ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অশুভ সূচনা হয়েছিল ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহু মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী থেকেছে মানব ইতিহাস। ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্রের ব্যবহার হয়েছিল এই যুদ্ধে।
এই সময়ে শুরু হয় অস্ত্র প্রতিযোগিতা। শুরু হয় ভয়ঙ্কর বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ— জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে। আমেরিকা পরমাণু বোমা প্রস্তুত করে ১৯৪৫ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রহরে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল প্রযুক্তির যুদ্ধ। যুদ্ধে সমস্ত পক্ষই শত্রুর উপর আক্রমণ করার জন্য নতুন এবং উদ্ভাবনী উপায় খুঁজছিল। তাদের মধ্যে কিছু সফল হয়েছিল এবং অবশ্যই কিছু ব্যর্থ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একাধিক অত্যাধুনিক অস্ত্রের ভিড়ে উদ্ভব হয়েছিল কয়েকটি উদ্ভট অস্ত্রের।
কেমন ছিল সে সব আজব অস্ত্র? সেগুলির মধ্যে সফল হয়েছিল কোনগুলি? ব্যর্থই বা হয়েছিল কোনগুলি?
বাদুড় বোমা: ১৯৪২ সালের গোড়ার দিকে পেনসিলভ্যানিয়ার এক জন চিকিৎসক লিটল এস অ্যাডামস আমেরিকার হোয়াইট হাউসে একটি চিঠি পাঠান। সেখানে তিনি জাপানে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে এমন একটি অস্ত্রের ধারণা দিয়েছিলেন। অ্যাডামসের প্রস্তাব ছিল, বাদুড়ের সঙ্গে অগ্নিসংযোগকারী যন্ত্র সংযুক্ত করা হোক এবং বিমান থেকে ডানাযুক্ত সেই অস্ত্র নিক্ষেপ করা হোক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন মেরিন কর্পোরেশন এই অস্ত্রের ধারণাটি নিয়ে কাজ শুরু করে। তারা বাদুড়কে আত্মঘাতী বোমারু হিসাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। বাদুড়-বোমার নেপথ্যে ধারণা ছিল যে, সময়োপযোগী অগ্নিসংযোগকারী যন্ত্রে সজ্জিত বাদুড়গুলি জাপানের কোনও একটি শহরের উপর ছেড়ে দেওয়া হবে।
এগুলি স্বাভাবিক ভাবেই সমস্ত দিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং একটি বিশাল অগ্নিঝড়ের সূত্রপাত করবে। পরবর্তী ক্ষেত্রে পরমাণু বোমা অধিক কার্যকরী মনে হওয়ায় বাদুড়-বোমা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়নি।
পাঞ্জান্ড্রাম: এই অস্ত্রটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে ‘দ্য গ্রেট পাঞ্জান্ড্রাম’ নামেও পরিচিত। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এই সমরাস্ত্রটির পরিকল্পনা করেছিল। এটি মূলত ছিল একটি বিশাল রকেটচালিত, বিস্ফোরকবাহী গাড়ি। বিস্ফোরক ভর্তি একটি স্টিলের ড্রাম কাঠের চাকার মধ্যে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকত।
চালকবিহীন পাঞ্জান্ড্রামটি একটি অবতরণকারী জাহাজ থেকে নিক্ষেপ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সুরক্ষিত প্রাচীর ধ্বংস করার লক্ষ্য নিয়েই এই অস্ত্রটি তৈরি করা হয়। যদিও এই অস্ত্র কখনও যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়নি। কারণ পরীক্ষার সময় প্রতি বারই পাঞ্জান্ড্রামগুলি লক্ষ্যে পৌঁছনোর আগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিল।
কুকুর: বোমা শনাক্ত করতে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়মিত ব্যবহৃত হয় কুকুর। অতি উপকারী প্রাণীর ইন্দ্রিয় প্রখরতা ও শক্তিতে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য অস্ত্র হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল কুকুরকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে সোভিয়েতরা একটি অভিনব ও একই সঙ্গে অমানবিক একটি অস্ত্র নির্মাণ করে। প্রশিক্ষিত কুকুরদের আত্মঘাতী বোমারু হিসাবে ব্যবহার করে তারা।
সোভিয়েত কুকুরগুলিকে জার্মান ট্যাঙ্ক লক্ষ্য করে আক্রমণ করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তাদের পিঠের থলিতে কয়েক পাউন্ড বিস্ফোরক ভরে দেওয়া হত। ৪০ হাজারেরও বেশি কুকুরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু খুব কম সংখ্যকই লক্ষ্যে হানা দিতে সক্ষম হয়। নাৎসিরা যুদ্ধক্ষেত্রে যে কোনও কুকুরকে দেখলেই গুলি করে মেরে ফেলত।
ক্রমলাউফ: এটি একটি রাইফেল। জার্মানি এমন একটি বন্দুক তৈরির চেষ্টা করেছিল যেগুলি কোনাকুনি গুলি করতে পারে। অদ্ভুত গড়নের এই সমরাস্ত্রটির দু’টি সংস্করণ ছিল।
বাধার চারপাশে বা তার উপর দিয়ে গুলি চালানোর জন্য ৩০ ডিগ্রি বাঁকা এবং একটি সাঁজোয়া যানের ভিতর থেকে গুলি চালানোর জন্য ৯০ ডিগ্রি বাঁকা ব্যারেল তৈরি করা হয়েছিল। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাজেয়াপ্ত অস্ত্র নিয়ে আমেরিকা পরীক্ষা চালাতে গিয়ে ধরা পড়ে এই অস্ত্রটির মারাত্মক ত্রুটি।
পরীক্ষায় ধরা পড়ে বাঁকা ব্যারেলের মধ্যে দিয়ে গুলি ঢুকে পড়ামাত্রই তা দু’টুকরো হয়ে যায়, এর ফলে অস্ত্রের পাল্লা এবং নির্ভুলতা অনেকাংশে কমে যেত। এমনকি মাত্র কয়েকশো রাউন্ড গুলি চালানোর পরে ব্যারেলটিও দু’টুকরো হয়ে যায়।
১৯৪২ সালে জার্মানি তাদের বিখ্যাত চৌম্বকীয় ‘অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মাইন’ আবিষ্কার করেছিল, যার নাম ছিল হাফথোল্লাডাং বা হাতে ধরা যায় এমন মাইন। এটি একটি ছোট বিস্ফোরক যন্ত্র, যা চৌম্বকীয় প্রক্রিয়ার দ্বারা শত্রুপক্ষের যানবাহনে বা অস্ত্রে আটকানো যেত।
এটি একটি ছোট, হালকা চৌম্বক মাইন। এই মাইনটির নীচে থাকত শক্তিশালী তিনটি চুম্বক। প্রতিটির দু’টি মেরুর মাঝখানে ফাঁকা জায়গা রাখা হত। এর ফলে সেখানে তৈরি হত শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র। এক জন পদাতিক সৈন্য এটিকে শত্রুর ট্যাঙ্কে আটকে দিয়ে আসতেন।
এটি ব্যবহার করা খুবই বিপজ্জনক ছিল। এটিকে শত্রুর যুদ্ধযানের উপর আটকে আসার পর সেটি ফাটলে সৈন্যের জীবনসংশয় হত। এটি প্রয়োগ করাও অত্যন্ত কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ ছিল। শেষ পর্যন্ত এটি অপ্রয়োজনীয় অস্ত্র হিসাবে বিবেচিত হয়।
পায়রাবাহিত ক্ষেপণাস্ত্র: এই ক্ষেপণাস্ত্রের ধারণাটি প্রথমে ১৯৪০-এর দশকে আমেরিকার সামরিক বাহিনীর মাথায় আসে। ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল, লক্ষ্যবস্তুতে সঠিক ভাবে আঘাত করা। তখন প্রযুক্তি খুবই সীমিত ছিল। কার্যসিদ্ধি করতে তাই বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভুত ধারণা নিয়ে আসেন। ঠিক করা হয়, ব্যবহার করা হবে পায়রা।
বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পায়রাকে রাখা হত ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে। পায়রা নিজে লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে সক্ষম ছিল এবং একটি ক্যামেরা বা সেন্সরের মাধ্যমে সে তার গতিপথ অনুযায়ী ক্ষেপণাস্ত্রকে পরিচালিত করত। ক্ষেপণাস্ত্রের বিশেষ অংশগুলো পায়রার দৃষ্টি অনুযায়ী তার গতিপথ পরিবর্তন করতে থাকত, যাতে এটি সঠিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে, পায়রাবাহিত ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়।
গুস্তাভ গান: বিশ্বের ‘সবচেয়ে বড়’ কামান গুস্তাভ আবিষ্কার করে জার্মানি। ১৯৩৬ সালে এটি তৈরি করেছিল জার্মান সংস্থা ‘ক্রুপ’। কামানটি ছিল চওড়ায় ৭.১ মিটার এবং দৈর্ঘ্যে ৪৭.৩ মিটার। এটির ওজন ছিল ১৩৫০ টন। কেবল কামানের নলটিরই মাপ ছিল ১০০ ফুট। প্রয়োজনে ৪৬ কিমির বেশি দূরের লক্ষ্যবস্তুতে সাত টনের গোলা ছুড়তে পারত গুস্তাভ।
এই কামানটির বিশাল দৈর্ঘ্য এবং ওজন জার্মান সেনাকে বিপাকে ফেলেছিল। শত্রুপক্ষের নজর এড়িয়ে কামানটিকে লুকিয়ে রাখাও যেত না। কামানটি চালনা করার খরচ তো বিপুল ছিলই, কেবল সেটিকে সচল রাখার জন্যই কমপক্ষে ২০০০ সেনার প্রয়োজন হত। যুদ্ধক্ষেত্রে এত বিপুল পরিমাণ লোকেপ জোগান অনেক সময়ই দিতে পারেনি জার্মান সেনা।