বিনিয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। যেমন ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরের ফিক্সড ডিপোজ়িট বা টার্ম ডিপোজ়িট। কেউ সিনিয়র সিটিজেন সেভিংস স্কিমে লগ্নি করতে পারেন। এতে অতিরিক্ত সুদ পাওয়ার সুবিধা রয়েছে।
তবে আর্থিক বিশ্লেষকেরা অবসরের পর নিয়মিত মিউচুয়াল ফান্ড এবং শেয়ারে বিনিযোগ করে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। মিউচুয়াল ফান্ডে দু’ভাবে বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে। একটির নাম লাম্পসাম লগ্নি। দ্বিতীয়টিকে বলা হয় সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান বা এসআইপি।
লাম্পসামের ক্ষেত্রে গ্রাহককে একবারে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। সাধারণত বোনাস বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া টাকা আমজনতাকে এই খাতে লগ্নি করতে দেখা গিয়েছে। এতে ঝুঁকির মাত্রা অনেকটাই বেশি। এটি পুরোপুরি শেয়ার বাজারের উত্থান-পতনের উপর নির্ভরশীল।
অন্য দিকে একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর ধারাবাহিক ভাবে এসআইপিতে লগ্নি করতে হয়। তবে এক জন গ্রাহক ইচ্ছা করলে লাম্পসাম এবং এসআইপি— দু’টি ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ করতে পারেন। এসআইপিতে আর্থিক দিক থেকে লোকসানের আশঙ্কা তুলনামূলক ভাবে কম। আর তাই এতে লগ্নির পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
জনপ্রিয় এসআইপি প্রকল্পগুলিতে গ্রাহকদের প্রতি মাসে বিনিয়োগ করতে হয়। তবে দৈনিক, সাপ্তাহিক, ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক এবং বার্ষিক ভাবেও লগ্নির সুযোগ রয়েছে। সমস্ত সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানে দৈনিক, সাপ্তাহিক, ত্রৈমাসিক বা ছ’মাস অন্তর বিনিয়োগের সুবিধা নেই। এ ক্ষেত্রে লগ্নির আগে কত দিন অন্তর টাকা জমা করতে হবে, তা গ্রাহককে ভাল ভাবে জেনে নিতে হবে।
কোনও কারণে আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়লে এসআইপি বন্ধ করতে পারবেন গ্রাহক। পরে ফের নতুন করে এসআইপি চালু করার সুযোগ পাবেন তিনি। লগ্নিকারী ইচ্ছা করলে প্রতি ছ’মাস বা এক বছর অন্তর এসআইপিতে বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারেন। বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এটি করা গেলে বলা বাহুল্য, বাড়বে রিটার্নের অঙ্ক।
এসআইপিতে লগ্নির ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও সময়ের ব্যাপার নেই। বছরের যে কোনও সময়েই এতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। এসআইপির মাধ্যমে একজন গ্রাহক মিউচুয়াল ফান্ডের নিট সম্পদ মূল্য বা নেট অ্যাসেট ভ্যালু ইউনিট কিনে থাকেন। এর দাম প্রতি দিন পরিবর্তিত হয়।
তবে শেয়ার বাজার এবং মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি বাজারগত ঝুঁকিসাপেক্ষ। আর তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনেই এগুলিতে বিনিয়োগ করুন। এতে আর্থিক ভাবে লোকসান হলে আনন্দবাজার অনলাইন কর্তৃপক্ষ কোনও ভাবেই দায়ী নয়।