যুদ্ধরত ইরান এবং ইজ়রায়েলের মধ্যে শান্তি ফিরেছে মার্কিন মধ্যস্থতায়। সংঘর্ষবিরতি কার্যকর করেছে যুযুধান দুই দেশ। লড়াই বন্ধ হলেও এখানেই থেমে থাকতে রাজি নয় ইহুদিরা। তেহরানের পর এ বার পাকিস্তানকে নিশানা করতে চায় তেল আভিভ। সমাজমাধ্যমে করা পোস্টে সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন ইজ়রায়েলের এক প্রাক্তন মন্ত্রী। ইসলামাবাদের হাতে থাকা ‘ইসলামিক বোমা’কে ইহুদিভূমির জন্য ‘বিপজ্জনক’ বলেও দাবি করেছেন তিনি।
চলতি বছরের ১৮ জুন এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) পাকিস্তানকে নিয়ে একটি পোস্ট করেন ইজ়রায়েলের সাবেক উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী মেইর মাসরি। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘আমরা ইরান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছি। এ বার পাকিস্তানের পরমাণু বোমাগুলিকে বিনষ্ট করতে হবে।’’ তাঁর ওই পোস্টের পরেই ইসলামাবাদে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। তড়িঘড়ি নিরাপত্তা সংক্রান্ত বৈঠক করেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ।
তবে শুধু মাসরি নন, রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের হাতে পরমাণু হাতিয়ার থাকা নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুরও। বহু দিন আগে একবার তিনি বলেছিলেন, ‘‘ইরান বা পাকিস্তানের মতো দেশগুলি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে সেখানে ব্যাঙ্কের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে জঙ্গিগোষ্ঠী। তাই এই ‘অবিবেচক’ ইসলামীয় দেশগুলির কাছে পরমাণু অস্ত্র থাকা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।’’
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ইজ়রায়েলের এই ভয় একেবারেই অমূলক নয়। কারণ, ইহুদিভূমিকে রাষ্ট্র হিসাবে আজও মান্যতা দেয়নি ইসলামাবাদ। তা ছাড়া, পাক রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সেনার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে প্যালেস্টাইনের দিকে। ইজ়রায়েল রাষ্ট্রকে ‘অবৈধ’ বলে মনে করেন তাঁরা। সাম্প্রতিক যুদ্ধেও ‘ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধ’-এর কথা বলে তেহরানের পাশে থাকার কথা বলতে শোনা গিয়েছে তাঁদের।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধে ভারতের কাছে সম্পূর্ণ ভাবে পর্যুদস্ত হওয়ার পর পরমাণু বোমা তৈরিতে কোমর বেঁধে লেগে পড়ে পাকিস্তান। কিন্তু এতে ইসলামাবাদের উপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির আশঙ্কা ছিল। সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে ‘ধর্মীয় তাস’ খেলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো। বলেন, ‘‘ইসলামিক বোমা তৈরি করছে ইসলামাবাদ। এই মারণাস্ত্রের উপর সমগ্র ইসলামীয় দুনিয়ার অধিকার থাকবে।’’
ভুট্টোর ওই মন্তব্যের পরে প্রমাদ গোনে ইজ়রায়েল। কালবিলম্ব না করে ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচিকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে ফেলে ইহুদিদের গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ। সেইমতো গত শতাব্দীর আশির দশকে ইসলামাবাদের পরমাণুকেন্দ্রগুলিতে বোমাবর্ষণের পরিকল্পনা ছিল তেল আভিভের বায়ুসেনার। কিন্তু নানা কারণে শেষ পর্যন্ত বাতিল হয় সেই অভিযান। মাসরির পোস্টের পর নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে ইসলামাবাদে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, পাক পরমাণু হাতিয়ারের গুপ্ত ঠিকানাগুলি উড়িয়ে দেওয়া ইজ়রায়েলের পক্ষে একেবারেই কঠিন নয়। কারণ, ইরানের মতো সেগুলি দেশের বহু জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেই। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা ওই মারণাস্ত্র মূলত পঞ্জাব এবং বালোচিস্তান প্রদেশের সৈন্যঘাঁটিতে মজুত রেখেছেন। ফলে খুব সহজেই ইহুদি লড়াকু জেটের নিশানায় আসতে পারে ওই আণবিক হাতিয়ার।
১৯৪৮ সালে জন্মের পর থেকে এক এক করে শত্রুর পরমাণুকেন্দ্রগুলি ধ্বংস করেছে ইজ়রায়েল। মিশরকে দিয়ে সেই অভিযান শুরু করে ইহুদিরা। পরবর্তী দশকগুলিতে ইরাক এবং সিরিয়া হয়ে বর্তমানে সেটা ইরানে এসে থেমেছে। প্রতিটা ক্ষেত্রেই সাফল্য পেয়েছে তেল আভিভ। আর তাই ইসলামাবাদের রক্তচাপ যে ধীরে ধীরে বাড়ছে, তা বলাই বাহুল্য।
গত শতাব্দীর ’৬০-এর দশকে পরমাণু কর্মসূচি শুরু করে মিশর। সেই সঙ্গে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণেও জোর দিয়েছিল কায়রো। গুপ্তচর মারফত এই সংবাদ কানে যেতেই তৎপর হয় ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। ১৯৬৭ সালের বিখ্যাত ছ’দিনের যুদ্ধে মিশরীয় প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের সেই স্বপ্নকে চিরতরে ধুলোয় মিশিয়ে দেয় তেল আভিভ। তার পর থেকে ‘পিরামিডের দেশ’ আর কখনওই আণবিক বোমা তৈরির অবস্থায় পৌঁছোয়নি।
মিশরের দিক থেকে বিপদ কেটে যাওয়ার পর ইরাককে নিশানা করে ইহুদিরা। ১৯৮১ সালের ৭ জুনে বাগদাদের ওসিরাক পারমাণবিক কেন্দ্রে বিমান হামলা চালায় ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। তাঁদের ওই অভিযানের নাম ছিল, ‘অপারেশন অপেরা’। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলি অবশ্য একে ‘অপারেশন ব্যাবিলন’ বলে উল্লেখ করে থাকে। সংশ্লিষ্ট হামলায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় ওসিরাক।
ইহুদিদের এই আক্রমণের সময়ে ইরাকি প্রেসিডেন্ট ছিলেন সাদ্দাম হুসেন। ইজ়রায়েলের উপর প্রত্যাঘাত শানানোর কোনও শক্তিই ছিল না তাঁর। কারণ, তত দিনে প্রতিবেশী দেশ সিরিয়ার সঙ্গে সীমান্ত বিবাদকে কেন্দ্র করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। অন্য দিকে, ডলারে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করতে না চাওয়ায় আমেরিকার পয়লা নম্বর শত্রু হয়ে গিয়েছেন তিনি।
১৯৯০ সালের অগস্টে আচমকা কুয়েত আক্রমণ করে বসে বাগদাদ। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পশ্চিম এশিয়ায় বেধে যায় ‘উপসাগরীয় যুদ্ধ’। প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের কুয়েত অভিযানের সাত মাসের মাথায় (পড়ুন ১৯৯১ সালের জানুয়ারি) মার্কিন নেতৃত্বে ইরাকের বিরুদ্ধে শুরু হয় ‘অপারেশন ডেজ়ার্ট স্টর্ম’। সেই আক্রমণ সহ্য করতে পারেনি সাদ্দামের বাহিনী। ফলে বাধ্য হয়ে পিছু হটে তারা।
পরবর্তী দশকগুলি সাদ্দামের বিরুদ্ধে ওঠে গণবিধ্বংসী হাতিয়ার তৈরির অভিযোগ। পাশাপাশি, কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়দার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে দাবি করেন মার্কিন গোয়েন্দারা। ফলে ২০০৩ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে ফের যুদ্ধে নামে যুক্তরাষ্ট্র। লড়াইয়ে তাঁর বাহিনী হেরে গেলে গোপন বাঙ্কারে ঢুকে সাদ্দামকে গ্রেফতার করে আমেরিকান সৈন্যরা। ২০০৬ সালে ইরাকি আদালতের রায়ে মানবতা-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলায় ওয়াশিংটন।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সাদ্দামের এই পতনের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় হাত ছিল ইহুদিদের। বাগদাদের পরমাণু কর্মসূচিকে ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনী উড়িয়ে না দিলে তাঁকে বাগে আনা আমেরিকার পক্ষে বেশ কঠিন হত। পাশাপাশি, পশ্চিম এশিয়ার আরব দুনিয়ায় বৃদ্ধি পেত আণবিক যুদ্ধের আতঙ্ক।
সাদ্দামের পতনের পর ইরান এবং সিরিয়ার পরমাণু কর্মসূচিগুলির দিকে চোখ যায় ইজ়রায়েলের। ২০০৭ সালে দামাস্কাসের আণবিক কেন্দ্রগুলিকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয় তারা। পাশাপাশি, ওই সময় থেকেই বেছে বেছে তেহরানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের নিকেশ করতে থাকে ইহুদি গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ। যদিও তাতে দমে না গিয়ে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণের কাজ চালিয়ে গিয়েছে সাবেক পারস্য দেশ।
পরমাণু বোমা তৈরির অন্যতম উপাদান হল ইউরেনিয়াম। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী তেজস্ক্রিয় পদার্থ। ইজ়রায়েলের দাবি, এ-হেন ইউরেনিয়ামের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধিকরণের কাজ সেরে ফেলেছে তেহরান। ৯০ শতাংশে পৌঁছে গেলেই বোমা তৈরি করে ফেলবে পারস্য উপসাগরের তীরের ওই শিয়া মুলুক। আর তখনই ইহুদিভূমির অস্তিত্ব মুছে দিতে তৎপর হতে পারে সাবেক পারস্য দেশের কট্টরপন্থীরা।
সেই বিপদ এড়াতে গত ১৩ জুন ইরানের পরমাণুকেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটিগুলিতে হামলা চালায় ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনী। তাঁদের এই অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’। পাল্টা প্রত্যাঘাত শানাতে ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস ৩’ শুরু করে তেহরান ফৌজ। ফলে দু’পক্ষের মধ্যে বেধে যায় যুদ্ধ। গত ২২ মে ইহুদিদের পাশে দাঁড়িয়ে সাবেক পারস্য দেশের তিনটি পরমাণুকেন্দ্রে অতি শক্তিশালী ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ফেলে মার্কিন বায়ুসেনা।
যুক্তরাষ্ট্র এই আক্রমণের পোশাকি নাম রাখে ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’। এর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় সংঘর্ষবিরতিতে সম্মত হয় দুই দেশ। তবে আমেরিকার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ইজ়রায়েল তেহরানের পরমাণু কর্মসূচিকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে পেরেছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ, ওয়াশিংটনের গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, একে কিছুটা পিছিয়ে দেওয়া গেলেও পুরোপুরি শেষ করা যায়নি।
বিশ্লেষকেরা অবশ্য মনে করেন, মিশর, ইরাক, সিরিয়া এবং ইরানের ক্ষেত্রে ইজ়রায়েল অতি সহজেই যা করতে পেরেছে পাকিস্তানের তা করতে পারা অনেকটাই কঠিন। কারণ, ওই দেশগুলি আণবিক বোমা তৈরির আগেই তা ধ্বংস করেছে ইহুদিরা। অন্য দিকে ইসলামাবাদ পরমাণু শক্তি সমৃদ্ধ দেশ। সেখানে আক্রমণ শানালে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা কঠিন হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বহু বার নিজেদের প্রয়োজনে পাকিস্তানকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইজ়রায়েল সেখানকার পরমাণুকেন্দ্রগুলিকে নিশানা করলে সেই সুবিধা হারাতে পারে ওয়াশিংটন। আর তাই আমেরিকার দিক থেকে ইহুদিদের হাত পিছন দিকে টেনে ধরার সম্ভাবনা রয়েছে। এই নিয়ে তেল আভিভকে অবশ্য হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন পাক বিদেশমন্ত্রী ইশাক দার।
১৯৭৭-’৮৩ সাল পর্যন্ত ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মেনাহেম বেগিন। চারদিকে শত্রুবেষ্টিত হওয়ায় ইহুদিভূমির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে বিশেষ একটি নীতির প্রচলন করেন তিনি। এরই নাম ‘বেগিন ডকট্রিন’। এতে বলা হয়, কোনও দিক থেকে বিপদের আশঙ্কা থাকলে আগাম আক্রমণ করে আগেই তা গুঁড়িয়ে দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট নীতিটি মেনে পাকিস্তানের পরমাণুকেন্দ্রগুলিকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ যে ইহুদি গুপ্তচরেরা খুঁজবে না তা বলা খুবই কঠিন।