Sniper Tourism in Bosnia

টাকা দিয়ে ‘মানুষ শিকার’ সভ্য ইউরোপীয়দের! ৩০ বছর আগে ‘স্নাইপার সাফারি’তে উজাড় হন বলকান দেশের ১০ হাজার মানুষ

১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সময়ে বসনিয়া ও হারজ়েগোভিনার রাজধানী সারাজেভো দখল করে রেখেছিল সার্বিয়ার সেনা। সার্ব বাহিনীকে বিপুল অর্থ দিয়ে সারাজেভোর সাধারণ মানুষদের ‘শিকারের’ সুযোগ কিনতেন ইটালির ধনাঢ্যেরা।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৫ ১৫:০৯
Share:
০১ ১৯

কোটি কোটি টাকা দিয়ে ‘নরমেধ যজ্ঞ’। অর্থের বিনিময়ে ‘মানুষ শিকার’। এক দেশ থেকে অন্য দেশে বে়ড়াতে গিয়ে নিছক আনন্দের জন্য নিরীহ নাগরিকদের ধরে ধরে খুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যার দৃষ্টান্ত এটিই। রাস্তায় চলাফেরা করা সাধারণ মানুষ জানতেই পারতেন না কখন তাঁদের মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হয়ে গিয়েছে। আড়াল থেকে স্নাইপারের বুলেট এসে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিত শরীর।

০২ ১৯

পাশবিক এই হত্যালীলার গালভরা নামও দিয়েছিল যুদ্ধের কারবারিরা। নাম ছিল ‘স্নাইপার সাফারি’। বন্যপ্রাণীর বদলে বন্দুকের নিশানা হতেন বসনিয়ার নিরীহ আমজনতা। ইচ্ছামতো সাধারণ মানুষকে গোপন কোনও স্থান থেকে বন্দুকের নিশানায় উড়িয়ে দেওয়া হত। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে বসনিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় এক লক্ষ লোকের অস্তিত্ব মুছে ফেলা হয়েছিল এই দুনিয়া থেকে।

Advertisement
০৩ ১৯

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বসনিয়া ও হারজ়েগোভিনার রাজধানী সারাজেভোতে এমন ভাবেই নিরীহ সাধারণ নাগরিকদের খুনের প্রচলন শুরু হয়েছিল। সার্বিয়ার জনতার রক্ত নিয়ে খেলার জন্য সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল বিত্তশালী ইটালীয় নাগরিকদের। অভিজাত সমাজের একাংশ একলপ্তে লক্ষ ইউরো খরচ করতেও পিছপা হতেন না।

০৪ ১৯

বসনিয়ান সার্ব বাহিনী এই ‘স্নাইপার পর্যটকদের’ রাজধানী শহরের আশপাশের পাহাড়ে হত্যার জন্য নিয়ে যেতেন। সার্ব বাহিনীকে বিপুল অর্থ দিয়ে সারাজেভোর সাধারণ মানুষদের ‘শিকারের’ এই সুযোগ কিনতেন ইটালির ধনাঢ্যেরা। পাহাড়ি এলাকার গোপন স্থান থেকে নিরস্ত্র নাগরিকদের উপর গুলিবর্ষণ করা হত। তা দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ত সার্ব বাহিনী।

০৫ ১৯

ঘটনাটির বীভৎসতা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। ঘটনায় যুক্ত সার্ব নেতাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে। তবে এই ‘স্নাইপার সাফারি’ নিয়ে নতুন করে তদন্তের অভিমুখ খুলে গিয়েছে। এজ়িও গাভাজ়েনি নামে এক লেখক তথা সাংবাদিকের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি সেই হত্যালীলার তদন্ত শুরু করেছে ইটালি সরকার। মিলানের সরকারি আইনজীবীরা এ নিয়ে নতুন করে মামলা দায়ের করেছেন।

০৬ ১৯

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ইউগোস্লাভিয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বসনিয়া। ১৯৯২-এর এপ্রিলে ইউগোস্লাভিয়ার থেকে নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করে বসনিয়া-হারজ়েগোভিনা। সেই থেকে শুরু সে দেশের রক্তাক্ত ইতিহাসের অধ্যায়। ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সময়ে বসনিয়ার রাজধানী সারাজেভো দখল করে রেখেছিল সার্বিয়ার সেনা।

০৭ ১৯

বসনিয়া ও হারজ়েগোভিনা প্রজাতন্ত্র হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। তার পর থেকেই দেশের ভিতরে-বাইরে অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সেই সুযোগে বসনীয় সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচ ও তাঁর দল সার্বীয় গণতন্ত্রী পার্টি সরকার থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। বসনীয় সার্বেরা প্রজাতন্ত্র সরকার গঠন বা ইউগোস্লাভিয়ার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেন।

০৮ ১৯

পরবর্তী কালে গণহত্যায় দোষী সাব্যস্ত রাদোভানের নেতৃত্বে একটি বাহিনী সারাজেভোয় অভিযান চালায়। পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে দেশের বেশির ভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ সার্ব বাহিনীর হাতে চলে যায়। বসনিয়ার সরকারি সেনাবাহিনী ক্রোয়েশিয়ার সাহায্য নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ১৯৯৩-এর শেষ নাগাদ দেশটির তিন-চতুর্থাংশই বসনীয় সার্ব বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সাধারণ নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যার পিছনে মদত দিয়েছিলেন এই সার্ব বাহিনীর মূল নেতা রাদোভানই।

০৯ ১৯

বসনিয়া ও হারজ়েগোভিনার শহর স্রেবেনিকার কুখ্যাত গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক আদালত দোষী সাব্যস্ত করে রাদোভানকে। তাঁর বিরুদ্ধে বসনিয়া ও হারজ়েগোভিনার রাজধানী সারাজেভো ৪৪ মাস ধরে অবরোধ করে রাখার অভিযোগ ছিল। এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিবাহিনীকে পণবন্দিও করেন তিনি। বিচারের সময় উল্লেখ করা হয়েছিল সার্ব নেতার লক্ষ্য ছিল, কোনও সমর্থ বসনীয় মুসলিম পুরুষকে বাঁচিয়ে না রাখা!

১০ ১৯

ইউগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর চার বছর গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়তে থাকে বসনিয়া ও হারজ়েগোভিনা। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে সারাজেভোতে অবিরাম গোলাবর্ষণ এবং স্নাইপারদের গুলিতে ১০,০০০-এরও বেশি মানুষ নিহত হন। এই অবরোধটি ছিল আধুনিক ইতিহাসের দীর্ঘতম অবরোধ।

১১ ১৯

ইউগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর চার বছর গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়তে থাকে বসনিয়া ও হারজ়েগোভিনা। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে সারাজেভোতে অবিরাম গোলাবর্ষণ এবং স্নাইপারদের গুলিতে ১০,০০০-এরও বেশি মানুষ নিহত হন। এই অবরোধটি ছিল আধুনিক ইতিহাসের দীর্ঘতম অবরোধ।

১২ ১৯

ইউগোস্লাভিয়া ভাঙার পরে শুরু হওয়া সেই গৃহযুদ্ধে সার্বদের হাতে হাজার হাজার মুসলিম যেমন খুন হন, তেমনই ধর্ষিতা হন অন্তত ২০ হাজার মহিলা। বিভিন্ন রিপোর্টে দাবি করা হয়, হত্যালীলায় অংশ নিতেই নাকি ইটালি, আমেরিকা এবং রাশিয়ার মতো দেশ থেকে পর্যটকেরা যেতেন সারাজেভোতে। নাৎসি জমানার পরে ইউরোপে এত বড় মাপের গণহত্যা আর হয়নি।

১৩ ১৯

এক এক জন নাগরিককে খুন করতে ৮০ হাজার পাউন্ড দিতেও রাজি ছিলেন সেই সব পর্যটক। নিশানায় শিশু এবং উর্দিধারীরা থাকলে দর আরও বাড়ত। খরচ পৌঁছোত এক লক্ষ পাউন্ডেও। সারাজেভোতে অবরুদ্ধ নাগরিকদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চরিত্র ছিলেন স্নাইপারেরা। কারণ শিশু-সহ লোকজনকে এলোপাথাড়ি গুলি করে মেরে ফেলতেন তাঁরা। গুলি চালানোর ক্ষেত্রে কোনও বাছবিচার ছিল না রক্তপিপাসু স্নাইপারদের।

১৪ ১৯

নব্বইয়ের দশকেই ইটালির একটি সংবাদপত্র থেকে এই ‘স্নাইপার সাফারি’র বিষয়টি নজরে পড়েছিল সাংবাদিক গাভাজ়েনির। প্রমাণের অভাবে তখন আইনি পথে হাঁটতে পারেননি তিনি। ২০২২ সালে ‘সারাজেভো সাফারি’ নামে একটি তথ্যচিত্র দেখেন ওই সাংবাদিক। ওই তথ্যচিত্রে থাকা প্রমাণের ভিত্তিতেই গত ফেব্রুয়ারি মাসে মিলানের প্রশাসনের হাতে ১৭ পাতার একটি নথি জমা দেন তিনি।

১৫ ১৯

এক এক জন নাগরিককে খুন করতে ৮০ হাজার পাউন্ড দিতেও রাজি ছিলেন সেই সব পর্যটক। নিশানায় শিশু এবং উর্দিধারীরা থাকলে দর আরও বাড়ত। খরচ পৌঁছোত এক লক্ষ পাউন্ডেও। সারাজেভোতে অবরুদ্ধ নাগরিকদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চরিত্র ছিলেন স্নাইপারেরা। কারণ শিশু-সহ লোকজনকে এলোপাথাড়ি গুলি করে মেরে ফেলতেন তাঁরা। গুলি চালানোর ক্ষেত্রে কোনও বাছবিচার ছিল না রক্তপিপাসু স্নাইপারদের।

১৬ ১৯

গাভাজ়েনির মতে, যাঁরা স্নাইপার সাফারি করতে আসতেন তাঁদের এই গণহত্যার নেপথ্যে কোনও রাজনৈতিক বা ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছিল না। ইটালি-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ধনীরা সেখানে মজা এবং ব্যক্তিগত তৃপ্তির জন্য যেতেন। কেবলমাত্র বন্দুক পছন্দ করেন এমন কিছু মানুষও ছিলেন, যাঁরা সম্ভবত আফ্রিকার শুটিং রেঞ্জে বা সাফারিতে না গিয়ে শিকারস্থল পরিবর্তন করেছিলেন।

১৭ ১৯

২০১৬ সালে গণহত্যার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন রাদোভান। তাঁকে ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে এই সাজা বেড়ে হয় যাবজ্জীবন। তার আগে ২০১১ সালে সার্বিয়ার একটি গ্রাম থেকে ধরা পড়েন ‘বসনিয়ার কসাই’। বসনীয়-সার্ব বাহিনীর সেই প্রাক্তন কমান্ডারের নাম রাতকো ম্লাডিচ। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে বসনিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় গণহত্যা-সহ মোট ১১টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন তিনি।

১৮ ১৯

১৯৯৫ সালে মাত্র ক’দিনের মধ্যে বর্তমান বসনিয়া ও হারজ়েগোভিনার সেব্রেনিৎসায় আট হাজারেরও বেশি বসনীয় মুসলিমকে খুন করেছিল সার্ব বাহিনী। নিহতদের মধ্যে ছিলেন মূলত পুরুষেরাই, বালক থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত। আর সেই ঘাতক বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ম্লাডিচ। ১৯৯৫ সালে গা ঢাকা দেন ম্লাডিচ। ২০১৭ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় গণহত্যার অপরাধে যুক্ত এই অপরাধীকেও।

১৯ ১৯

গাভাজ়েনির অভিযোগের ভিত্তিতেই তদন্ত শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইটালির সরকার। আপাতত সেই সব ইটালির নাগরিকের সন্ধান চলছে, যাঁদের বিরুদ্ধে সারাজেভোতে গিয়ে নাগরিকদের হত্যার অভিযোগ উঠেছে। অন্য দিকে, বসনিয়াতে এই বিষয়ে তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়েই থমকে আছে বলে জানা গিয়েছে।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement