US-Israel on Iran’s Nuclear Weapon

আমেরিকা-ইজ়রায়েলের স্বপ্নের ‘গুড়ে বালি’! সিরিয়া-ইরাকের মতো গর্তে না ঢুকে কেন ইরানের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাই বেশি?

ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে ইরানের তিনটি পরমাণুকেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে আমেরিকার কৌশলগত ‘স্টেল্‌থ’ বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’। এতে কি ইরাক এবং সিরিয়ার মতো পুরোপুরি ইরানের আণবিক বোমা তৈরির পরিকল্পনাকে ভেঙে দিতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্র? বিষয়টি নিয়ে দানা বাঁধছে সন্দেহ।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২৫ ১৫:৪৮
Share:
০১ ১৯

পশ্চিম এশিয়ার ‘গরম লোহা’য় মার্কিন ‘হাতুড়ির ঘা’ পড়তেই সব চুপ! আমেরিকার মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বন্ধ করেছে যুযুধান ইরান-ইজ়রায়েল। দু’পক্ষেরই দাবি, এই লড়াইয়ে শত্রুকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়া গিয়েছে। সংঘর্ষ থামায় স্বাভাবিক ভাবেই প্রকাশ্যে চলে এসেছে কয়েকটি প্রশ্ন। এ বার কি সত্যিই পরমাণু বোমা তৈরির পরিকল্পনা থেকে পুরোপুরি সরে আসবে তেহরান? ইহুদিভূমিকে নিশ্চিহ্ন করার পণে ইতি টানবে সাবেক পারস্য দেশ? শিয়া মুলুকটির ‘শরীরী ভাষা’য় এর কোনও লক্ষণই প্রকাশ্যে না আসায় বাড়ছে উদ্বেগ।

০২ ১৯

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, আমেরিকা এবং ইজ়রায়েলের যৌথ বোমাবর্ষণে ইরানের পরমাণু প্রকল্পগুলির যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এতে তেহরানের আণবিক বোমা তৈরির স্বপ্ন কয়েক বছর পিছিয়ে যেতে পারে। কিন্তু, তার অর্থ এই নয় যে, সাবেক পারস্য দেশটি কখনওই নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারবে না। কারণ, শিয়া মুলুকটির পরমাণু প্রকল্পগুলি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় সবগুলিকে ধ্বংস করা গিয়েছে, এমনটা নয়।

Advertisement
০৩ ১৯

তেহরান-তেল আভিভের মধ্যে যুদ্ধবিরতির পর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব কষতে বসে ইরানকে অনেকেই ইরাক এবং সিরিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। আরব দুনিয়ার এই দুই দেশের পরমাণু অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা চিরতরে মুছে দিয়েছে ইজ়রায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের দাবি, বাগদাদ এবং দামাস্কাসের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে সাবেক পারস্য দেশের। ফলে শিয়া মুলুকে বোমাবর্ষণে আমেরিকা যে বিরাট সাফল্য পেয়েছে, তা মানতে নারাজ তাঁরা।

০৪ ১৯

বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার রাজ্যের ডার্টমাউথ কলেজের পরমাণু বিশেষজ্ঞ নিকোলাস মিলার। ‘দ্য ইউরেশিয়ান টাইম্‌স’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলে তেহরান কখনওই পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা থেকে দূরে সরে আসবে না। উল্টে এর পর আরও মরিয়া ভাবে ওই মারণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাবে তারা। তাই ইরানের আণবিক কার্যকলাপে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।’’

০৫ ১৯

মিলারের এই দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু একেবারেই অমূলক নয়। ইরানের শিয়া ধর্মগুরু তথা ‘সর্বোচ্চ নেতা’ (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আলি খামেনেই পরমাণু কার্যকলাপ বন্ধ করার কোনও ইঙ্গিত দেননি। তা ছাড়া যুদ্ধে তেহরানের আণবিক কেন্দ্রগুলির যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা দ্রুত মেরামত করে ফেলতে পারবে তেহরান। কারণ, সেগুলি সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করেছিল পারস্য উপসাগরের তীরের ওই শিয়া মুলুক।

০৬ ১৯

চলতি বছরের ১২ জুন ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান মহম্মদ ইসলামি দাবি করেন যে, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণের জন্য আরও একটি গুপ্তঘাঁটি নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সে ক্ষেত্রে মার্কিন হামলার আগেই সমৃদ্ধ হওয়া উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইউরেনিয়াম ওই গুপ্তঘাঁটিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে আলি খামেনেইয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা তেহরানের বিশেষ আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসি।

০৭ ১৯

ইরানি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসলামি যে গুপ্তঘাঁটির কথা বলেছেন, সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তিতে সেটিকে তৈরি করা হয়েছে। ফলে ওই পরমাণু সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্রের নিরাপত্তা বলয় ভেদ করা অসম্ভব। তবে সেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণের সেন্ট্রিফিউজ় যন্ত্র বসানো হয়নি। এই যুদ্ধে ওই গুপ্তঘাঁটির কোনও ক্ষতি হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

০৮ ১৯

দ্বিতীয়ত, ইরান বা আমেরিকার আক্রমণে ইরানের কোনও পরমাণুকেন্দ্র থেকেই তেজস্ক্রিয় বিকিরণের খবর পাওয়া যায়নি। এতে আরও বেশি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, গত ১৩ জুন ইজ়রায়েলের প্রথম আক্রমণের পরই আইআরজিসির কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে, তাদের সমৃদ্ধ করা ইউরেনিয়াম নষ্ট করতে চাইছে ইহুদি ফৌজ। তা ছা়ড়া সাবেক পারস্য দেশে হামলা নিয়ে আগাম ইঙ্গিত দিয়ে দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

০৯ ১৯

এই পরিস্থিতিতে সন্দেহের তালিকার শীর্ষে থাকা ইরানি পরমাণুকেন্দ্রগুলিতেই সমৃদ্ধ হওয়া ইউরেনিয়াম আইআরজিসি রেখে দিয়েছিল, এই ধারণা কষ্টকল্পিত। উল্টে সেখান থেকে দ্রুত তা অন্য কোনও গুপ্তঘাঁটিতে সরিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেই কারণে মার্কিন ও ইজ়রায়েলি হামলায় আণবিক কেন্দ্রগুলির অবকাঠামো ধ্বংস হলেও তেহরানের তেমন লোকসান হয়নি। এখনও পরমাণু বোমা তৈরির সক্ষমতা রয়েছে তাদের, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

১০ ১৯

তৃতীয়ত, ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল বুশেহর আণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এবং বন্দর আব্বাস ইউরেনিয়াম উৎপাদন কেন্দ্র। এগুলির কোনওটাতেই হামলা চালায়নি ইজ়রায়েল বা আমেরিকা। ফলে উক্ত কেন্দ্রগুলিতেও বিপুল পরিমাণে সমৃদ্ধ হওয়া ইউরেনিয়াম থাকতে পারে। তেহরান যে সেগুলিকে মারণাস্ত্র তৈরির কাজে ব্যবহার করবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।

১১ ১৯

এই যুদ্ধে বেছে বেছে শিয়া মুলুকটির পরমাণুবিজ্ঞানীদের নিকেশ করেছে ইজ়রায়েল। এ ব্যাপারে ইহুদিদের গুপ্তচরবাহিনী মোসাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। কিন্তু, তাতে ইরানের পরমাণু বোমা তৈরির পরিকল্পনা আটকে যাবে, তা ভাবার কোনও কারণ নেই। ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর কৃত্রিম মেধাভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় ৭.৬২ মিলিমিটারের এফএন ম্যাগ মেশিনগান দিয়ে গুলি চালিয়ে মহসেন ফখরিজ়াদেহকে খতম করে তেল আভিভের গুপ্তচরেরা। কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে সংশ্লিষ্ট মেশিনগানটিকে চালানো হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন না মোসাদের কোনও এজেন্ট।

১২ ১৯

ফখরিজ়াদেহকে ইরানি পরমাণু প্রকল্পের জনক বলা যেতে পারে। অত্যন্ত গোপনে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ এবং আণবিক অস্ত্র তৈরির কাজ চালাচ্ছিলেন তিনি। ফলে তাঁর মৃত্যুর পর সব কিছু বন্ধ হবে বলে মনে করেছিল ইজ়রায়েল। যদিও বাস্তবে তা হয়নি। উল্টে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণে আরও গতি আনে পারস্য উপসাগরের তীরের ওই শিয়া মুলুক।

১৩ ১৯

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ইরাক এবং সিরিয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। ১৯৭৯ সালে ইরানে ‘ইসলামিক বিপ্লব’-এর এক বছরের মাথাতেই (পড়ুন ১৯৮০) তেহরান আক্রমণ করে বসে বাগদাদ। টানা আট বছর চলেছিল সেই যুদ্ধ। ১৯৯০ সালে কুয়েত দখলের চেষ্টা করে ইরাক। দু’টি ঘটনার সময়েই বাগদাদের কুর্সিতে ছিলেন সাদ্দাম হুসেন।

১৪ ১৯

বাগদাদের কুয়েত আক্রমণের মধ্যে দিয়ে সূচনা হয় উপসাগরীয় যুদ্ধের। ওই সময়ে ‘আগ্রাসী’ সাদ্দাম হুসেনের বিরুদ্ধে আরব দেশগুলির ক্ষোভ ছিল তুঙ্গে। কারণ, কুয়েতের খনিজ তেলের কূপগুলি দখল করতে চেয়েছিলেন তিনি। তা ছাড়া ঘরের মাটিতেও সাদ্দামের শত্রুর অভাব ছিল না। অনেকেই তাঁর ‘স্বৈরশাসন’ মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। এগুলিই উপসাগরীয় যুদ্ধে আমেরিকার জয়ের রাস্তা খুলে দিয়েছিল।

১৫ ১৯

প্রায় একই কথা সিরিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গত ১৩ বছর ধরে গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়েছে দামাস্কাস। রাশিয়া সমর্থিত সেখানকার বাশার অল-আসাদের সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল বিদ্রোহীদের দমন। সেটা করতে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের অভিযোগও ওঠে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পতন হয় বাশারের। গত বছরের ডিসেম্বরে দেশ ছেড়ে মস্কো চম্পট দেন আসাদ। দামাস্কাস দখল করে নতুন সরকার গঠন করে বিদ্রোহীরা। প্রেসিডেন্ট হন আহমেদ আল-শারা।

১৬ ১৯

বিশ্লেষকদের দাবি, ইরানের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। ইসলামিক বিপ্লবের পর কখনওই কোনও গৃহযুদ্ধের মুখে পড়েনি তেহরান। তা ছাড়া আরব রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সাবেক পারস্য দেশটির সম্পর্ক একেবারেই খারাপ নয়। উল্টে বার বার ধর্মীয় তাস এবং প্যালেস্টাইনকে সমর্থনের কথা বলে ইসলামীয় দুনিয়ায় আলাদা জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে তারা।

১৭ ১৯

আলি খামেনেইয়ের মতো কট্টরপন্থীদের নেতৃত্বাধীন ইরানের আমজনতার নানা ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে ক্ষোভ। সেই কারণে বার বার হিজ়াব-বিরোধী আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়েছে তেহরান। তবে সাবেক পারস্য দেশটির সুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক ইতিহাস থাকায়, পশ্চিমি উদারনৈতিক আদব-কায়দা গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় অংশের ইরানিদের আপত্তি রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, পরমাণু শক্তি অর্জনের ব্যাপারে দেশবাসীর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে আলি খামেনেইয়ের দিকে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

১৮ ১৯

তা ছাড়া ইজ়রায়েলি গুপ্তচরদের ‘টার্গেট কিলিং’য়ে একের পর এক পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যু হওয়ায় বিষয়টি উল্টো দিকে মোড় নিয়েছে। ওই হাতিয়ার তৈরির ব্যাপারে আরও অনড় অবস্থান নিয়ে ফেলেছে তেহরান। দীর্ঘ দিন ধরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে সাবেক পারস্য দেশটির অর্থনীতি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে আরও বেশি করে ‘এককাট্টা’ হওয়ার প্রবণতা দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে।

১৯ ১৯

যদিও এ সবের কোনও কিছুকেই আমল দিতে রাজি নন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাঁর দাবি, গত ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ‘স্টেল্‌থ’ বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’-এর বোমাবর্ষণে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছে ইরানের যাবতীয় পরমাণুকেন্দ্র। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা রিপোর্টকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। সংবাদমাধ্যম ‘সিএনএন’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানে বলা হয়েছে হামলায় তেহরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কয়েক মাস পিছিয়ে দেওয়া গিয়েছে। মোটেই পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা যায়নি।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement