যেখানে ২১ বছরের পর সাধারণত মানুষের আর উচ্চতা বাড়ে না, সেখানে তাঁর উচ্চতা বাড়তে শুরু করেছিল প্রায় ওই সময় থেকেই। শুরুর দিকে তিনি নিজেও কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ২০ বছরের পর থেকেই অ্যাডাম লক্ষ করেন তাঁর চেহারায় আমূল পরিবর্তন আসছে। ১৮ বছর বয়সে তাঁর উচ্চতা ছিল ৪৬ ইঞ্চি। সেটাই ২১ বছর পেরোতে না পেরোতেই ৯২ ইঞ্চি হয়ে গিয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও এমনটাই ঘটেছিল অস্ট্রিয়ার অ্যাডাম রেইনার জীবনে।
ছোটবেলায় উচ্চতা বেশ কম হওয়ায় অ্যাডাম স্কুলের গণ্ডি পার করতে পারেননি। স্কুলে গেলেই সহপাঠীরা ‘বেঁটে’ বলে ঠাট্টা করত। অগত্যা স্কুলে যাওয়াই ছেড়ে দেন তিনি।
পরে তাঁর ইচ্ছে হয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার। সেইমতো ১৮ বছর বয়সে চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু উচ্চতা ৪ ফুটেরও কম হওয়ায় প্রথমেই বাদ পড়ে তাঁর নাম। সেনাবাহিনীর চিকিৎসকেরা তাঁকে প্রথমেই ‘বামন’ বলে দাগিয়ে দেন। দুর্বল বলে বাদ পড়েন সেনার চাকরি থেকে।
তবে হাল ছাড়েননি অ্যাডাম। সেনায় যোগদানের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। পরের বছর দু’ইঞ্চি উচ্চতা বাড়িয়ে ফের সেনার পরীক্ষায় বসেন। কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হন। কারণ তখন সেনাবাহিনীতে ন্যূনতম উচ্চতা প্রয়োজন ছিল প্রায় ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি থেকে ৫ ফুট। উচ্চতার প্রয়োজনীয় মাপকাঠি ছুঁতে পারেননি তিনি।
অবাক করার বিষয় হল অ্যাডাম উচ্চতায় খাটো হলেও হাত-পাগুলি ছিল আশ্চর্য রকমের লম্বা লম্বা। প্রথম বার সেনার পরীক্ষায় বসার সময় তাঁর জুতোর মাপ যা ছিল, দ্বিতীয় বার তার প্রায় দ্বিগুণ ছিল। এত কম উচ্চতার কোনও ব্যক্তির এত বড় পা দেখে অবাক হয়েছিলেন সেনাকর্মীরাও।
১৮৯৯ সালে অস্ট্রিয়ার গ্রাজ শহরে জন্ম অ্যাডামের। জীবনের প্রথম ২০ বছর ‘বেঁটে’ টিপ্পনী শুনতে হয়েছে। অথচ সেই ছোটখাটো অ্যাডাম রাতারাতি এমন লম্বা হতে শুরু করেন, যা দেখে তিনি নিজেও অবাক হয়ে যান।
অ্যাডামের পরিবারের সকলেই (বিশেষত মা-বাবা) স্বাভাবিক উচ্চতাসম্পন্ন ছিলেন। তিনি একাই স্বাভাবিকের থেকে আলাদা ছিলেন। তবুও অ্যাডাম যে বিরল এবং ভয়ঙ্কর রোগের শিকার হতে চলেছেন, তা তাঁর ধারণার বাইরে ছিল।
যখন চেহারা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে তখন আর কোনও কাজ করার ক্ষমতা ছিল না তাঁর। শরীরে বিরল রোগ বাসা বাঁধছিল। ধীরে ধীরে দৈনন্দিন কাজগুলি করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছিলেন অ্যাডাম।
শরীরের এমন পরিবর্তন দেখে তড়িঘড়ি অ্যাডাম ছোটেন চিকিৎসকের কাছে। প্রথম দিকে তাঁরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। বেশ কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা চলে অ্যাডামের উপর। জানা যায়, অ্যাক্রোমেগালি নামে এক বিরল রোগে ভুগছেন অ্যাডাম।
চিকিৎসকদের মতে, অ্যাডামের পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের উপরে দীর্ঘ দিন ধরেই বেড়ে উঠেছিল একটি টিউমার। আর তার জন্য অস্বাভাবিক হরমোন নিঃসরণ সংক্রান্ত সমস্যার শিকার হন তিনি। গ্রোথ হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণের ফলে বেঁটেখাটো অ্যাডাম রাতারাতি এমন লম্বা হতে শুরু করেন।
অ্যাডামের ওই টিউমারটিকে কেটে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে সময় চিকিৎসাবিজ্ঞান তেমন উন্নত ছিল না। ফলত বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচার ছিল সেটি। কিন্তু শেষমেশ সফল হয় অস্ত্রোপচার।
এর ফলে তরতরিয়ে বাড়তে থাকা অ্যাডামের উচ্চতা আর বৃদ্ধি পায় না। কিন্তু তাতে কী! উচ্চতা রুখে দেওয়া হলেও অ্যাডামের শিরদাঁড়া বৃদ্ধি হতে থাকে। ৩০ বছর বয়সের পর থেকেই তাঁর শরীর ভেঙে পড়তে শুরু করে।
এক দিকে উচ্চতা বাড়ছে না, অন্য দিকে মেরুদণ্ড বেড়ে বেঁকে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে কাজ করার ক্ষমতা সম্পূর্ণ ভাবে হারিয়ে ফেলেন অ্যাডাম। একটা সময়ের পর তিনি সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে যান।
অ্যাডামের শেষ জীবন ছিল অত্যন্ত কষ্টের। শয্যাশায়ী হয়ে পড়ার পরই অ্যাডামের পরিবার তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। সেখানেই বাকি জীবন শয্যাশায়ী অবস্থাতেই কেটেছিল তাঁর। শেষ জীবনে অ্যাডাম দৃষ্টি ও শ্রবণক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছিলেন।
১৯৫০ সালে ৫১ বছর বয়সে প্রয়াত হন অ্যাডাম। মৃত্যুর সময় তাঁর উচ্চতা ছিল ৭ ফুট ৮ ইঞ্চি। বিশ্বের ইতিহাসে অ্যাডামই প্রথম যিনি একই জীবনে খর্বকায় এবং দৈত্যাকার চেহারাসম্পন্ন ছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে আজও এই বিরল রোগ নিয়ে আলোচনা হয়।