এমন বন্ধু আর কে আছে? সাফল্য উপভোগ থেকে শুরু করে ঠান্ডা লাগলে আরাম দেওয়া— সবেতেই ‘বুড়ো সাধু’র জুড়ি মেলা ভার। সুরাপ্রেমীদের কাছে ‘ওল্ড মঙ্ক’ শুধুমাত্র ব্র্যান্ড নয়, বরং একটি আবেগ। ভারতে তৈরি সবচেয়ে বড় বিদেশি মদের ব্র্যান্ডও ছিল ওল্ড মঙ্ক।
জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই ব্র্যান্ডটি হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া সুরা। এর পর দীর্ঘ দিন পর্যন্ত বিক্রির সেই ধারা বজায় ছিল। সাত দশকেরও বেশি সময় আগে প্রথম চালু হওয়ার পর থেকে ওল্ড মঙ্কের জনপ্রিয়তা কার্যত অপরিবর্তিত রয়েছে। এ দেশে আর কোনও মদের ব্র্যান্ড নিয়ে এত আবেগ আর আনুগত্য নেই বোধহয়।
ভারতে ওল্ড মঙ্কের রয়েছে এক নিজস্ব ঘরানা। ভারতের প্রায় প্রতিটি পানশালা থেকে শুরু করে বিলাসবহুল রেস্তরাঁ— ওল্ড মঙ্কের বোতল খুঁজে পাওয়া যাবে না এমনটা প্রায় অসম্ভব। তেমনই খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে সেই সুরাপ্রেমীকে, যিনি এটির স্বাদ গ্রহণ করেননি অথবা উপভোগ করেননি। আর এক জন নিবেদিতপ্রাণ ওল্ড মঙ্ক ভক্তকে অন্য কোনও ব্র্যান্ডে আসক্ত করে তোলা সহজ কাজ নয়।
সময়টা ২০১৫। তখনই ভারত জুড়ে গুজব রটে, ওল্ড মঙ্ক তৈরি করা নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ বিক্রিবাট্টায় মন্দা। সুরাপ্রেমীদের হাহাকারে সমাজমাধ্যমে কান পাতা দায় হয়ে পড়ে। দিন কয়েক ধরে ট্রেন্ডিংয়ের শীর্ষে ছিল ওল্ড মঙ্ক। শেষে নির্মাতা সংস্থা বিবৃতি দিয়ে জানায়, বন্ধ হচ্ছে না ভক্তদের প্রিয় ওল্ড মঙ্ক।
এডওয়ার্ড ডায়ার নামে স্কটল্যান্ডের এক বাসিন্দা ১৮৫৫-তে হিমাচল প্রদেশের কসৌলিতে শুরু করেন এক বিয়ার তৈরির কারখানা। এ দেশে বসবাসকারী ব্রিটিশদের মধ্যে সস্তার বিয়ার খাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করে তিনি হিমাচলে পত্তন করে ফেলেন এক ব্রিউয়ারির। এই এডওয়ার্ড ডায়ার ছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে থাকা কুখ্যাত ব্রিটিশ আর্মি অফিসার রেজিনাল্ড ডায়ারের বাবা।
স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৯ সালে এই ব্রিটিশ ব্রিউয়ারি কিনে ফেলেন নরেন্দ্রনাথ মোহন। মোহন ম্যাকিন নামে নতুন কারখানাটি উত্তরপ্রদেশের গাজ়িয়াবাদে সরিয়ে আনেন তিনি। মূল সংস্থার জন্মের শতবর্ষ পেরিয়ে জন্ম নেয় আর একটি কালজয়ী ব্র্যান্ড। নরেন্দ্রনাথের বড় ছেলে প্রাক্তন সেনা আধিকারিকের হাত ধরে বাজারে আসে ‘ওল্ড মঙ্ক’। তিনি কর্নেল বেদরতন মোহন, একাধারে ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ এবং লখনউয়ের মেয়র।
‘ওল্ড মঙ্ক’ নামের উৎপত্তি নিয়ে নানা মুনির নানা মত। শোনা যায়, ইউরোপে বেড়াতে গিয়ে বেদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে এক বেনেডিক্টিন সাধুর। সেন্ট বেনেডিক্টের অনুসারীরা এক গোপন ফর্মুলা দিয়ে সুরা প্রস্তুত করতেন। বেদ সেই সুরার দারুণ ভক্ত ছিলেন। সুরা কী ভাবে তৈরি হয় সেই পদ্ধতি জানার জন্য উৎসুক ছিলেন বেদ।
এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে উৎকৃষ্ট রাম তৈরির পদ্ধতিটি হস্তগত করেন বেদ। ভারতে ফিরে এসে বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর গোপন রেসিপি দিয়ে কসৌলির কারখানায় উৎপাদন আরম্ভ করলেন বেদ। ইউরোপের সাধুর শেখানো গোপন উপকরণের সঙ্গে খাঁটি ভারতীয় কিছু উপাদানের মিশেলে তৈরি হল ভারতে তৈরি প্রথম ব্র্যান্ডেড রাম।
শোনা যায় হিমাচলি একটি ঝর্নার জল এই রাম তৈরির অন্যতম উপাদান। এর অনন্য স্বাদের উৎসও নাকি সেটাই। ইউরোপের সেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসীকে উৎসর্গ করেই নাকি বেদ দেশীয় পানীয়টির নাম রাখেন ‘ওল্ড মঙ্ক’। নাম নিয়ে আরও যে একটি গল্পকাহিনি জুড়ে রয়েছে। সেটি হল গুমনামি বাবার। শোনা যায় গাজ়িয়াবাদে গুমনামি বাবার সঙ্গে দেখা করে দারুণ প্রভাবিত হন বেদ। বুড়ো সাধু গুমনামি বাবার ইংরেজি তর্জমাই হল ওল্ড মঙ্ক।
নরেন্দ্রনাথ প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৬৯ সালে। তাঁর মৃত্যুর চার বছরের মধ্যেই ৪৫ বছর বয়সি বেদের মৃত্যু হয়। দাদার মৃত্যুর পর মোহন ম্যাকিনের হাল ধরেছিলেন ভাই ব্রিগেডিয়ার কপিল মোহন। মূলত তাঁর হাত ধরেই ওল্ড মঙ্কের ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। কপিল পুরোটাই সম্ভব করেছিলেন কোনও বিজ্ঞাপন ছাড়াই। মজার কথা এই যে, দাদা বেদ সুরাপ্রেমী ও সুরার সমঝদার হলেও ভাই কপিল কোনও দিন সুরা ছুঁয়ে দেখেননি।
১৯৭৩ সাল থেকে সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন কপিল। ‘ওল্ড মঙ্ক’কে এক্সক্লুসিভ ব্র্যান্ড হিসাবে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি। কপিল বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞাপন নয়, অনন্য স্বাদই সুরাপ্রেমীদের কাছে ‘ওল্ড মঙ্ক’কে প্রিয় করে তুলবে। মুখে মুখে প্রচারের সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে সমস্ত ব্র্যান্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছিল ‘বুড়ো সাধু’।
সুরাপ্রেমীরা এই মদে খুঁজে পাবেন কফি, ক্যারামেল, নানাবিধ ফল, ভ্যানিলা, দারুচিনির সুগন্ধযুক্ত এক অনবদ্য স্বাদ। তবু আজও কেউ সন্ধান করতে পারেননি এর ফর্মুলার গোপন রহস্য। তেমনই আজও পরিবর্তন হয়নি রামের প্যাকেজে। আজও পেটমোটা বোতলে করে বিক্রি হয় ‘ওল্ড মঙ্ক’। লেবেলও অপরিবর্তিত। পরবর্তী কালে অন্যান্য আকারের বোতল এলেও পুরনো কাচের বোতলটি অদ্যাবধি পাল্টানো হয়নি।
‘ওল্ড মঙ্ক’ শুধু ভারত জয় করেই ক্ষান্ত হয়নি। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, জাপান, কানাডা, কেনিয়া, নিউ জ়িল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি-সহ ৫০টিরও বেশি দেশে ‘রামভক্ত’ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন।
ওল্ড মঙ্কের জনপ্রিয়তার একটা কারণ যদি হয় এর স্বাদ, অন্যটা এবং প্রধান কারণ অবশ্যই এর দাম। কিছু কিছু পণ্যের জনপ্রিয়তা এমনই হয় যে, পণ্য ও তার ব্র্যান্ড মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ‘ওল্ড মঙ্ক’ তেমনই। সাবালক হওয়ার পর প্রথম সুরায় চুমুক হোক বা বিত্তশালী মানুষদের আসর— অবারিত দ্বার এই সুরাটির।