ঠান্ডা মাথায় একের পর এক প্রাণ কেড়েছে এমন অনেক সিরিয়াল কিলারের গল্প জানা রয়েছে অনেকের। তবে বিশ্বের কোনও একটি কোনায় এখনও কি লুকিয়ে রয়েছে এমন এক সিরিয়াল কিলার, যার ত্রাসে একসময় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল উত্তর ক্যালিফর্নিয়া।
১৯৬৮ থেকে ৭০-এর দশকে উত্তর ক্যালিফর্নিয়ায় একের পর এক খুনের ঘটনায় ত্রাসের সঞ্চার ঘটিয়েছিল এই ব্যক্তি। খুন করত, তার পর পুলিশকে সাহায্য করতে চিঠিও পাঠাত। কিন্তু তার পরেও পুলিশের জালে ধরা পড়েনি সে।
খুনির নাম ‘জ়োডিয়াক কিলার’। তবে এটি তাঁর আসল নাম নয়। এখনও অপরাধী কে, কোথায় থাকেন সে বিষয়ে কিছুই জানে না পুলিশ। তা হলে ‘জ়োডিয়াক কিলার’ নামটাই বা এল কোথা থেকে!
১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের অক্টোবর। এই ক’মাসের মধ্যেই সানফ্রান্সিসকো, লেক বেরিয়েসা, ভাল্লেজো, বেনিসিয়ায় রহস্যময় ভাবে আক্রান্ত হন সাত জন।
যদিও অনেকেই বলেন ১৯৭০ দশকের শুরুতেও কয়েকটি খুন করেছেন ‘জ়োডিয়াক কিলার’। তবে যে সাত জনকে খুন করেছে এই সিরিয়াল কিলার তাঁদের বয়স ১৬ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। চার জন পুরুষ এবং তিন জন মহিলা ছিলেন তাঁদের মধ্যে। দু’বার ব্যর্থও হয়েছে এই ঘাতক। এর জেরে প্রাণে বেঁচে যান দু’জন।
প্রতিটি খুনের পর পুলিশ কোনও ভাবেই সুরাহা খুঁজে পায়নি। বারংবার খুন হওয়ার জায়গায় তল্লাশি চালিয়েও কিচ্ছু পাওয়া যায়নি। এমন সময় পুলিশকে সাহায্য করতে বিশেষ পন্থা নেয় খুনি নিজেই।
‘সানফ্রান্সিসকো ক্রনিকল’-এ চিঠি পাঠাতে থাকে খুনি। তবে চিঠিতে সে অর্থে কিছুই লেখা থাকত না। থাকত শুধু বারোটি রাশিচিহ্ন আঁকা কোড, যা দেখে প্রাথমিক ভাবে পুলিশ কিছুই উদ্ধার করতে পারত না।
সঙ্কেতচিহ্ন সমেত এমন ৩৪০টি চিঠি হাতে আসে পুলিশের। তা দিয়েও কিচ্ছু লাভ হয়নি। বছরের পর বছর শত চেষ্টা করেও পুলিশ রাশিচিহ্নযুক্ত কোডগুলি থেকে কোনও সূত্রই বার করতে পারেনি।
রাশিচিহ্নযুক্ত সঙ্কেত পাঠাত বলে এই সিরিয়াল কিলারের নাম হয়ে যায় ‘জ়োডিয়াক কিলার’। তার প্রথম শিকার ১৯৬৮ সালে। ১৬ বছরের বেটি লউ জেনসেন এবং ১৭ বছরের ডেভিড আর্থার ফ্যারাডে।
এই দুই কিশোর-কিশোরী সে দিন প্রথম বার ডেটে গিয়েছিল। দিনটা ছিল ২০ ডিসেম্বর। লেক হেরমান রোডে এক পথচারীর নজরে পড়ে কিশোর-কিশোরীর দেহ। গাড়ির সামনে মৃত অবস্থায় পড়েছিল তারা। তাদের শরীর গুলিবিদ্ধ ছিল।
পরের শিকার ২২ বছরের তরুণী ডারলেন ফেরিন। সদ্য মা হওয়া তরুণীকেও ছাড়েনি ‘জ়োডিয়াক কিলার’। ১৯৬৯ সালে ৪ জুলাই তাঁকে খুন করেছিল। এর পর একের পর এক খুন হতে থাকে। বেশির ভাগ সময়ই আততায়ী গুলি করে খুন করত।
এক বার গুলি লাগলেও কোনও মতে প্রাণে বেঁচে যান মাইকেল ম্যাজেউ। হামলা চলাকালীন গাড়িতে বসেছিলেন তিনি। ‘জ়োডিয়াক কিলার’-এর ভুল নিশানার জেরে প্রাণ বাঁচে তাঁর। এই ঘটনার পরে আবারও একটি ভুল নিশানার জেরে প্রাণ বেঁচেছিল আরও এক জনের।
ভাল্লেজোর পার্কিং লটে মাইকেলের উপর হামলা হয়েছিল। সে সময় ঘটনাস্থলে অনেকেই ছিলেন। প্রকাশ্যে এমন ভাবে খুন করার সাহস নিয়ে ক্রমেই চর্চা শুরু হয়ে যায় আমেরিকা জুড়ে।
সে ঘটনার পরেও আততায়ী থেমে থাকেননি। একে একে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে অপরাধী। দিশেহারা হয়ে যায় পুলিশ। যদিও এত দিনে মাত্র এক জনকেই সন্দেহ করেছিল পুলিশ। তার নাম আর্থার লেই অ্যালেন।
প্রাথমিক ভাবে অনেকের নাম উঠে এলেও আর্থার ছিলেন এই মামলার একমাত্র সন্দেহভাজন ব্যক্তি। তিনি পেশায় এক জন শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষক হয়েও ভয়ঙ্কর একটি অপরাধ করেছিলেন আর্থার। পুলিশ যখন তাঁকে সন্দেহ করে, তখন তিনি একজন দোষী সাব্যস্ত হওয়া শিশু নির্যাতনকারী অপরাধী।
কিন্তু এর সঙ্গে ‘জ়োডিয়াক কিলার’-এর কী যোগ? আসলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী জ়োডিয়াক কিলারের আদলের সঙ্গে তার আশ্চর্য সাদৃশ্য। এ ছাড়াও আর্থারের কাছ থেকে একটি বিশেষ ঘড়ি পাওয়া যায়। রাশিচিহ্ন দেওয়া ঘড়ি। এমনকি, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় তিনি নাকি প্রায়ই ‘জ়োডিয়াক কিলার’কে নিয়ে নানা রকম মন্তব্যও করতেন।
সন্দেহ আর সত্যি হল কই! ১৯৯২ সালে আর্থার মারা যান। এমনকি তাঁর চিঠিগুলির ডিএনএ টেস্টও করা হয়েছিল। তাতে আর্থারের সঙ্গে কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর ফলে আইন মেনে আর্থারকে কোনও শাস্তিও দেওয়া হয়নি।
‘‘আমাকে খুঁজে বার করতে মজা পাচ্ছেন? আমি কিন্তু গ্যাস চেম্বারে ভয় পাই না। তা আসলে আমাকে স্বর্গের কাছাকাছিই নিয়ে যাবে। এই পৃথিবীতে আমি একাধিক ক্রীতদাস রেখে যাব। তারা আমার জন্য কাজ করবে।’’— প্রতিটি চিঠির এটাই অর্থ, এমনটাই দাবি করেছিলেন এক গণিতবিদ।
২০২১ সালে একদল গোয়েন্দার দাবি ছিল তারা নাকি জ়োডিয়াক কিলারকে খুঁজেও পেয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি তারা। অপরাধী হয়তো মার্কিন সেনাবাহিনীতে কাজ করত, বেশ কিছু সঙ্কেত সূত্রে এমন সন্দেহও জেগেছে মার্কিন পুলিশের মনে। তবে কোনওটিই ধোপে টেকেনি। আজও হদিস মেলেনি সেই নৃশংস হত্যাকারীর।