হিন্দুদের নাম করে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের বিষোদ্গার। ঠিক তার তিন-চার দিনের মাথায় জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের উপর বর্বরোচিত হামলা চালায় ইসলামাবাদ মদতপুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠী লশকর-এ-ত্যায়বার ছায়া সংগঠন ‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ বা টিআরএফ। ঘটনাপ্রবাহ দেখে বিশ্লেষকদের দাবি, ভারতের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চাইছেন জেনারেল মুনির। জঙ্গি হামলার মাধ্যমে সেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তিনি।
জেনারেল মুনিরের এ হেন পরিকল্পনার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। ভারতের সঙ্গে সম্মুখসমরে গিয়ে সারা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে চান তিনি। গত কয়েক বছর ধরেই আর্থিক ভাবে দেউলিয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ইসলামাবাদ। দেশের চারটির মধ্যে দু’টি প্রদেশে (পড়ুন বালোচিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখোয়া) দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সশস্ত্র বিদ্রোহীরা। চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পাক ফৌজকে নাস্তানাবুদ করে তুলেছে তারা।
স্বাধীনতার পর ভারত-পাক যুদ্ধ হয়েছে মোট চার বার। ১৯৪৭-৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে। ’৭১-র যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে ইসলামাবাদের থেকে পৃথক করে নতুন দেশের জন্ম হয়, যার নাম বাংলাদেশ। বিশ্লেষকদের দাবি, ওই ঘটনার পর ফের একবার বালোচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়ার ভেঙে নতুন রাষ্ট্র তৈরির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর তাই বিভাজন ঠেকাতে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ চাইছেন জেনারেল মুনির।
পাকিস্তানের সর্বাধিক সম্মানজনক প্রতিষ্ঠান হল সেনাবাহিনী। কিন্তু, বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াইয়ে মার খাওয়ায় ফৌজের জনপ্রিয়তা একরকম তলানিতে চলে গিয়েছে। আমজনতার মধ্যে মুনিরের বাহিনীকে নিয়ে বাড়ছে ক্ষোভ। ভারতের সঙ্গে ছোট যুদ্ধে জড়িয়ে এর থেকে পুরোপুরি নজর ঘোরাতে চাইছেন পাক সেনাপ্রধান, মত বিশ্লেষকদের।
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক ডিজিপি এস পি বৈদ্য। তাঁর কথায়, ‘‘হু-হু করে জনপ্রিয়তা কমতে থাকায় জেনারেল মুনির প্রবল চাপে রয়েছেন। ফৌজ এবং পাকিস্তানের জনগণের সামনে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে মরিয়া তিনি। আর তাই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে যুদ্ধের জিগির তুলছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাপ্রধান।’’
২০২২ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোয় গদিচ্যুত হন তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানোর নেপথ্যে জেনারেল মুনিরের বড় ভূমিকা ছিল। সেনাপ্রধান হিসাবে তাঁর নির্বাচন নিয়ে ইমরানের যথেষ্ট আপত্তি ছিল। কুর্সি হারানোর কয়েক মাসের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেফতার করে জেলে পোরে পাক প্রশাসন। মুনিরই এ ব্যাপারে কলকাঠি নেড়েছিলেন বলে মনে করা হয়।
ইমরানের গ্রেফতারির পর লাহোর, মুলতান, ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডির রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে শামিল হন বহু মানুষ। পাক ফৌজের বুটে মারিয়ে সেই বিক্ষোভ দ্রুত দমন করেন জেনারেল মুনির। তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাসের নেপথ্যে এই ঘটনা অনুঘটকের কাজ করেছিল।
জেনারেল মুনিরের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা বালোচিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখোয়াকে নিয়ে। এই দুই প্রদেশে সক্রিয় রয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী বালোচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) এবং তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)। গত কয়েক মাসে পাক ফৌজের উপর হামলার মাত্রা বৃদ্ধি করেছে তারা। চলতি বছরের মার্চে যাত্রীবোঝাই জ়াফর এক্সপ্রেস অপহরণ করে বিএলএ। এতে প্রবল ভাবে প্রশ্নের মুখে পড়ে পাক ফৌজের বিশ্বাসযোগ্যতা।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার কর্নেল রোহিত দেব বলেছেন, ‘‘বালোচিস্তানের নাগরিকদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে মুনিরের সেনা। এই কারণেই বিএলএর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে পাক সেনাপ্রধানকে নিশানা করতে পারে তারা। আর তাই নিজের দেশেই স্বাধীন ভাবে ঘোরাফেরা করতে পারেন না জেনারেল মুনির।’’
২০০৭ সালে পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ় মুশারফকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কোনও মতে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলেন মুশারফ। পূর্বসূরির দেখানো রাস্তায় জেনারেল মুনির হাঁটতে পারেন বলেও গোয়েন্দা রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
নিজের লক্ষ্যে পাক সেনাপ্রধান যে কিছুটা সফল হয়েছেন, ইতিমধ্যেই তার প্রমাণ মিলেছে। পহেলগাঁও হামলার পর এই নিয়ে মুখ খোলেন ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সদস্য তথা সাবেক মন্ত্রী চৌধুরি ফাওয়াদ হুসেন। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক ভাবে পাকিস্তান বিভক্ত হলেও জাতি হিসাবে আমরা ঐকবদ্ধ। ভারত যদি আক্রমণ করে, তা হলে সমস্ত দল একটি পতাকার তলায় একত্রিত হবে।’’
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর থেকে কোনও যুদ্ধই আগে থেকে শুরু করেনি নয়াদিল্লি। প্রতি বারই সেগুলির গুপ্ত মন্ত্রণা চলেছে রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতরের মন্ত্রণাকক্ষে। তবে পহেলগাঁও হামলার পর ছক বদলে ভারতই যুদ্ধ ঘোষণা করুক, তা চাইছেন জেনারেল মুনির। আর তাই নয়াদিল্লিকে মেপে পা ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন প্রতিরক্ষা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
পাক রাজনীতিবিদদের একাংশের ধারণা, যুদ্ধ বাধলে আমেরিকা এবং চিনের সমর্থন পাবে ইসলামাবাদ। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ‘‘পহেলগাঁও কাণ্ডের পর গোটা বিশ্বের সমর্থন রয়েছে ভারতের দিকে। এ ব্যাপারে নীরব থেকে আখেরে নয়াদিল্লির হাত শক্ত করতে পারে বেজিং। এ ছাড়া রাশিয়ার পূর্ণ সাহায্য পাবে নরেন্দ্র মোদী সরকার।’’
রাওয়ালপিন্ডিতে জন্ম হওয়া জেনারেল মুনিরের নাড়ির টান রয়েছে ভারতের পঞ্জাবের সঙ্গে। দেশভাগের আগে তাঁর পরিবারের সদস্যেরা জালন্ধরে থাকতেন। পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের ডিরেক্টর পদেও ছিলেন তিনি। মঙ্গলার অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলে সেনা প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় তাঁকে সম্মানসূচক তলোয়ার (অনার অফ সোর্ড) দেওয়া হয়েছিল।
ছোটবেলায় রাওয়ালপিন্ডির বিখ্যাত মারকাজি মাদ্রাসা দার-উল-তাজউইদ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা নেন তিনি। পাক সেনাবাহিনীর মধ্যে কট্টরপন্থা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে পূর্বসূরি আয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়া-উল-হক বা পারভেজ মুশারফের মতো তাঁরও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
পহেলগাঁও কাণ্ডের সমুচিত জবাব দেওয়ার কথা খোলাখুলি ভাবে ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ইতিমধ্যেই সিন্ধু চুক্তি স্থগিত করেছে নয়াদিল্লি। পাল্টা সিমলা চুক্তি স্থগিত করা হতে পারে বলে হুমকি দিয়েছে পাকিস্তান। শুধু তা-ই নয়, সিন্ধুর জল বন্ধ হলে তা যুদ্ধ হিসাবে দেখা হবে বলে স্পষ্ট করেছে ইসলামাবাদ।
মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্ট’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে নয়াদিল্লির পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা ১৮০। সেখানে পাক সেনার কাছে আছে ১৭০টি আণবিক অস্ত্র। এক বছর আগেও ভারতের মোট পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা ছিল ১৭৪। এর পর আরও ছ’টি আণবিক ওয়ারহেড বৃদ্ধি করে নয়াদিল্লি। পাকিস্তান সেটা করতে পারেনি।
এ ছাড়া প্রথাগত অস্ত্রের ক্ষেত্রে ইসলামাবাদের থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে নয়াদিল্লি। ফলে সম্মুখসমরে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের এঁটে ওঠা বেশ কঠিন। তা ছাড়া এতে পশ্চিমের প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যুদ্ধের আশঙ্কা তীব্র হতেই সেই ছবি করাচির শেয়ার বাজারে দেখা গিয়েছে।