মাত্র দু’মাসের ব্যবধান। তার মধ্যেই পাল্টে গেল সব হিসাব। চিন সফরে পহেলগাঁও জঙ্গি হামলা নিয়ে বড় কূটনৈতিক সাফল্য পেলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর উপস্থিতিতে জম্মু-কাশ্মীরের বৈসরন উপত্যকার সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিও-র (সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজ়েশন) ন’টি সদস্য রাষ্ট্র। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ‘অস্বস্তি’ চেপে রেখে তাতে সম্মতি জানাতে একরকম বাধ্য হন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফও।
চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর পহেলগাঁও-কাণ্ড নিয়ে যৌথ বিবৃতি দেয় এসসিও। সেখানে পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না থাকলেও সংশ্লিষ্ট জঙ্গি হামলার মদতদাতাদের বিরুদ্ধে উঠেছে বিচারের দাবি। অন্য দিকে, বিদেশের মাটিতে এ-হেন কূটনৈতিক সাফল্যে ষোলো আনা কৃতিত্ব চার জনকে দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। সেই তালিকায় প্রধানমন্ত্রী মোদী ছাড়াও জায়গা পেয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার) অজিত ডোভাল।
গত জুনে চিনের কিংডাওতে বৈঠকে বসেন এসসিও-ভুক্ত দেশগুলির প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাজনাথ। কিন্তু, সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির তৈরি করা যৌথ বিবৃতিতে সই করতে অস্বীকার করেন তিনি। কারণ হিসাবে জানা যায়, সেখানে পহেলগাঁও হামলার কোনও উল্লেখ ছিল না। অথচ বালোচিস্তান বিদ্রোহীদের গায়ে সন্ত্রাসবাদী তকমা সেঁটে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তান। ফলে তাতে অনুমোদন দেননি ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এর জেরে যৌথ বিবৃতি ছাড়াই শেষ হয় ওই সম্মেলন।
কিংডাওয়ের বৈঠকে যৌথ বিবৃতি নিয়ে শুধুমাত্র প্রতীকী প্রতিবাদ জানিয়েই চুপ করে থাকেননি রাজনাথ। পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ মুহাম্মদের সামনেই সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে নাম না করে ইসলামাবাদকে হুঁশিয়ারি দেন তিনি। বলেন, ‘‘জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দু’মুখো আচরণের কোনও জায়গা নেই। যারা সন্ত্রাসবাদকে নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থপূরণের উদ্দেশ্যে প্রশ্রয় দেয় এবং ব্যবহার করে, তাদের এর পরিণতি ভোগ করতেই হবে।’’ এ ব্যাপারে পদক্ষেপের প্রশ্নে এসসিও-র দ্বিধা থাকা কাম্য নয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এসসিও-র অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র হল পাকিস্তান। রাজনাথ দেশে ফেরার পর সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির যৌথ বিবৃতি পাশ না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে নয়াদিল্লি। এ প্রসঙ্গে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘‘ভারত চেয়েছিল সন্ত্রাসবাদ নিয়ে উদ্বেগের কথা ওই নথিতে থাকুক। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট দেশ তা মেনে নিতে পারছিল না। সেই কারণেই বিবৃতিটি গৃহীত হয়নি।’’ এ ব্যাপারে আপত্তি তোলা দেশটি যে পাকিস্তান, ইশারায় তা স্পষ্ট করে কেন্দ্রের মোদী সরকার।
অগস্টে ভারত সফরে আসেন চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই। নয়াদিল্লিতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ডোভাল এবং বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন তিনি। সেখানে ওঠে সীমান্ত সংঘাত এবং সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাপিয়ে দেওয়া শুল্কের জেরে তত দিনে অবশ্য সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছে বেজিং। ফলে ভারতকে কাছে পেতে ড্রাগন-সরকার যে কতটা মরিয়া, তা বোঝাতে ভোলেননি ওয়াং ই, খবর সূত্রের।
গত ৩১ অগস্ট চিনের তিয়ানজিন শহরে এসসিও-ভুক্ত দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠকে যোগ দেন মোদী। সম্মেলনের প্রথম দিনই তাঁর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেন ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। দু’পক্ষের আলোচনা চলে প্রায় ৫০ মিনিট। পরে এই ইস্যুতে ভারতের বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী জানান, শি-র সঙ্গে বৈঠকে সীমান্তপার সন্ত্রাসবাদের প্রসঙ্গ তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী। জঙ্গি কার্যকলাপ যে দুই প্রতিবেশী দেশকেই প্রভাবিত করছে, তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তিনি।
বিদেশসচিব মিস্রী আরও জানান, পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করতে ভারত ও চিনের যৌথ উদ্যোগ জরুরি বলে জিনপিঙের সঙ্গে আলোচনায় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, ভারতের এ-হেন কড়া মনোভাব চিনের পক্ষে অবজ্ঞা করা সম্ভব হয়নি। নয়াদিল্লির সহযোগিতা পেতে হলে ইসলামাবাদের থেকে যে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি প্রেসিডেন্ট শি-র।
মোদীর সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রকাশ্যে অবশ্য সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে একটি শব্দও খরচ করেননি জিনপিং। তবে নয়াদিল্লিকে নিয়ে বড় বার্তা দেন তিনি। বলেন, ‘‘চিন এবং ভারত সবচেয়ে সভ্য দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। আমরা বিশ্বের দু’টি সবচেয়ে জনবহুল দেশ। আমাদের বন্ধুত্ব, প্রতিবেশী হিসাবে একে অপরের পাশে থাকা জরুরি। ড্রাগন এবং হাতির একজোট হওয়া দরকার।’’
১ সেপ্টেম্বর এসসিও-র বৈঠকে পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ড নিয়ে ফের পাকিস্তানকে নিশানা করেন মোদী। তিনি বলেন, ‘‘পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলা তো শুধু ভারতের আত্মায় আঘাত নয়, বরং তা সেই সমস্ত দেশের প্রতি খোলামেলা চ্যালেঞ্জ, যারা মানবতায় বিশ্বাস রাখে। আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোনও দ্বিচারিতা বরদাস্ত করা হবে না।’’ তাঁর ওই ভাষণের পরই যৌথ বিবৃতি জারি করে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’।
তিয়ানজিনের সম্মেলনে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়ের সামনেই মোদী বলেন, ‘‘কেউ কেউ খোলাখুলি ভাবে সন্ত্রাসবাদকে মদত দিচ্ছেন।’’ পরে এসসিও-র তরফে জারি করা যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘সদস্য রাষ্ট্রগুলি পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। নিহত এবং আহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছে তারা। এই ঘটনার অপরাধী, আয়োজক এবং মদতদাতাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।”
এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট যৌথ বিবৃতিতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার উল্লেখ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘‘সদস্য দেশগুলি সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পাশাপাশি, জঙ্গি সংগঠন, বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলিকে ‘ভাড়াটে সেনা’ হিসাবে ব্যবহারের চেষ্টা প্রতিহত করার দিকেও জোর দিচ্ছে তারা।’’
এ বছরের ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় মৃত্যু হয় পর্যটক-সহ মোট ২৬ জনের। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে তাঁদের নৃশংস ভাবে খুন করে সন্ত্রাসবাদীরা। প্রথমে সংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে ইসলামাবাদের কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী ‘লশকর-এ-ত্যায়বা’র ছায়া সংগঠন ‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)। পরে অবশ্য ১৮০ ডিগ্রি বেঁকে হামলার কথা অস্বীকার করে তারা।
‘পহেলগাঁও’ হামলার পরেই ৬৫ বছরের পুরনো ‘সিন্ধু জল চুক্তি’ স্থগিত করে ভারত। পাশাপাশি, ওই ঘটনার বদলা নিতে গত ৭ মে পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকের (পাকিস্তান অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর) জঙ্গিঘাঁটিগুলিকে নিশানা করে ভারতীয় ফৌজ। সেই অভিযানের পোশাকি নাম রাখা হয় ‘অপারেশন সিঁদুর’।
ভারতীয় সেনা পাক জঙ্গিদের গুপ্তঘাঁটিগুলিকে নিশানা করতেই নড়েচড়ে বসে ইসলামাবাদ। সন্ত্রাসবাদীদের পাশে দাঁড়িয়ে পাল্টা ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালান রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলরা। চলে লড়াকু জেট নিয়ে এ দেশের আকাশসীমায় ঢুকে পড়ার চেষ্টা। কিন্তু এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে ব্যবহার করে যাবতীয় আক্রমণ শূন্যেই প্রতিহত করে নয়াদিল্লি। পাশাপাশি ইজ়রায়েলি ‘আত্মঘাতী’ ড্রোন দিয়ে পাক সেনার চিনা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে উড়িয়ে দেয় ভারতীয় ফৌজ।
এর পর পাক সেনাকে শিক্ষা দিতে তাদের বিমানবাহিনীর একাধিক ছাউনিকে নিশানা করে নয়াদিল্লি। সূত্রের খবর, এই আক্রমণে রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে এ দেশের বাহিনী। ফলে চোখের নিমেষে উড়ে যায় চকলালার নুর খান, রফিকি, মুরিদকে, পসরুর এবং সিয়ালকোটের পাক বায়ুসেনা ঘাঁটি। এ ছাড়াও সুক্কুর এবং চুনিয়ায় ইসলামাবাদের স্থলসেনার ঘাঁটিতেও আছড়ে পড়ে ওই ক্ষেপণাস্ত্র। গত ৮ এবং ৯ মে রাতে যুদ্ধবিমান থেকে ওই প্রত্যাঘাত শানায় ভারতীয় বায়ুসেনা।
এ দেশের বিমানবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাক বায়ুসেনার ২০ শতাংশ পরিকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে তড়িঘড়ি লড়াই বন্ধ করতে ভারতীয় সেনার ‘ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশন্স’ বা ডিজিএমওকে ফোন করেন পাক সেনার সম পদমর্যাদার অফিসার। ১০ মে সন্ধ্যায় দু’তরফে জারি হয় সংঘর্ষবিরতি। ‘যুদ্ধ’ থামতেই ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান দিয়ে বিবৃতি জারি করে পাক ফৌজের ‘আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ দফতর’ বা আইএসপিআর (ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স)।
সংঘাত থামলে ইসলামাবাদ জানায়, ভারতের হামলায় মাত্র ১০ থেকে ১২ জন সৈনিকের মৃত্যু হয়েছে। তবে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আমজনতাকে নয়াদিল্লি নিশানা করে বলে অভিযোগ তোলে পাক সেনা। সেই দাবি অস্বীকার করে পাল্টা বিবৃতি দেন ডিজিএমও লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাই। বলেন, ‘‘ন’টি জঙ্গিঘাঁটিতে হামলায় ১০০-র বেশি জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ইউসূফ আজ়হার, আব্দুল মালিক রাউফ এবং মুদস্সর আহমেদ। নিহত জঙ্গিদের মধ্যে আইসি ৮১৪ অপহরণ এবং পুলওয়ামা হামলায় জড়িত জঙ্গিও রয়েছে।’’
গত অগস্টে অবশ্য আমেরিকা সফরে গিয়ে ফের ভারতকে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। বলেন, ‘‘সিন্ধু নদীর উপর নয়াদিল্লি বাঁধ তৈরি করলে ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তা গুঁড়িয়ে দেব। আমাদের কাছে ক্ষেপণাস্ত্রের কোনও অভাব নেই।’’ তাঁর ওই মন্তব্যের পর ইসলামাবাদকে ‘পরিণাম ভুগতে’ হবে বলে পাল্টা হুঁশিয়ারিও দিয়েছিল মোদী সরকার।
এই পরিস্থিতিতে এসসিও বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর উপস্থিতিতে ‘সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি’র প্রসঙ্গ তোলেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়। বলেন, ‘‘শর্ত অনুযায়ী জলের অবাধ ও ন্যায্য বণ্টন মেনে চলা হলে ভবিষ্যতে এই সংগঠনের কাজই আরও সহজ হবে।’’ সীমান্ত পার সন্ত্রাস বন্ধ না হলে এখনই যে ওই চুক্তির উপর থেকে স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া সম্ভব নয়, তা অবশ্য ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছে কেন্দ্র।