একটি মিউজ়িক ভিডিয়োয় অভিনয় করে রাতারাতি জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। বেঁচে থাকার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ‘কাঁটা লগা গার্ল’ হিসাবেই পরিচিত থাকতে চেয়েছিলেন। কয়েক মাস আগে সাক্ষাৎকারে এমন ইচ্ছাই প্রকাশ করেছিলেন শেফালি জরিওয়ালা। শুক্রবার মধ্যরাতে মাত্র ৪২ বছর বয়সে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।
১৯৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে গুজরাতের অহমদাবাদে জন্ম শেফালির। বাবা-মা এবং বোনের সঙ্গে সেখানেই থাকতেন তিনি। গুজরাত থেকে স্কুল এবং কলেজের পড়াশোনা শেষ করেন শেফালি। তাঁর মা ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করে স্নাতক হন তিনি।
এক সাক্ষাৎকারে শেফালি জানিয়েছিলেন যে, ১৫ বছর বয়স থেকে মৃগীরোগে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। পড়াশোনা থেকে কেরিয়ার— সব ক্ষেত্রেই এই রোগ প্রভাব ফেলেছিল শেফালির জীবনে। তাই ‘কাঁটা লগা’ গানে অভিনয়ের পরেও বেশি কাজ করতে দেখা যেত না শেফালিকে।
সাক্ষাৎকারে শেফালি বলেছিলেন, ‘‘কিশোরীবেলা থেকে আমি মৃগীরোগে ভুগতাম। পড়াশোনায় ভাল ফল করারও একটা মানসিক চাপ থাকত। যে কোনও ধরনের মানসিক উদ্বেগ হলেই এই রোগ আমার চেপে ধরত। এমনও হয়েছে যে, আমি হয়তো ক্লাসরুমে রয়েছি অথবা রাস্তায়। কিংবা শুটিং চলাকালীন ব্যাকস্টেজে রয়েছি। হঠাৎ মৃগীরোগের শিকার হলাম। এই অসুস্থতা আমার আত্মবিশ্বাস কমিয়ে ফেলেছিল।’’
শেফালির কথায়, ‘‘আমায় অনেকে প্রশ্ন করতেন যে, ‘কাঁটা লগা’র পর আমি আর তেমন কাজ করলাম না কেন? আসলে আমি বুঝতে পারতাম না কখন, কী ভাবে মৃগীরোগে আক্রান্ত হব। ১৫ বছর ধরে এই রোগের সঙ্গে লড়াই করেছিলাম আমি। আমার পাশে সব সময় ভালবাসার মানুষেরা ছিলেন। মানসিক উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করে আমি এই রোগ সারাতে সফল হয়েছি। আমার নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ হয়।’’
শেফালির বাবা-মা চেয়েছিলেন যে, পড়াশোনা শেষ করে তাঁদের মেয়ে চাকরি করুক। কিন্তু কলেজে পড়াকালীন ‘কাঁটা লগা’ মিউজ়িক ভিডিয়োয় অভিনয়ের প্রস্তাব পান তিনি। সেই ভিডিয়োয় অভিনয়ের জন্য ৭ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন শেফালি। কিন্তু বাড়িতে সে কথা জানানোর পর প্রথমে আপত্তি জানিয়েছিল তাঁর পরিবার।
শেফালি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘আমি নিজেকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাবার ঘোর আপত্তি ছিল। তাই প্রথমে মাকে রাজি করিয়েছিলাম। তার পর দু’জন মিলে বাবাকে রাজি করাই। গানটা কম সময়ের মধ্যে এতই হিট হয়ে যায় যে, আমার জীবন বদলে গিয়েছিল। রূপকথার মতো মনে হত সব।’’
ধর্মেন্দ্র-আশা পারেখ অভিনীত ‘সমাধি’ ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছিল ‘কাঁটা লগা’ গানটি। ২০২০ সালে তার রিমিক্স মিউজ়িক ভিডিয়োয় অভিনয় করেছিলেন শেফালি। একটি পডকাস্টে শেফালি বলেছিলেন, ‘‘আমি খুব কম সময়ের মধ্যে নিজের নাম পেয়ে গিয়েছিলাম। অমিতাভ বচ্চন যেমন ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ নামে পরিচিত, শাহরুখ খান যেমন ‘কিং খান’ নামে পরিচিত। আমিও তেমনই ‘কাঁটা লগা গার্ল’ হিসাবে পরিচয় পাই। এত কম সময়ে এই রকম বিশেষ নাম পাওয়া মুখের কথা নয়। তা-ও আবার প্রথম কাজ থেকেই পরিচিতি। আসলে, আমি কিন্তু গানে কোনও ছোট পোশাক পরে অভিনয় করিনি। আমার চরিত্রটাই ছিল নজরকাড়া। সে প্রেমিকের সঙ্গে ঝগড়া করে, নাইটক্লাবে যায়। এই চরিত্রটিই সকলের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। আমি খুব উপভোগ করি বিষয়টা। আমি চাই আমি যত দিন বেঁচে রয়েছি, আমার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত লোকে আমায় এই নামে চিনুক।’’
২০০৪ সালে সঙ্গীত পরিচালক হরমিত সিংহকে বিয়ে করেন শেফালি। হরমিতের ভাই মরমিত সিংহও বলিউডের ছবিতে সুর দেন। ‘মিত ব্রাদার্স’ নামে পরিচিত দুই ভাইয়ের জুটি। ‘মিত ব্রাদার্স’-এর সঙ্গে মিউজ়িক ভিডিয়োয় অভিনয়ও করেছিলেন শেফালি। কিন্তু শেফালি এবং হরমিতের সংসার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
বলিপাড়া সূত্রে খবর, ২০০৯ সালে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় শেফালির। হরমিতের বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। নায়িকার দাবি, বিয়ের পর হরমিতের কাছে প্রতিনিয়ত মানসিক নির্যাতনের শিকার হতেন তিনি। দিনের পর দিন সহ্য করতে না পেরে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শেফালি।
এক সাক্ষাৎকারে শেফালি বলেছিলেন, ‘‘সব নির্যাতন শারীরিক হয় না। আপনার জীবনসঙ্গী আপনাকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে সেই বোধ থাকা খুব প্রয়োজন। আমি সম্পর্কে খুশি ছিলাম না। মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম। আর্থিক ভাবে সচ্ছল ছিলাম বলে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মনের জোর পেয়েছি।’’
হরমিতের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের কয়েক বছর পর নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন শেফালি। বন্ধুর এক পার্টিতে টেলি তারকা পরাগ ত্যাগীর সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। ‘পবিত্র রিশ্তা’, ‘জোধা আকবর’-এর মতো হিন্দি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন পরাগ। প্রথম আলাপেই পরাগকে ভাল লেগে যায় শেফালির।
পরাগের সঙ্গে জুটি বেঁধে পর পর দু’বার নাচের একটি জনপ্রিয় রিয়্যালিটি শোয়ে অংশগ্রহণ করেন শেফালি। ২০১৪ সালের অগস্ট মাসে পরাগের সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়েন শেফালি।
২০০৪ সালে প্রথম বড় পর্দায় অভিনয় শেফালি। সলমন খান, অক্ষয় কুমার এবং প্রিয়ঙ্কা চোপড়া জোনাস অভিনীত ‘মুঝসে শাদি করোগি’ নামের হিন্দি ছবির মাধ্যমে বড় পর্দায় অভিনয়ে হাতেখড়ি হয় শেফালির।
হিন্দি ছবিতে অভিনয়ের সাত বছর পর কন্নড় ভাষার একটি ছবিতে অভিনয় করতে দেখা যায় শেফালিকে। ২০১৯ সালে ‘বিগ বস্’-এর ত্রয়োদশ সিজ়নে প্রতিযোগী হিসাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি।
বলিপাড়ার জনশ্রুতি, ২০১৬ সালে বোনের সঙ্গে দুবাইয়ে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছিলেন শেফালি। সেই সংস্থার সহ-মালিকানার দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
২০১৮ সালে ‘বেবি কাম না’ নামের একটি ওয়েব সিরিজ়ে বলি অভিনেতা শ্রেয়স তলপড়ের সঙ্গে অভিনয় করেন শেফালি। ২০২৪ সালে ‘শয়তানি রসমেঁ’ নামের একটি হরর ঘরানার হিন্দি ধারাবাহিকে শেষ অভিনয় করতে দেখা যায় তাঁকে।
অভিনয়ের সঙ্গে বিশেষ যোগ না থাকলেও সমাজমাধ্যমে বেশ সক্রিয় ছিলেন শেফালি। ইতিমধ্যেই ইনস্টাগ্রামের পাতায় শেফালির অনুগামীর সংখ্যা ৩৩ লক্ষের বেশি।
বলিপাড়া সূত্রে খবর, শুক্রবার মধ্যরাতে মুম্বইয়ের ফ্ল্যাটে পরাগের সঙ্গে ছিলেন শেফালি। সেখানেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে মুম্বইয়ের অন্ধেরির একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় শেফালিকে। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার পর শেফালিকে মৃত ঘোষণা করেন সেখানকার চিকিৎসকেরা।