৩৭ বছরের শাপমুক্তি। ফের ভারতের মাটিতে তৈরি হবে মাঝারি মাপের যাত্রিবাহী বিমান, ‘এসজে-১০০’। সেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই রুশ সংস্থা ‘ইউনাইটেড এয়ারক্র্যাফ্ট কর্পোরেশন’-এর (ইউএসি) সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে (পড়ুন মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং বা মউ) সই করেছে এ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড’ (হ্যাল)। এর মাধ্যমে ভারতীয় উড়ান সংস্থাগুলির জন্য ‘এসজে-১০০’ যাত্রিবাহী বিমান নির্মাণের স্বত্ত্ব পেয়েছে তারা।
চলতি বছরের ২৭ অক্টোবর মস্কোয় রুশ সংস্থা ইউএসির সঙ্গে মউ সই করে হ্যাল। এ দেশের যাত্রিবাহী বিমানের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটি ‘গেম চেঞ্জার’ হতে চলেছে বলে জানিয়েছে ওই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বিশ্বের দ্রুততম বৃদ্ধি পাওয়া উড়ান পরিষেবার বাজার রয়েছে ভারতে। এর জেরে এখানে বছর বছর লাফিয়ে বাড়ছে যাত্রীর সংখ্যা। সেই চাপ সামলাতে আগামী দিনে উড়ান সংস্থাগুলি যে বিমানের সংখ্যা বাড়াবে, তা বলাই বাহুল্য।
কেন্দ্রের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অভ্যন্তরে বর্তমানে বিমানযাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ১০ লক্ষে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই অঙ্ক ৩০ কোটিতে পৌঁছোবে বলে মনে করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে পরিষেবা সম্প্রসারণের জন্য আগামী এক দশকে (পড়ুন ২০২৫-’৩৫) প্রয়োজন পড়বে ২০০-র বেশি নতুন যাত্রিবাহী বিমানের। বর্তমানে যাত্রিবাহী উড়োজাহাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশ্বে আধিপত্য রয়েছে দু’টি সংস্থার। তারা হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং এবং ইউরোপের এয়ারবাস।
আর তাই অসামরিক উড়ান পরিবহণের ক্ষেত্রে পুরোপুরি ভাবে এই দুই সংস্থার উপর নির্ভরশীল নয়াদিল্লি। উদাহরণ হিসাবে দেশের দুই বৃহত্তম বিমান পরিষেবা সংস্থা ইন্ডিগো এবং এয়ার ইন্ডিয়ার কথা বলা যেতে পারে। গত দু’বছরে সংশ্লিষ্ট এই দুই সংস্থা বোয়িং এবং এয়ারবাসকে ১,১০০টিরও বেশি উড়োজাহাজের বরাত দিয়েছে। এর মধ্যে ইন্ডিগো পাবে ৫৬০টি বিমান। আর ৫৭০টি উড়োজাহাজ ব্যবহার করবে এয়ার ইন্ডিয়া। এতগুলি বিমান কেনার খরচ ১০ হাজার কোটি ডলার বলে জানা গিয়েছে।
এ-হেন পরিস্থিতিতে বোয়িং এবং এয়ারবাসের উপরের নির্ভরশীলতা কমাতে হ্যাল-ইউএসি মউকে কাজে লাগাতে চাইছে কেন্দ্র। সংশ্লিষ্ট উদ্যোগটির মাধ্যমে ভারতের অসামরিক বিমান পরিবহণ ক্ষেত্রকে ‘আত্মনির্ভর’ করে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। সম্প্রতি, অন্তর্দেশীয় উড়ান যোগাযোগকে আরও নিবিড় করতে ‘উড়ান’ নামের একটি প্রকল্প শুরু করেছে সরকার। এর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট রোগা চেহারার ‘এসজে-১০০’ বিমান তৈরি করবে হ্যাল।
রুশ সংস্থাটির সঙ্গে মউ সই করার পর গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিরক্ষা সংস্থা। সেখানে তারা বলেছে, ঘরের মাটিতে ‘এসজে-১০০’ নির্মাণ দেশীয় উড়ান পরিষেবার ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। ঘরোয়া পরিষেবার পাশাপাশি ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় স্বল্প দূরত্বের বিদেশি পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে যাতায়াতের জন্য এ দেশের উড়ান সংস্থাগুলির আরও ৩৫০টি বিমানের প্রয়োজন রয়েছে। সেই চাহিদা পূরণে হ্যাল যে কোমর বেঁধে নামছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
রুশ সংস্থা ইউএসির তৈরি ‘এসজে-১০০’ বোয়িংয়ের ‘ড্রিমলাইনার’-এর মতো বড় বিমান নয়। ২০০৮ সালে প্রথম বার আকাশে ওড়ে এই উড়োজাহাজ। তবে ২০১১ সালের আগে যাত্রী পরিষেবা শুরু করতে পারেনি ‘এসজে-১০০’। এর আসনসংখ্যা ৮৭ থেকে ১০৮। বর্তমানে ১৬টির বেশি বাণিজ্যিক উড়ান সংস্থায় পরিষেবা প্রদান করছে মস্কোর এই উড়োজাহাজ, যার ২০০-র বেশি মডেল তৈরি করে ফেলেছে ইউএসি। পূর্ব ইউরোপের বিমান নির্মাণকারী সংস্থাটির প্রথম বিদেশি গ্রাহক ছিল ‘মেক্সিকান ক্যারিয়ার ইন্টারজেট’।
২০১৩ সালে মেক্সিকোর উড়ান সংস্থাটির থেকে ২২টি উড়োজাহাজের বরাত পায় ইউএসি। পরবর্তী সময়ে আর্মেনিয়া, তাইল্যান্ড এবং কাজ়াখস্তানকেও ‘এসজে-১০০’ সরবরাহ করেছে তারা। তবে জন্মলগ্ন থেকেই রাশিয়ার ভিতরে যাত্রী পরিষেবার কাজে সর্বাধিক ব্যবহার হয়ে আসছে এই উড়োজাহাজ। সেই কাজে সংশ্লিষ্ট মডেলটির অন্তত ১৮০টি বিমানকে ওড়ানো হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। এ-হেন ‘এসজে-১০০’-এ সফর কতটা নিরাপদ? তা নিয়ে কিন্তু যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
‘এভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্ক’ নামের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ বছরে অন্তত ৯৫ বার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে ‘এসজে-১০০’। এর সব ক’টি অবশ্য প্রাণঘাতী ছিল না। ২০১২ সালে রুশ সংস্থাটির তৈরি উড়োজাহাজটি প্রথম বার বড় দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। ওই বছর ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট সালা পাহাড়ে ভেঙে পড়ে এই বিমান। ফলে চালক ও আরোহী মিলিয়ে মৃত্যু হয় ৪৫ জনের। দুর্ঘটনার জন্য চালকের ভুলকে দায়ী করা হয়েছিল।
২০১৫ সালে মেক্সিকোর বিমানবন্দরের রানওয়েতে অন্য একটি বিমানকে আচমকা ধাক্কা মারে ‘এসজে-১০০’। ওই সময় ইউএসি নির্মিত উড়োজাহাজটিকে হ্যাঙ্গারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আর তাই এর মধ্যে ছিলেন না কোনও যাত্রী। ২০১৮ সালে রাশিয়ার ইয়াকুটস্ক বিমানবন্দরে রানওয়ে অতিক্রম করে পাশের এলাকায় ঢুকে পড়ে এই মডেলের একটি বিমান। এতে উড়োজাহাজটির ক্ষতি হলেও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তদন্তে গ্রাউন্ড অপারেটরদের একাধিক ত্রুটি প্রকাশ্যে এসেছিল।
ওই ঘটনার পরের বছরই (পড়ুন ২০১৯ সালে) মস্কোর শেরেমেতিয়েভো বিমানবন্দরে ওড়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই জরুরি অবতরণ করে একটি ‘এসজে-১০০’ বিমান। কিন্তু গোটা প্রক্রিয়াটি ঠিকমতো না হওয়ায় উড়োজাহাজটির চাকা মাটি ছোঁয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তা লাফিয়ে প্রায় দু’মিটার উপরে উঠে যায়। এতে বিমানটির পিছনের অংশে আগুন ধরে গিয়েছিল। ফলে ৭৮ জন যাত্রীর মধ্যে প্রাণ হারান ৪১ জন।
এ ছাড়া গত বছর পরীক্ষামূলক উড়ানের সময় একটি ‘এসজে-১০০’ ভেঙে পড়ে। এতে চালক-সহ প্রাণ হারান তিন জন ক্রু সদস্য, যার কারণ স্পষ্ট নয়। বাকি ৯০টি দুর্ঘটনাকে ছোটখাটো বলে জানিয়েছে ‘এভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্ক’। ওয়েবসাইটি জানিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানব ত্রুটির কারণে বিপদে পড়েছে রুশ সংস্থার তৈরি এই যাত্রিবাহী উড়োজাহাজ।
সূত্রের খবর, ৫৬.৮ শতাংশ ক্ষেত্রে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে ‘এসজে-১০০’। মানুষের ভুলে সংশ্লিষ্ট উড়োজাহাজটির বিপদে পড়ার পরিমাণ ২১.১ শতাংশ। এ ছাড়া প্রাকৃতিক কারণে ১৫.৮ শতাংশ ক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে এই বিমানের। বাকি ৬.৩ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। সেগুলির তদন্ত চলছে।
তবে এর উল্টো যুক্তিও রয়েছে। মার্কিন সংস্থার বোয়িংয়ের বিমান বহুল পরিমাণে ব্যবহার করে এ দেশের প্রায় প্রতিটি উড়ান পরিষেবা সংস্থা। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত আমেরিকার সংস্থাটির তৈরি বিভিন্ন মডেলের প্রায় ছ’হাজার উড়োজাহাজ মারাত্মক দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে। মৃতের সংখ্যা ন’হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। সে দিক থেকে রাশিয়ার ‘এসজে-১০০’কে অনেক বেশি সুরক্ষিত বলা যেতে পারে।
কোনও রুশ সংস্থার থেকে বিমান তৈরির স্বত্ব হ্যাল এই প্রথম বার পেল এমনটা নয়। এ বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় বায়ুসেনা থেকে অবসর নেয় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) তৈরি ‘মিগ-২১’ লড়াকু জেট। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানগুলি আমদানি করেছিল নয়াদিল্লি। এর ৮৪০টি ঘরের মাটিতেই তৈরি করে হ্যাল। সেই ভ্যারিয়েন্টের নাম দেওয়া হয় ‘বাইসন’। এর স্বত্ব এ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটিকে দিয়েছিল জেটটির নির্মাণকারী সংস্থা ‘মিকোয়ান-গুরেভিচ’।
এ ছাড়া গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে ‘অভ্র এইচএস-৭৪৮’ নামের একটি যাত্রিবাহী বিমান তৈরি শুরু করে হ্যাল। ১৯৬১ সালে সেই প্রকল্পের সূচনা হলেও ১৯৮৮ সালে তা বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এ ব্যাপারে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিরক্ষা সংস্থাটির অভিজ্ঞতার কোনও অভাব নেই। কিন্তু সমস্যার জায়গা হল নিষেধাজ্ঞা।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ (পড়ুন স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। এর জেরে মস্কোর উপর ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। ফলে এই মউকে আঁকড়ে ধরে ইউএসির প্রযুক্তি এবং কারিগরি সহায়তায় ঘরের মাটিতে যাত্রিবাহী বিমান তৈরি করা হ্যালের জন্য কঠিন হতে পারে।
এ বছরের ডিসেম্বরে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফরে আসার কথা রয়েছে। নয়াদিল্লিতে পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন তিনি। সেখানে যাবতীয় জট কাটার ব্যাপারে আশাবাদী বিশেষজ্ঞ মহল। এর পর কবে থেকে যাত্রিবাহী বিমানের নির্মাণ কাজ শুরু হবে তা জানাবে হ্যাল, খবর সূত্রের।