আরব সাগরে নতুন আতঙ্ক! রণতরী ধ্বংসকারী হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের এ বার সফল পরীক্ষা চালাল পাকিস্তান। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির একটি ভিডিয়োও প্রকাশ করেছে ইসলামাবাদের নৌবাহিনী। সেখানে চোখের পলকে উড়ে গিয়ে নিখুঁত নিশানায় ক্ষেপণাস্ত্রটিকে আঘাত হানতে দেখা গিয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এর জেরে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় পশ্চিমের প্রতিবেশীর বাড়বে শক্তি, যা জাতীয় সুরক্ষার প্রশ্নে নয়াদিল্লির সামনে যে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করল, তা বলাই বাহুল্য।
যুদ্ধজাহাজ থেকে পরীক্ষা করা পাক হাতিয়ারটির পোশাকি নাম ‘স্ম্যাশ’। অভিধান অনুযায়ী যার অর্থ হল চূর্ণ করে দেওয়া। এটি প্রকৃতপক্ষে ভূমি থেকে ভূমিতে হামলাকারী আট ম্যাক গতিসম্পন্ন একটি রণতরী ধ্বংসকারী ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (সারফেস-টু-সারফেস ম্যাক-৮ অ্যান্টি শিপ ব্যালেস্টিক মিসাইল)। আট ম্যাক, অর্থাৎ শব্দের চেয়ে আট গুণ গতিতে ছোটার ক্ষমতা রয়েছে স্ম্যাশের। এ-হেন ‘ব্রহ্মাস্ত্রের’ পরীক্ষা নৌযুদ্ধে ইসলামাবাদকে যুগান্তকারী সাফল্য অর্জনে সাহায্য করবে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারের পরীক্ষার পর বিবৃতি দেয় পাক ফৌজ। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল নাভিদ আশরাফ এবং প্রতিরক্ষা গবেষক ও ইঞ্জিনিয়ারদের সামনে ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ছোড়া হয়েছিল। নির্ভুল ভাবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে গিয়ে আঘাত হানে সেটি। এর মাধ্যমে সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রমাণ রেখেছে ইসলামাবাদ।’’ স্ম্যাশ ক্ষেপণাস্ত্রের সাফল্যে গবেষকদলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ এবং সেনা সর্বাধিনায়ক (চিফ অফ ডিফেন্স ফোর্সেস) ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির।
পাক নৌবাহিনীর বহরে থাকা যুদ্ধজাহাজগুলির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ফ্রিগেট হল ‘পিএনএস টিপু সুলতান’। স্ম্যাশ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষার জন্য সেটিকেই বেছে নেন ইসলামাবাদের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। এর উৎক্ষেপণে ব্যবহার হয়েছে রণতরীর ভিতরে থাকা একটি উল্লম্ব লঞ্চার। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির ‘ম্যানুভারিং’ ক্ষমতা বেশ ভাল। অর্থাৎ মাঝ-আকাশে সাপের মতো এঁকেবেঁকে গিয়ে লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে স্ম্যাশ। ফলে রেডারে একে চিহ্নিত করা বেশ কঠিন।
বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি দেশের কাছে আছে যুদ্ধজাহাজ থেকে ব্যালেস্টিক হাইপারসনিক (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন) ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সক্ষমতা। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চিন, ইরান এবং উত্তর কোরিয়ার নৌবাহিনী। সেই তালিকায় এ বার পাকিস্তানের নাম ওঠায় বেজায় খুশি ইসলামাবাদ। রাওয়ালপিন্ডির নৌকমান্ডারদের দাবি, এর সাহায্যে সামুদ্রিক লড়াইয়ে দৃষ্টান্তমূলক বদল আনতে পারবেন তাঁরা।
নৌশক্তির নিরিখে ভারতের থেকে কয়েক যোজন পিছিয়ে আছে পাকিস্তান। নয়াদিল্লির হাতে আছে দু’টি বিমানবাহী রণতরী। এ ছাড়া পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম আণবিক শক্তি চালিত ডুবোজাহাজও ব্যবহার করে থাকে এ দেশের নৌবাহিনী। ইসলামাবাদের কাছে এই ধরনের কোনও কৌশলগত অস্ত্র নেই। সেই খামতির কিছুটা যে স্ম্যাশ ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে অ্যাডমিরাল নাভিদ আশরাফ পূরণ করতে চাইছেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
নৌবাহিনীর বহরে শামিল হতে চলা ওই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’-এর শক্তি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য আপাতত গোপন রেখেছে পাকিস্তান। তবে সূত্রের খবর, হাতিয়ারটির ওজন ১৬ থেকে ১৮ টন। এর পাল্লা ৭২০ থেকে ৮৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ৬০০ কিলোমিটার পাল্লার এর একটি ভ্যারিয়েন্ট তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে ইসলামাবাদের। আগামী দিনে রফতানির মাধ্যমে যার থেকে মোটা টাকা রোজগারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে শাহবাজ় সরকারের।
পাক গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫০০ থেকে ৭০০ কেজি বিস্ফোরক বহনে সক্ষম এই স্ম্যাশ ক্ষেপণাস্ত্র। যুদ্ধজাহাজের পাশাপাশি উপকূল ভাগের উচ্চ মূল্যের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বা শহরে এর সাহায্যে হামলা চালাতে পারবে ইসলামাবাদের নৌসেনা। কাঠামোগত ঘূর্ণন ছাড়াই ৩৬০ ডিগ্রি বেঁকে গিয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আছড়ে পড়ার ক্ষমতা রয়েছে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারের। তবে এর বেশ কিছু ফাঁকফোকরও ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ।
বিশ্লেষকদের দাবি, পাক নৌসেনার পথে ভারতীয় উপকূলে হামলা চালানো মোটেই সহজ নয়। তার প্রথম কারণ হল নয়াদিল্লির হাতে থাকে শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এ দেশের বায়ুসেনার কাছে আছে ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’ নামের কবচ। মাঝ-আকাশে যে কোনও ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে রুশ নির্মিত এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের। এস-৪০০র নজর এড়িয়ে ইসলামাবাদের পক্ষে আক্রমণ শানানো শুধু কঠিনই নয়, একরকম অসম্ভব বলা চলে।
দ্বিতীয়ত, ভারতীয় রণতরীগুলিতেও রয়েছে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। অধিকাংশ যুদ্ধজাহাজে ইজ়রায়েলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি বারাক-৮ এয়ার ডিফেন্স মোতায়েন রেখেছে নয়াদিল্লি। রুশ এস-৪০০র মতো এটিও শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ-আকাশে ওড়াতে বেশ পটু। সবশেষে অবশ্যই বলতে হবে এ দেশের ডুবোজাহাজ শক্তির কথা, যা হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার আগে পাক নৌকমান্ডারদের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
সাবেক সেনাকর্তাদের কথায়, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সমুদ্রের গভীর থেকে হামলা চালিয়ে অনায়াসে একের পর এক পাক রণতরীগুলি ডুবিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর। তা ছাড়া ডুবোজাহাজ থেকে ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে উপকূলভাগেও আক্রমণ শানাতে পারেন এ দেশের জলযোদ্ধারা। ইসলামাবাদের নৌসেনায় যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা খুবই কম। রণতরী ছাড়া স্ম্যাশ ক্ষেপণাস্ত্রটি উৎক্ষেপণের আদৌ কোনও ব্যবস্থা তাদের হাতে আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
তৃতীয়ত, গত মে মাসে হওয়া ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ ইলেকট্রনিক্স যুদ্ধের সক্ষমতা দেখিয়েছে ভারত। এর মাধ্যমে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোনের ভিতরে থাকা বৈদ্যুতিন ব্যবস্থা বিকল করে দিতে পেরেছিলেন এ দেশের সৈনিকেরা। স্ম্যাশের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অবলম্বনের সুযোগ রয়েছে। তখন রাস্তা হারিয়ে অন্যত্র আঘাত করতে পারে পাক হাইপারসনিক ব্রহ্মাস্ত্র বা জ্যামিংয়ের জন্য থেমে গিয়ে এর মাঝ-আকাশ থেকে খসে পড়ার আশঙ্কাও প্রবল।
তা ছাড়া ভারতের হাতেও রয়েছে বেশ কয়েকটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। সেই তালিকায় প্রথমেই আসবে শৌর্যের নাম। ২০১১ সাল থেকে ভূমি থেকে ভূমিতে হামলাকারী স্বল্পপাল্লার ব্রহ্মাস্ত্রটি ব্যবহার করছে নয়াদিল্লির ফৌজ। এর পাল্লা ৭০০ থেকে ১৯০০ কিলোমিটার বলে জানা গিয়েছে। ২০০ থেকে হাজার কেজির বিস্ফোরক নিয়ে উড়তে পারে শৌর্য। এর গতিবেগ ৭.৫ ম্যাক। প্রথাগত বিস্ফোরকের পাশাপাশি এর সাহায্যে পরমাণু হামলাও চালানো যায়।
গত বছর হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকেলের সফল পরীক্ষা চালায় ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণাকেন্দ্র ‘ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন’ বা ডিআরডিও। এর পাল্লা সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার। তবে বাহিনীর বহরে এটিকে এখনও শামিল করেনি নয়াদিল্লি। বর্তমানে ডুবোজাহাজের ‘সাগরিকা কে-১৫’ ক্ষেপণাস্ত্রের গতিবেগ বাড়িয়ে তাকে হাইপারসনিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন এ দেশের সামরিক গবেষকেরা।
এ ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ব্রহ্মস ক্রুজ় সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রটির নতুন হাইপারসনিক সংস্করণের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছে ভারত। আগামী বছরের প্রথমার্ধেই মার্ক টু নামের ওই ব্রহ্মাস্ত্রটির পরীক্ষা চালাতে পারে নয়াদিল্লি, যার গতিবেগ হবে আট ম্যাক। ব্রহ্মস মার্ক টু-র পাল্লা হাজার কিলোমিটারের বেশি হতে চলেছে বলে জানা গিয়েছে। এটিকে স্থলভাগ, লড়াকু জেট, রণতরী এবং ডুবোজাহাজ থেকে ছোড়ার প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছেন এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
হাইপারসনিক শক্তি হাতে পাওয়া পাকিস্তানের আরও একটি সমস্যা রয়েছে। ইসলামাবাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একেবারেই ভাল নয়। এ ব্যাপারে পুরোপুরি চিনের তৈরি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের উপর নির্ভরশীল রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ ড্রোন হামলায় যা সফল ভাবে ওড়াতে পেরেছে এ দেশের সেনা। ফলে স্ম্যাশ ব্যবহারের ক্ষেত্রে পাল্টা প্রত্যাঘাতের ঝুঁকির কথাও ভাবতে হবে তাদের।
গত কয়েক বছরে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় একাধিক কৌশলগত নৌঘাঁটি তৈরির মাধ্যমে সমুদ্রের লড়াইয়ে শক্তি বাড়িয়েছে নয়াদিল্লি। আরব সাগরের লক্ষদ্বীপে নতুন ছাউনি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের। এ ছাড়া ডুবোজাহাজ এবং বিমানবাহী রণতরীর সংখ্যা বৃদ্ধিরও ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।
তবে তার পরেও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হতে নারাজ ভারতীয় নৌবাহিনী। কারণ, ইসলামাবাদ আরব সাগরে একটি কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করতে চলেছে বলে খবর প্রকাশ করেছে পশ্চিমি গণমাধ্যম ব্লুমবার্গ। আগামী দিনে সেখান থেকেও সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে পারে পাক ফৌজ। আর তাই পশ্চিমের প্রতিবেশীর উপর সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখছে নয়াদিল্লি, খবর সূত্রের।