ফের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার নিশানায় ইরান। রাষ্ট্রপুঞ্জের কাঁধে ভর করে সাবেক পারস্য দেশটির পায়ে কড়া নিষেধাজ্ঞার বেড়ি পরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে তারা। শত চেষ্টা করেও সেই ষড়যন্ত্র আটকাতে ব্যর্থ রাশিয়া এবং চিন। অন্য দিকে রাষ্ট্রপুঞ্জের এই সিদ্ধান্তের জেরে রক্তচাপ বেড়েছে ভারতেরও। কারণ, পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে এত দিন মধ্য এশিয়ায় যাওয়ার ক্ষেত্রে শিয়া মুলুকটিকে ব্যবহার করছিল নয়াদিল্লি। এ বার তা চিরতরে বন্ধ হতে পারে বলে মনে করছেন দুঁদে কূটনীতিকদের একাংশ।
বিশ্লেষকদের দাবি, ইরানের উপর রাষ্ট্রপুঞ্জের নিষেধাজ্ঞার দ্বিমুখী প্রভাব ভারতের উপরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রথমত, ১০ বছরের চুক্তিতে চাবাহার সমুদ্রবন্দরটি নয়াদিল্লিকে যৌথ ভাবে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে সাবেক পারস্য দেশের সরকার। এর সংস্কারে বিপুল অঙ্কের টাকাও খরচ করেছে কেন্দ্র। গত কয়েক বছরে পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের ‘প্রবেশদ্বার’ হিসাবে সংশ্লিষ্ট বন্দরটিকে গড়ে তুলতে তেমন সমস্যা হয়নি।
কিন্তু, ইরানের উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা নয়াদিল্লির যাবতীয় পরিকল্পনায় যে জল ঢালতে পারে, তা বলাই বাহুল্য। বিশ্লেষকদের দাবি, আগামী দিনে আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনও বিকল্প রাস্তার খোঁজ পেতে হবে। ভারতের কাছে তা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। এ ছাড়া সুয়েজ় খালকে এড়িয়ে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য আরও একটি রাস্তা রয়েছে, নাম ‘আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহণ বারান্দা’ বা আইএনএসটিসি (ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর)। সেই পথও বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকে।
৭,২০০ কিলোমিটার লম্বা আইএনএসটিসি এ দেশের বাণিজ্য নগরী মুম্বইকে জুড়েছে রুশ রাজধানী মস্কোর সঙ্গে। সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক বারান্দাটিতে রয়েছে একাধিক বন্দর, সড়ক এবং রেলপথ। এর মাধ্যমে জুড়ে গিয়েছে কাস্পিয়ান সাগর ও পারস্য উপসাগর। কিন্তু, তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল ‘আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহণ বারান্দা’র বড় অংশ গিয়েছে ইরানের উপর দিয়ে। এই রাস্তা ব্যবহার করতে হলে শিয়া মুলুকটির বন্দর আব্বাস এবং রাজধানী তেহরানের উপর দিয়ে নিয়ে যেতে হবে পণ্য।
বর্তমানে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে চাবাহার ও আইএনএসটিসি। দ্বিতীয় রাস্তাটি নয়াদিল্লির পণ্যকে ওমান, তুর্কমেনিস্তান, উজ়বেকিস্তান, কাজ়াখস্তান এবং আজ়ারবাইজানে পৌঁছে দিতে সাহায্য করছিল। অন্য দিকে চাবাহারের খুব কাছেই রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের বালোচিস্তান প্রদেশের অন্তর্গত গ্বদর বন্দর। ইসলামাবাদ তা একরকম চিনের হাতে তুলে দিয়েছে। ফলে আরব সাগরীয় এলাকায় বেজিঙের দাপট বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
আর তাই গ্বদর বন্দরে চিনের উপর নজর রাখতে চাবাহারকে সামনে রেখে ‘কৌশলগত অবস্থান’ নিয়েছিল ভারত। নতুন নিষেধাজ্ঞার জেরে সেখানেও সমস্যা হবে নয়াদিল্লির। সম্প্রতি ইরানকে ‘কোণঠাসা’ করতে চাবাহার বন্দরে অন্য দেশগুলিকে দেওয়া ছাড় প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমেরিকা। ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে তা কার্যকর করেছে ওয়াশিংটন। ফলে সংশ্লিষ্ট বন্দরটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে জরিমানা দিতে হচ্ছিল ভারতকে। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো এ বার রাষ্ট্রপুঞ্জের নিষেধাজ্ঞা চাপল সাবেক পারস্য দেশটির উপর।
দীর্ঘ দিন ধরেই পরমাণু হাতিয়ার তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে ইরান। সেই লক্ষ্যে গোপনে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ বাড়িয়েছে তেহরান। বিষয়টি নজরে আসতেই প্রমাদ গোনে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। গণবিধ্বংসী হাতিয়ার তৈরি থেকে আটকাতে সাবেক পারস্য দেশটির উপর বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় তারা। ২০১৫ সালে শিয়া মুলুকটির সঙ্গে একটি বিশেষ সমঝোতা করে পশ্চিমি দুনিয়ার ছ’টি দেশ। এর পোশাকি নাম ছিল ‘জেসিপোয়া’ (জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন)
ইরানের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়া দেশগুলির তালিকায় ছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্য (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চিন) এবং জার্মানি। ওই চুক্তির ফলে পশ্চিমি দুনিয়ার অধিকাংশ নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পায় তেহরান। বিনিময়ে পরমাণু অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সাবেক পারস্য দেশ। বাস্তবে শিয়া মুলুকটি সেটা মেনে চলছে কি না, তা সুনিশ্চিত করতে জেসিপোয়ার মধ্যেই ‘স্ন্যাপব্যাক’ নামের একটি নিয়ম রাখা হয়েছিল।
তেহরানের সঙ্গে জেসিপোয়া সমঝোতার সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক হুসেন ওবামা। তাঁর যুক্তি ছিল নিষেধাজ্ঞা থেকে কিছুটা মুক্তি পেলে পরমাণু বোমা তৈরির লক্ষ্য থেকে সরে আসবে ইরান। তবে এর পরেও সাবেক পারস্য দেশটি বেপরোয়া ভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণের কাজ চালিয়ে গেলে ‘স্ন্যাপব্যাক’ নিয়মটি প্রয়োগ করে ফের ওই নিষেধাজ্ঞা চাপাতে পারবে সংশ্লিষ্ট ছ’টি দেশ। এই ইস্যুতে রাশিয়া ও চিনের হাতে কোনও ‘ভিটো’ ক্ষমতা থাকবে না বলে ঠিক হয়েছিল।
রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা ‘ভিটো’ ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। সংশ্লিষ্ট সদস্য রাষ্ট্রগুলির যে কেউ কোনও প্রস্তাবে ভিটো দিলে সেটি আর পাশ করানো যায় না ওই আন্তর্জাতিক সংগঠনে। গত অগস্টে ‘স্ন্যাপব্যাক’কে সামনে রেখে ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞার দাবি তোলে ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং জার্মানি। তাদের অভিযোগ, পরমাণু বোমা তৈরি করতে লাগাতার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ করে যাচ্ছে তেহরান। ভিটো না থাকার কারণে বিষয়টি আটকাতে পারেনি মস্কো ও বেজিং।
চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে ইরানের উপর জারি হয়েছে পশ্চিমি দুনিয়ার নিষেধাজ্ঞা। ফলে বিশ্বের কোনও দেশের সঙ্গে অত্যাধুনিক হাতিয়ার এবং তার প্রযুক্তির আমদানি-রফতানি করতে পারবে না তেহরান। বাজেয়াপ্ত করা হবে সাবেক পারস্য দেশটির বিদেশে থাকা সম্পত্তি। এ ছাড়া পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি ভাবে তাদের বন্ধ করতে বলা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের দাবি, সংশ্লিষ্ট নিষেধাজ্ঞার জেরে মারাত্মক ভাবে ইরানি অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য বিদেশি ব্যাঙ্কের সঙ্গে কোনও লেনদেন করতে পারবে না তেহরান। পাশাপাশি, সেখানকার বাসিন্দাদের ভিসা পেতে সমস্যা হবে। ইতিমধ্যেই ডলারের নিরিখে রেকর্ড নেমে গিয়েছে সাবেক পারস্য দেশটির মুদ্রার দর। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে চাল, তেল এবং মাখনের দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ।
মুদ্রাস্ফীতির এই হার ইরানের খাদ্য সুরক্ষায় আঘাত হানতে পারে। বেকারত্বের হার আরও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। ফলে ঘরোয়া রাজনীতিতে ঘন ঘন অশান্তির মুখে পড়তে পারে তেহরান। সাবেক পারস্য দেশটির সরকার অচিরেই গণবিক্ষোভের মুখে পড়তে চলেছে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। যদিও এর উল্টো যুক্তি রয়েছে। অনেকেরই ধারণা, প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে উপসাগরীয় শিয়া মুলুক।
দুঁদে কূটনীতিকেরা মনে করেন, নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে ইরানকে রাশিয়া ও চিনের আরও কাছাকাছি যেতে সাহায্য করল পশ্চিমি বিশ্ব। ফলে আগামী দিনে বেশ কিছু কড়া সিদ্ধান্ত নিতে পারে তেহরান। সাবেক পারস্য দেশটির পরমাণু কর্মসূচির উপর কড়া নজর রেখেছে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি’ বা আইএইএ। সংশ্লিষ্ট সংগঠনের কর্মীদের দেশে ঢোকা বন্ধ করার রাস্তা খোলা রয়েছে শিয়া মুলুকটির হাতে। তখন উপসাগরীয় দেশটি কী ধরনের আণবিক কর্মসূচি চালাচ্ছে, তা জানা দুষ্কর হবে।
১৯৭০ সালে ‘পারমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি’ বা এনপিটিতে (নিউক্লিয়ার নন প্রলিফারেশন ট্রিটি) সই করে ইরান। ফলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, তেহরানের আণবিক অস্ত্র তৈরি করার কথা নয়। এই নিষেধাজ্ঞার জেরে এ বার সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটির থেকে সাবেক পারস্য দেশটির বেরিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে শিয়া মুলুকটিকে চাপে রাখার যাবতীয় কৌশল ব্যর্থ হতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণ করা ইস্তক রাশিয়ার উপর ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি দুনিয়া। কিন্তু, তাতে মস্কোর অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে এমনটা নয়। উল্টে ভারত, চিন এবং বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশকে অপরিশোধিত খনিজ তেল এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি করছে ক্রেমলিন। বন্ধ হয়নি তাদের হাতিয়ারের ব্যবসাও।
একই কথা ইরানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তেহরানের ‘তরল সোনা’ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হল চিন। বেজিঙের বিপুল জ্বালানির প্রয়োজন রয়েছে। সেটা সংশ্লিষ্ট নিষেধাজ্ঞার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন না কেউই।
বর্তমানে ১০টি দেশের সংগঠন ‘ব্রিকস’-এর সদস্য পদ রয়েছে ইরানের। এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলি হল ভারত, রাশিয়া, চিন, ব্রাজ়িল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। নিষেধাজ্ঞা থেকে বাঁচাতে এরা প্রত্যেকেই নিজেদের স্বার্থে তেহরানের পাশে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে ‘স্ন্যাপব্যাক’-এর ঝাঁকুনি পশ্চিমি দুনিয়ার গায়ে কতটা লাগে সেটাই এখন দেখার।