৮০-এর দশকে মার্কিন সেনার যুদ্ধবিমানকে টক্কর দেওয়ার জন্য তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি যুদ্ধবিমানের প্রয়োজন ছিল। সোভিয়েত সেনার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ম্যাকডোনেল ডগলাসের (এখন বোয়িংয়ের এর অংশ) তৈরি এফ-১৫ ইগল নামে মার্কিন যুদ্ধবিমান। ম্যাকডোনেল ডগলাস ছিল আমেরিকার অন্যতম বাণিজ্যিক এবং সামরিক বিমান প্রস্তুতকারক সংস্থা।
১৯৭২ সালে সংস্থার তৈরি অন্যতম সফল যুদ্ধবিমান এফ-১৫ ইগল আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭৬ সালে মার্কিন বিমানবাহিনীতে আনুষ্ঠানিক ভাবে পরিষেবা শুরু করে যুদ্ধবিমানটি। বিমানটির থ্রাস্ট বা ওড়ার সময় ধাক্কার অনুপাতের তুলনায় ওজন হালকা হওয়ায় রকেটের মতো উল্লম্ব ভাবে উড়তে পারত এফ-১৫ ইগল।
সোভিয়েত নেতৃত্ব শীঘ্রই বুঝতে পারে যে আমেরিকার নতুন যুদ্ধবিমানটি সোভিয়েত যুদ্ধবিমানের তুলনায় প্রযুক্তিগত সুবিধায় বহু যোজন এগিয়ে গিয়েছে। সোভিয়েত বাহিনী কোমর বেঁধে লেগে পড়ে আমেরিকাকে টেক্কা দিতে। সু-২৭ নামের একটি অত্যাধুনিক ফাইটার জেট বা যুদ্ধবিমান তৈরি করে ফেলে সুখোইয়ের সাহায্যে।
দ্বৈত ইঞ্জিনের সুপারসনিক যুদ্ধবিমানটিকে আমেরিকার চতুর্থ প্রজন্মের জেট ফাইটারগুলির সমকক্ষ বা প্রতিযোগী হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। যুদ্ধবিমানটিতে ভারী অস্ত্র বহনের ক্ষমতা ছাড়াও এভিওনিক্স প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে রেডিয়োর বদলে সরাসরি ইলেকট্রনিক সিস্টেমের মাধ্যমে যোগাযোগ ও নেভিগেশন নিয়ন্ত্রিত হয়।
এই সু-২৭ বিমানকেই পরবর্তী কালে সোভিয়েত ইউনিয়ন দু’টি বিশেষ বিমানের উন্নত সংস্করণে পরিণত করে। একটি ছিল সু-৩০ এবং অপরটি সু-৩৩। রাশিয়ার বিমানবাহী রণতরীগুলির জন্য সোভিয়েত নৌবাহিনীর এমন একটি যুদ্ধবিমানের প্রয়োজন ছিল যা বিখ্যাত কুজনেতসভ রণতরী থেকে উড়তে পারে। কুজনেতসভ হল বিমান, হেলিকপ্টার এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম বহনে সক্ষম একটি বৃহৎ রণতরী। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই বিমানবাহী রণতরীটি ১৯৮৫ সালে নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
সমস্ত ধরনের আবহাওয়ার ঝড়ঝাপটা সইতে পারে এমন একটি বিমান সু-৩৩। রণতরী থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য বিমানটির নকশা ছিল সুখোইয়ের, তৈরি করেছিল ‘কমসোমোলস্ক নামুরে এয়ারক্রাফ্ট প্রোডাকশন অ্যাসোসিয়েশন’। সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে তৈরি হলেও পরে রাশিয়ায় কাছে হস্তান্তরিত প্রথম ‘ক্যারিয়ার’-ভিত্তিক যুদ্ধবিমান ছিল সু-২৭-এর উন্নত সংস্করণটিই (সু-৩৩)।
২৭ বছর আগে পরিষেবা দিতে শুরু করে সু-৩৩। ১৯৮৭ সালের ১৭ অগস্ট প্রথম উড়ানের এক দশকেরও বেশি সময় পর, আনুষ্ঠানিক ভাবে ৩১ অগস্ট, ১৯৯৮ সালে রুশ নৌবাহিনীতে যোগদান করে এটি। নেটোর কাছে বিমানটি ‘ফ্ল্যাঙ্কার ডি’ নামে পরিচিত। শত্রুবিমান প্রতিহতকারী যুদ্ধবিমানটি একক আসনবিশিষ্ট।
রণতরীর র্যাম্প থেকে স্বল্প সময়ের মধ্যে উড়ানের যুদ্ধবিমানের জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চ থ্রাস্ট এবং সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সু-৩৩-এর। বিমানবাহী রণতরীর কার্যক্রম সম্পাদনার জন্য সু-৩৩-এর একটি শক্তপোক্ত ল্যান্ডিং গিয়ার রয়েছে। রণতরী থেকে উড়ান ও অবতরণের যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা মোকাবিলার জন্য ল্যান্ডিং গিয়ারের কাঠামো মজবুত করা হয়েছে। ক্যারিয়ারের ডেকে জায়গা বাঁচাতে ভাঁজ করা ডানা এর বিশেষত্ব।
বিমানটি ৫৫ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় উড়তে পারে এবং এর পাল্লা তিন হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। এই যুদ্ধবিমানটি মাঝ-আকাশে জ্বালানিও ভরতে পারে। ফলে এর অপারেশনাল রেঞ্জ বৃদ্ধি পায়। এর দু’টি ইঞ্জিন সম্মিলিত ভাবে ৬০ হাজার পাউন্ড থ্রাস্ট উৎপন্ন করতে পারে। এর ফলে সর্বোচ্চ গতি প্রতি ঘণ্টায় ২৪০০ কিমি পর্যন্ত যেতে পারে।
১৪ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত অস্ত্র বহন করার ক্ষমতা রয়েছে এই যুদ্ধবিমানটির। এর মধ্যে রয়েছে আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র, ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র, গ্লাইড বোমা, রকেট। নৌ-আক্রমণ প্রতিরোধক হিসাবে যুদ্ধবিমানটি বিভিন্ন ধরনের জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে সক্ষম।
১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে সু-৩৩-এর উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হয়। মাত্র ৪০-৫০টি যুদ্ধবিমান তৈরি করা হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে (কিছু প্রতিবেদনে এই সংখ্যা ২৪ বলে উল্লেখ করা হয়েছে)। ইউরেশিয়ান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েকটি যুদ্ধবিমান ভারতকে বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছিল মস্কো। ভারত সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
একই প্রস্তাব গিয়েছিল চিনের কাছেও। চিনও রাশিয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়নি। সু-৩৩কে প্রত্যাখ্যান করে লালফৌজও। তবে প্রত্যাখ্যান করলেও সু-৩৩-এরই একটি প্রোটোটাইপকে নিয়ে বিপরীত-প্রকৌশল (রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং) করে নৌবাহিনীর জন্য উপযুক্ত একটি ক্যারিয়ার-সক্ষম ফাইটার তৈরি করে ফেলে চিন। তার নাম দেয় জে-১৫।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, ইউক্রেন সোভিয়েত যুগের বেশ কিছু সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। এর মধ্যে ছিল টি-১০কে-৩ যুদ্ধবিমান। এটিকে প্রাথমিক ভাবে সু-৩৩ প্রোটোটাইপ বলে ধরা হয়। ইউক্রেন তার ভয়াবহ আর্থিক সমস্যা মেটাতে তহবিল সংগ্রহের জন্য এই সামরিক সম্পদ বিক্রি করতে চেয়েছিল। ২০০১ সালে ঝোপ বুঝে কোপ মেরে চিন ইউক্রেনের থেকে টি-১০কে-৩ কিনে নেয়।
রুশ সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, ইউক্রেনীয় প্রোটোটাইপটি খারাপ অবস্থায় ছিল। ইঞ্জিন এবং কিছু এভিওনিক্সের অভাব ছিল তাতে। তবে, এর এয়ারফ্রেমের নকশায় সু-৩৩-এর সঙ্গে প্রচুর সাদৃশ্য ছিল। এটিকে পরীক্ষা করে বিশেষ করে ক্যারিয়ারের-নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য, যেমন ভাঁজ করা ডানা, শক্তিশালী ল্যান্ডিং গিয়ার এবং ক্যানার্ড সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতে পান চিনের সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞেরা।
রুশ সামরিক বিশ্লেষক ভ্যাসিলি কাশিন জানিয়েছিলেন রাশিয়ার প্রস্তাবমতো সু-৩৩ না কেনার নেপথ্যে ছিল বেজিঙের অর্থ সাশ্রয়ের সিদ্ধান্ত। পরিবর্তে তারা ইউক্রেন থেকে একটি মাত্র প্রোটোটাইপ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফলস্বরূপ, জে-১৫ তৈরিতে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সময় এবং বেশি অর্থ লেগেছিল। একই সঙ্গে প্রথম বিমানগুলি কম নির্ভরযোগ্য ছিল বলে কাশিন দাবি তুলেছেন।
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে এবং ২০০০ সালের গোড়ার দিকে, চিন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্তি প্রদর্শনের জন্য বিমানবাহী রণতরী-সহ নৌবাহিনী তৈরির চেষ্টা করছিল। এর জন্য তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ইউক্রেন। সোভিয়েত-নির্মিত কুজনেতসভ শ্রেণির ক্যারিয়ার ‘ভারিয়াগ’ তুলে দেওয়া হয় চিনের হাতে। পরবর্তী কালে ২০১২ সালে ‘লিয়াওনিং’ নাম দেওয়া হয় সেটির।
২০০১ সালে পিপল্স লিবারেশন আর্মি যখন ক্যারিয়ারটি হাতে পায়, তখন তারা বুঝতে পারে যে তাদের একটি ক্যারিয়ার-সক্ষম যুদ্ধবিমানের প্রয়োজন। কুজনেতসভ থেকে উড়ানের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট যুদ্ধবিমান ছিল সু-৩৩। তাই সোজা পথে রাশিয়ার থেকে বিমান না কিনে নিজেরাই রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে বিমান তৈরির চেষ্টা করে। বিপরীত প্রকৌশল ব্যবহার করে সোভিয়েত বিমানের আদলে চিনের বিমান তৈরির একাধিক নজির রয়েছে।
সু-৩৩-এর প্রথম উড়ানের এক মাসের ব্যবধানে আরও একটি রুশ যুদ্ধবিমানের মহড়া হয়েছিল। সেটি ছিল মিগ ২৯কে। সু-৩৩ ও মিগ ২৯কে একে অপরের প্রতিযোগী হলেও ১৯৯০ সালের রুশ সেনাবাহিনীর পছন্দের পাল্লা ভারী ছিল সু-৩৩-এর দিকেই। সে কারণে ৯০-এর দশকের শুরুতে মাত্র দু’টি মিগ ২৯কে-এর প্রোটোটাইপ তৈরি করা হয়েছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কয়েক বছর পর, রাশিয়ান নৌবাহিনীর বাজেট হ্রাস এবং কর্মক্ষম নৌবহর সঙ্কুচিত হওয়ার ফলে সু-৩৩-এর সমাদর কমতে থাকে। তারা শীঘ্রই বুঝতে পারে যুদ্ধবিমানটির বহুমুখী ক্ষমতা সীমিত। কাজের তুলনায় এর রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অন্য দিকে, মিগ-২৯কের উৎপাদন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনার জন্য সু-৩৩-এর তুলনায় সস্তা হওয়ায় রুশ সেনাবাহিনীতে মিগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২০০৪ সালে ভারত যখন মিগ-২৯কে-এর অর্ডার দেয়, তখন রুশ নৌবাহিনীও সঙ্গত কারণে এটিকে তাদের নিজস্ব বহরের জন্য গ্রহণ করে। মিগ-২৯কে-এর আধুনিক বিমানচালনা, বহুমুখী ক্ষমতা (আকাশ থেকে আকাশ, আকাশ থেকে ভূমি এবং জাহাজ-বিধ্বংসী), ছোট আকার এবং কম পরিচালন খরচ এটিকে রাশিয়ার সীমিত ক্যারিয়ার অপারেশনের জন্য আরও উপযুক্ত করে তোলে।
২০১৫-১৬ নাগাদ সিরিয়া অভিযানের সময় কুজনেতসভ রণতরীতে সু-৩৩-এর পাশাপাশি, মিগ-২৯-কে ব্যবহার করা শুরু করে রাশিয়া। সেই প্রাথমিক ক্যারিয়ার-ভিত্তিক ফাইটার হিসাবে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে মিগের এই যুদ্ধবিমানটি।
রাশিয়ান নৌবাহিনীর বিমান চলাচল প্রধান মেজর জেনারেল ইগর কোজিন ২০২০ সালে ঘোষণা করেছিলেন, কিছু সুখোই সু-৩৩ ক্যারিয়ার ফাইটারের উন্নত সংস্করণ আনছে, যাতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এগুলি কার্যকর থাকে। অন্য দিকে, অ্যাডমিরাল কুজনেতসভ একটি সমস্যাগ্রস্ত যুদ্ধজাহাজ। গত সাত বছর ধরে এটি মেরামতের কাজ চলছে, এবং জাহাজটি আবার কবে কার্যকর ভাবে যাত্রা করবে, তা নিশ্চিত নয়।
ফলে সু-৩৩-এর পরিচালনার জন্য উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম নেই। রণতরীটি কর্মক্ষম না হলে তার অর্থ হতে পারে যে আগামী বছরের মধ্যে অথবা ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে পরিষেবা থেকে প্রত্যাহার করা হতে পারে সুখোই যুদ্ধবিমানটিকে। সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলে মাত্র ২৭ বছরে আয়ু ফুরোতে পারে রুশ ফ্ল্যাঙ্কার যুদ্ধবিমানটির।