প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের পর স্থলসেনা-প্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। এ বার পাকিস্তানের ভৌগোলিক অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার হুঙ্কার শোনা গেল ভারতের শীর্ষ ফৌজি অফিসারের গলায়। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী সংঘর্ষের জন্য বাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তবে কি দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রে বড় বদলের নীলনকশা ছকে ফেলেছে নয়াদিল্লি? তাঁর দেওয়া হুঁশিয়ারির পর এই ইস্যুতে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। পাশাপাশি, তীব্র হচ্ছে পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর যুদ্ধের আশঙ্কাও।
চলতি বছরের মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের ‘যুদ্ধ’-এ ভারতের হাতে বেদম মার খেয়েও চুপ করে থাকেনি পাকিস্তান। উল্টে সংঘর্ষ থামতেই স্থলবাহিনীর প্রধান আসিম মুনিরের পদোন্নতি করে ইসলামাবাদ। রাতারাতি জেনারেল থেকে ফিল্ড মার্শাল হয়ে যান তিনি। এর পরই নয়াদিল্লিকে ক্রমাগত পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দিতে শোনা যায় তাঁকে। এত দিন কূটনৈতিক পর্যায়ে তার জবাব দিচ্ছিল কেন্দ্র। কিন্তু পাঁচ মাসের মাথায় নজিরবিহীন ভাবে এ ব্যাপারে মুখ খুললেন জেনারেল দ্বিবেদী।
আর ঠিক সেই কারণেই ভারতের স্থলসেনা-প্রধানের হুমকিকে একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কেউই। তাঁদের একাংশের দাবি, গোপনে গোপনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে নয়াদিল্লি। আসন্ন সংঘর্ষের কথা মাথায় রেখে একের পর এক অত্যাধুনিক হাতিয়ারে বাহিনীকে সাজিয়ে তুলছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। পাশাপাশি চলছে কূটনৈতিক চালে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়াও।
চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর ওড়িশার চাঁদিপুরে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ‘অগ্নি প্রাইম’ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা করে কেন্দ্রের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন)। পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম এই দূরপাল্লার হাতিয়ারটির উৎক্ষেপণের সময় হাজির ছিলেন স্ট্র্যাটেজিক কমান্ডের কর্তাব্যক্তিরা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, চলমান লঞ্চিং ব্যবস্থার মাধ্যমে একে ছোড়া হয়েছিল।
‘অগ্নি প্রাইম’কে পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্র বলে উল্লেখ করেছে ডিআরডিও। পরীক্ষার সময় একে ট্রেন থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। সেখানে ১০০ শতাংশ সাফল্য পেয়েছেন এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। এই প্রথম কোনও ট্রেনের সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থাকে জুড়ে দিতে সক্ষম হলেন তাঁরা। সামরিক পরিভাষায় যার পোশাকি নাম ‘রেল-বেসড মোবাইল লঞ্চার সিস্টেম’। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাত্র চার মাসের মাথায় এই পরীক্ষা চালায় কেন্দ্র।
ডিআরডিও সূত্রে খবর, ‘অগ্নি প্রাইম’-এর পাল্লা দু’হাজার কিলোমিটার। দেশ জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা রেললাইনের যে কোনও জায়গা থেকে একে উৎক্ষেপণ করতে পারবে ভারতীয় ফৌজ। ফলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটিকে চিহ্নিত করা যে শত্রুর পক্ষে খুবই কঠিন হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘অগ্নি প্রাইম’-এর পাশাপাশি ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নত সংস্করণ তৈরির দিকেও নজর দিয়েছে নয়াদিল্লি। চলছে ড্রোন শক্তি বৃদ্ধির কাজও।
এর পাশাপাশি পাকিস্তানের শত্রু দেশগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে নয়াদিল্লি। সেই তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে আফগানিস্তানের নাম। আগামী ৯ অক্টোবর ভারত সফরে আসার কথা রয়েছে সেখানকার তালিবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির। ২০২১ সালে হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে ক্ষমতায় আসে ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী। সেই ঘটনার পর এই প্রথম তালিবানের কোনও ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর পা পড়বে নয়াদিল্লিতে, যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
২০০১ সালে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আফগানিস্তানে সেনা অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে পঠানভূমিতে বাহিনী নিয়ে যায় আমেরিকা। এর জন্য করাচির বিন কাশেম বন্দরটিকে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করেছিল তারা। এ বছরের সেপ্টেম্বরে ফের এক বার হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে সামরিক অভিযানের ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানকার বাগরাম বিমানঘাঁটি ফেরত কাবুলের তালিবান শাসকদের থেকে ফেরত চেয়েছেন তিনি।
সাবেক সেনাকর্তাদের দাবি, ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তালিবানেরও কিছু স্বার্থ রয়েছে। প্রথমত, বাগরামের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে সটান ‘না’ বলে দিয়েছে তারা। তা ছাড়া ইসলামাবাদের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদ রয়েছে তাদের। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব দিক থেকে নয়াদিল্লি চাপ বজায় রাখলে মার্কিন ফৌজের আসা ঠেকানো যাবে বলে আশাবাদী আফগান নেতৃত্ব। আমেরিকার সেনা যাতে কোনও ভাবেই করাচি বন্দর ব্যবহার করতে না পারে, তা চাইছে কাবুলের তালিবান সরকার।
আফগানিস্তান লাগোয়া উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়ায় পুশতুভাষী পঠান জনসংখ্যার আধিক্য রয়েছে। তাঁদের বড় অংশই স্বাধীন ‘পাশতুনিস্তান’ গড়ে তুলতে আগ্রহী। তা ছাড়া দুই দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত বা ‘ডুরান্ড লাইন’ নিয়ে ইসলামাবাদের সঙ্গে তালিবানের দীর্ঘ বিবাদ রয়েছে। মুত্তাকির ভারত সফরে এই সমস্ত অঙ্কই মাথায় রাখছেন কূটনীতিক বিশ্লেষকেরা।
এ বছরের ডিসেম্বরে নয়াদিল্লিতে আসছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন তিনি। সূত্রের খবর, তাঁর উপস্থিতিতে মস্কোর সঙ্গে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলবে কেন্দ্র। এর মধ্যে থাকবে পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির লড়াকু জেট এসইউ-৫৭। এ ছাড়া আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৫০০ এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র নিয়েও দু’তরফে সমঝোতা হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তি করে পাকিস্তান। সেখানে বলা হয়েছে, তৃতীয় কোনও পক্ষ দ্বারা কোনও একজন আক্রান্ত হলে, দু’টি দেশই তা যুদ্ধ হিসাবে গণ্য করবে। এই সমঝোতার পর রিয়াধকে ‘আণবিক সুরক্ষা’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ইসলামাবাদ। বিষয়টিকে একেবারেই ভাল চোখে দেখছে না ইজ়রায়েল। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের সঙ্গে বাড়ছে ‘বন্ধু’ ইহুদি রাষ্ট্রের সখ্য।
বিশেষজ্ঞেরা ইতিমধ্যেই সম্ভাব্য ভারত-পাক সংঘর্ষের তিনটি ‘ফ্ল্যাশপয়েন্ট’ খুঁজে পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রথমটি হল সিন্ধু জলচুক্তি। গত এপ্রিলে জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে ইসলামাবাদ মদতপুষ্ট জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিরীহ মানুষের মৃত্যুর পর ওই জলবণ্টন ব্যবস্থাকে স্থগিত করে নয়াদিল্লি। আগামী দিনে সিন্ধু ও তার শাখা এবং উপনদীগুলির বাঁধও তৈরি করতে পারে কেন্দ্র। সে ক্ষেত্রে তীব্র জলসঙ্কট এড়াতে যুদ্ধকে বেছে নিতে পারেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা।
দ্বিতীয়ত, গুজরাতের কচ্ছের রণ এলাকার স্যর ক্রিক খাঁড়ি। দীর্ঘ দিন এই এলাকাটিকে নিজেদের বলে দাবি করে আসছে পাকিস্তান। ২০১৯ সালে নতুন একটি মানচিত্র প্রকাশ করে ইসলামাবাদ। সেখানে স্যর ক্রিকের পাশাপাশি গুজরাতের জুনাগড়কেও পাকিস্তানের অংশ বলে দেখানো হয়েছিল। এর পরই ওই এলাকায় সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে রাওয়ালপিন্ডি। সূত্রের খবর, সেখানে ক্রিক ব্যাটেলিয়ান নামের একটি বিশেষ বাহিনীকে মোতায়েন করেছেন ফিল্ড মার্শাল মুনির।
ভারত-পাক সম্ভাব্য সংঘর্ষের তৃতীয় কারণ হিসাবে সন্ত্রাসবাদকে উল্লেখ করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর সংঘর্ষবিরতি হতেই জঙ্গি হামলা নিয়ে ইসলামাবাদকে কড়া হুঁশিয়ারি দেয় নয়াদিল্লি। এ ব্যাপারে বিবৃতি দিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, ‘‘আগামী দিনে সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনা ঘটলে, তাকে যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করবে কেন্দ্র।’’ এই হুমকি সত্ত্বেও জঙ্গি সংগঠনগুলির থেকে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটি দূরত্ব তৈরি করেছে এমনটা নয়।
এই পরিস্থিতিতে গত ২ অক্টোবর গুজরাতের ভুজে ভারতীয় সেনার ‘শস্ত্র পুজো’ কর্মসূচিতে যোগ দেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘স্যর ক্রিক এলাকায় পাকিস্তানের যে কোনও আগ্রাসনের জবাবে এমন প্রত্যাঘাত হবে, যার অভিঘাতে ইতিহাস এবং ভূগোল উভয়ই বদলে যাবে। ইসলামাবাদ যেন ভুলে না যায় করাচি যাওয়ার রাস্তা স্যর ক্রিক হয়ে গিয়েছে।’’ এর পরই ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে এ দেশের বাহিনীর লাহোরের কাছে পৌঁছে যাওয়ার প্রসঙ্গ তোলেন তিনি।
রাজনাথের ওই মন্তব্যের ঠিক পরের দিনই রাজস্থানের অনুপগড়ের সেনাছাউনিতে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দেন জেনারেল দ্বিবেদী। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘ইসলামাবাদ যদি মানচিত্রে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে চায়, তা হলে সন্ত্রাসে রাষ্ট্রীয় মদত বন্ধ করতে হবে। এ বার আর আমরা প্রথম অপারেশন সিঁদুরের মতো সংযম দেখাব না। আমাদের অভিযান এমন জায়গায় পৌঁছোবে যে পাকিস্তানকে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে হবে।’’ এর পর সৈনিকদের জন্যেও বিশেষ একটি বার্তা দেন তিনি।
সম্ভাব্য সংঘর্ষের কথা উল্লেখ করে জেনারেল দ্বিবেদী বলেন, ‘‘ঈশ্বর চাইলে আপনারা দ্রুত সেই সুযোগ পাবেন। এর জন্য তৈরি থাকুন। আপনাদের শুভেচ্ছা জানাই।’’ অন্য দিকে একই দিনে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ পাকিস্তানের ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান দেন বায়ুসেনাপ্রধান এয়ার চিফ মার্শাল অমর প্রীত সিংহ। তিনি বলেন, ‘‘ইসলামাবাদের ৪-৫টি লড়াকু জেটকে আমরা ধ্বংস করেছি। এ ছাড়া বায়ুসেনা ঘাঁটি ও পরিকাঠামোয় আঘাত হানা গিয়েছে।
বায়ুসেনাপ্রধানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময় অন্তত চারটি রেডার স্টেশন, দু’টি কমান্ড-কন্ট্রোল সেন্টার, দু’টি রানওয়ে, বিমানঘাঁটির হ্যাঙার, একটি সি-১৩০ শ্রেণির সামরিক মালবাহী বিমান, একটি নজরদারি বিমান এবং একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হারিয়েছে পাকিস্তান। যদিও ‘যুদ্ধ’র ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ইসলামাবাদ মনগড়া কাহিনি শোনাচ্ছে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার নকশা বদলে দেয় নয়াদিল্লি। জন্ম হয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। সে বারের সংঘর্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল এ দেশের গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’ বা র। ৫৪ বছর পর ফের তাদের চালেই ভেঙে টুকরো টুকরো হবে ইসলামাবাদ? উত্তর দেবে সময়।