২৬/১১ হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ হাফিজ় সইদকে ভারতের হাতে তুলে দিতে কোনও আপত্তি নেই তাঁর। নয়াদিল্লিকে প্রত্যর্পণ করা যেতে পারে কুখ্যাত জঙ্গি নেতা মাসুদ আজ়হারকেও। সাবেক বিদেশমন্ত্রী বিলাবল ভুট্টো জারদারির এ-হেন বিস্ফোরক মন্তব্যে পাকিস্তান জুড়ে পড়ে গিয়েছে শোরগোল। কেন হঠাৎ এই ‘হৃদয় পরিবর্তন’? আন্তর্জাতিক চাপ না কি নেপথ্যে অন্য কোনও ষড়যন্ত্র? হাফিজ়-পুত্র তালহা বিলাবলের বক্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া দেওয়ায় বাড়ছে সন্দেহ।
চলতি বছরের ৪ জুলাই কাতারের গণমাধ্যম আল জাজ়িরাকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন ‘পাকিস্তান পিপল্স পার্টি’ বা পিপিপির চেয়ারম্যান বিলাবল। সেখানে হাফিজ় সইদ এবং মাসুদ আজ়হারকে ‘উদ্বেগজনক ব্যক্তি’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। পাশাপাশি বলেন, ‘‘এই দু’জনকে ভারতে ফেরত পাঠানো যেতে পারে। তবে অবশ্যই নয়াদিল্লিকে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা এবং সদিচ্ছা দেখাতে হবে।’’
আল জাজ়িরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বার বার প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার কথা বলেছেন পিপিপি চেয়ারম্যান। এর জন্য ‘আস্থা বৃদ্ধির ব্যবস্থা’র (পড়ুন কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজ়ার) প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। বিলাবলের দাবি, ‘‘নানা ইস্যুতে পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে ভারত আলোচনার টেবলে বসলে, বিষয়বস্তুর মধ্যে অবশ্যই থাকবে সন্ত্রাসবাদ। আমি নিশ্চিত যে ইসলামাবাদ তার কোনও বিরোধিতা করবে না।’’
বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন হাফিজ় সইদ এবং মাসুদ আজ়হারকে প্রত্যর্পণ করা যাচ্ছে না? আল জাজ়িরার এই প্রশ্নের সোজাসাপ্টা জবাব দিয়েছেন বিলাবল। তাঁর কথায়, ‘‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নাশকতার অভিযোগে এই দুই কুখ্যাত জঙ্গি নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু, নয়াদিল্লি বার বার সীমান্তপার সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ তুলছে। ওই ইস্যুতে হাফিজ় বা মাসুদের বিরুদ্ধে মামলা করা কঠিন। কারণ, এর জন্য নিয়ম মেনে পদক্ষেপ করছে না ভারত সরকার।’’
বিলাবলের দাবি, হাফিজ় বা মাসুদকে সীমান্তপার সন্ত্রাসের জন্য দোষী সাব্যস্ত করতে হলে নয়াদিল্লিকে এগিয়ে এসে কিছু পদক্ষেপ করতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে নাকি কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রবল ‘অনীহা’ রয়েছে। ইসলামাবাদের প্রস্তাব পুরোপুরি অস্বীকার করেছে কেন্দ্র। আর সেই কারণেই হাতের মুঠোয় পেয়েও দুই কুখ্যাত জঙ্গি নেতাকে কঠোরতম সাজা দিতে পারছে না পাক প্রশাসন।
এ ব্যাপারে ভারতকে কী ধরনের পদক্ষেপ করতে হবে, সাক্ষাৎকারে তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন ইসলামাবাদের সাবেক বিদেশমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘‘প্রত্যর্পণের একটা বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। এর জন্য আদালতের হাতে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ তুলে দিতে হয়। ভারতীয়রা এখানে এসে সাক্ষ্য দিতে পারেন। অভিযোগ বা পাল্টা অভিযোগ যা-ই থাকুক না কেন, সেটা আমরা সহ্য করে নেব। কিন্তু, দুঃখের বিষয় হল এই পদ্ধতিগুলি মানার ব্যাপারে এখনও কোনও সদিচ্ছা দেখায়নি নয়াদিল্লি।’’
সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষের দিকে এসে সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে ভারতের অবস্থানকে ‘নতুন ধরনের অস্বাভাবিক’ বলে মন্তব্য করেন বিলাবল। এই পর্যায়ে তাঁর গলায় ছিল সমালোচনার সুর। তিনি বলেন, ‘‘সন্ত্রাসবাদের পিছনে তাড়া করতে গিয়ে কিছু ভুল পদক্ষেপ করে ফেলছে আমাদের প্রতিবেশী। এতে নয়াদিল্লি বা ইসলামাবাদ কারও ভাল হবে না।’’ আর তাই ‘একগুঁয়েমি’ ছেড়ে বেরিয়ে এসে একসঙ্গে পদক্ষেপ করার পরামর্শ দিয়েছেন পিপিপি চেয়ারম্যান।
বিলাবলের এ-হেন ‘হৃদয় পরিবর্তন’-এর নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, ভারত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করায় বিপাকে পড়েছে পাকিস্তান। আগামী দিনে নয়াদিল্লি যে নদীর জল ধীরে ধীরে বন্ধ করতে পারে, সেই আতঙ্ক চেপে বসেছে ইসলামাবাদের রাজনৈতিকের মনে। বর্তমানে পিপিপির সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় রয়েছেন ‘পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ’ বা পিএমএল-এনের নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। আর তাই সাবেক বিদেশমন্ত্রীকে দিয়ে ঘুরপথে নয়াদিল্লিকে বার্তা দিতে চাইছেন তিনি।
দ্বিতীয়ত, সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত হওয়ায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে দক্ষিণ-পূর্ব পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ। এর জন্য সেখানে চরম জলসঙ্কটের আশঙ্কা রয়েছে। এই প্রদেশটি বিলাবলের দল পিপিপির গড় হিসাবে পরিচিত। ফলে চুক্তি স্থগিত হওয়াকে কেন্দ্র করে আগামী দিনে ভোটে প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর তাই এখন থেকেই শাহবাজ় সরকারের উপর চাপ তৈরির চেষ্টা করছেন সাবেক বিদেশমন্ত্রী। এর জন্য হাফিজ় সইদ বা মাসুদ আজ়হারের মতো জঙ্গি নেতাকে ‘বলি’ দিতেও কোনও আপত্তি নেই তাঁর।
কৃষিভিত্তিক পাকিস্তানের ৯০ শতাংশ চাষের জমি সিন্ধু এবং তার শাখা ও উপনদীগুলির জলের উপর নির্ভরশীল। পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির ২ কোটি ১০ লক্ষ হেক্টরব্যাপী এক এবং দু’ফসলি খেতে যায় এই নদীগুলির জল। ভারত সিন্ধুচুক্তি স্থগিত করার কারণে ১০ থেকে ২০ শতাংশ জল কম পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ইসলামাবাদের ২০০ থেকে ৩০০ কোটি ডলারের ফসল নষ্ট হতে পারে। আর তাই হাফিজ় ও মাসুদকে নয়াদিল্লির হাতে ফিরিয়ে দিয়ে এই বিপদের থেকে রক্ষা পেতে চাইছেন বিলাবল।
সম্প্রতি সিন্ধু সংক্রান্ত এক সমীক্ষা রিপোর্টে দাবি করা হয় যে, পাকিস্তানে নদীটির জলধারা ১৩ শতাংশ কমে গিয়েছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে চাল ও গম উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমে যাবে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে। পাশাপাশি, ব্যাহত হতে পারে ইসলামাবাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ। কারণ, তড়িৎশক্তির ৩০ শতাংশই আসে এই নদী এবং তার শাখা ও উপনদীগুলির উপরে নির্মিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে।
সমীক্ষকদের দাবি, সিন্ধু জল চুক্তি পুরোপুরি বাতিল হলে বছরে দুই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারবে পাকিস্তান। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব শিল্পক্ষেত্রে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বিদ্যুৎশক্তি হ্রাসের কারণে দেশটির মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি (পড়ুন গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) কমবে দু’শতাংশ। ব্যাপক খাদ্য সঙ্কটের মুখে পড়তে পারেন ১২ কোটি পাক নাগরিক। আর পরিশুদ্ধ পানীয় জল না-পেয়ে কঠিন অবস্থা হবে চার কোটি জনতার।
গত কয়েক বছর ধরে আর্থিক ভাবে দেউলিয়া হওয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ইসলামাবাদ। পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে মূল্যবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে। সেখানে সামান্য একটু রুটি বা আটার জন্য আমজনতার মারামারির ছবিও বেশ কয়েক বার সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত হওয়ার কারণে মুদ্রাস্ফীতির হার ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। এই আসন্ন বিপদ আঁচ করতে পেরেই বিলাবল সুর বদলেছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলয়েক বছর আগেই দুই জঙ্গি গোষ্ঠী লশকর-এ-ত্যায়বা এবং জইশ-ই-মহম্মদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ইসলামাবাদের ‘ন্যাশনাল কাউন্টার টেররিজ়ম অথরিটি’ বা ন্যাকটা। তবে এর পুরোটাই যে লোকদেখানো, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ, লশকর এবং জইশের মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের আসল মদতদাতা পাক ফৌজ ও গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স)। আর তাই নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এর শীর্ষনেতাদের দিব্যি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছে।
২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর লশকর জঙ্গিদের হামলায় রক্তাক্ত হয় মুম্বই শহর। সেই ঘটনার মূল চক্রী হল সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ় সইদ। সন্ত্রাসবাদে টাকার জোগান দেওয়ার অভিযোগে তাকে ৩৩ বছরের জেলের সাজা শোনায় পাকিস্তানের আদালত। কিন্তু, তার পরেও প্রকাশ্যে জনসভা করতে দেখা গিয়েছে তাকে। অন্য দিকে রাষ্ট্রপুঞ্জ স্বীকৃত জঙ্গিনেতা মাসুদ আজ়হার আইএসআইয়ের গুপ্তঘাঁটিতে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে খবর পাওয়া গিয়েছে।
ভারতের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ সন্ত্রাসবাদী আজ়হারের বিরুদ্ধে ২০০১ সালে দিল্লির সংসদ ভবন, ২০১৬ সালে পঞ্জাবের পঠানকোট বায়ুসেনা ঘাঁটি এবং ২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে আত্মঘাতী হামলার মূল পরিকল্পনার অভিযোগ রয়েছে। একটা সময়ে তাকে গ্রেফতারও করেছিল ভারতীয় বাহিনী। কিন্তু, ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান অপহরণ করে আফগানিস্তানের কন্দহরে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা নিয়ে গেলে বিপাকে পড়ে নয়াদিল্লি। তখন যাত্রীদের প্রাণ বাঁচাতে আজ়হারকে ছাড়তে বাধ্য হয় কেন্দ্র।
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ মোট ২৬ জন। এর পরই সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করে কেন্দ্র। পাশাপাশি, ৯ মে পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকের (পাকিস্তান অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর) বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় ভারতীয় ফৌজ। সেই অভিযানের নাম রাখা হয় ‘অপারেশন সিঁদুর’। নয়াদিল্লির এই প্রত্যাঘাতে মাসুদের বোন-সহ ১০ জন মারা গিয়েছেন বলে খবর প্রকাশ্যে এসেছে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা অবশ্য মনে করেন, বিলাবল মুখে বললেও ইসলামাবাদের পক্ষে মাসুদ আজ়হার বা হাফিজ় সইদকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া বেশ কঠিন। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে চলে আসবে পাক ফৌজ এবং আইএসআইয়ের কুকীর্তি। সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের পর হাফিজ় ও বিলাবলকে এক সুরে কথা বলতে শোনা গিয়েছিল। ওই সময়ে ভারতকে হুমকি দিতে পিপিপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘হয় নদীতে জল বইবে, নয় রক্ত।’’ আর প্রকাশ্য জনসভায় লশকর নেতার মন্তব্য ছিল, ‘‘দিল্লি জল বন্ধ করলে আমরা ওদের শ্বাস আটকে দেব।’’
কিন্তু, মাস দুয়েকের মাথায় ১৮০ ডিগ্রি বেঁকে বিলাবল দুই জঙ্গি নেতাকে ভারতের হাতে প্রত্যর্পণের কথা বলায় বেজায় চটেছেন হাফিজ় পুত্র তালহা। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানিয়েছেন, পিপিপি চেয়ারম্যানের এই মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক। হাফিজ়কে নয়াদিল্লির হাতে তুলে দিলে গোটা দুনিয়ার সামনে পাকিস্তানের মাথা হেঁট হয়ে যাবে বলেও স্পষ্ট করেছেন তিনি।
অন্য দিকে সিন্ধু জল চুক্তির উপর থেকে স্থগিতাদেশ যে কোনও ভাবেই তুলে নেওয়া হবে না, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে নয়াদিল্লি। চুক্তি হওয়ার সময়ে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছিল বিশ্ব ব্যাঙ্ক। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিও এ ব্যাপারে ভারতের পদক্ষেপের কোনও বিরোধিতা করেনি। ফলে রক্তচাপ বেড়েছে ইসলামাবাদের।