রাজকোষ প্রায় শূন্য। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে সিংহভাগ জনতা। এ-হেন মুসলিম দেশগুলিকে নিয়ে ‘ইসলামীয় নেটো’ তৈরির স্বপ্নে বিভোর পাকিস্তান। শুধু তা-ই নয়, পরমাণু সুরক্ষার ‘কুমিরছানা’ দেখিয়ে দ্রুত তাদের সঙ্গে সামরিক চুক্তি সেরে ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ইসলামাবাদ। ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির ট্যাঁকের অবস্থাও তথৈবচ! এই আবহে দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলিকে নিয়ে ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’র মতো সংগঠন গড়ে তোলা ‘নিজের কবর নিজে খোঁড়া’র শামিল, বলছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, বর্তমানে বিশ্বের ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের সংগঠন ‘অর্গানাইজ়েশন অফ ইসলামিক কান্ট্রিজ়’ বা ওআইসিকে পুরোপুরি ‘ইসলামীয় নেটো’য় বদলে ফেলার ছক কষছে পাক ফৌজ ও সরকার। কিন্তু, সমস্যার জায়গা হল এর মধ্যে ৩৪টি দেশেই চলছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। দুনিয়ার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোকাক্ট) মাত্র আট শতাংশ অবদান রয়েছে ওআইসির। তা ছাড়া পরমাণু শক্তিধর হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র এঁটুলি পোকার মতো গায়ে লেগে আছে ইসলামাবাদের।
আর তাই পাক সরকার ও ফৌজের ‘ইসলামীয় নেটো’ তৈরির আকাঙ্ক্ষা অঙ্কুরেই নষ্ট হতে চলেছে বলে মনে করেন দুঁদে কূটনীতিকেরা। তাঁদের কথায়, পেটে খিদে নিয়ে সামরিক জোট তৈরি করলেও বাস্তবে তা কতটা সফল হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। দুর্ভিক্ষের কবলে থাকা ওআইসির ৩৪টি রাষ্ট্রের মধ্যে ২৪টির আবার মাথাপিছু গড় আয় মাত্র ২,৫০০ ডলার। সারা বিশ্বে সাধারণ ভাবে এটি ১৩ হাজার ডলার। অর্থাৎ, দুনিয়ার নিরিখে পাঁচ গুণ কম রোজগার করছেন সেখানকার বাসিন্দারা। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির পক্ষে প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল খরচ করা একেবারেই সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি আর্থিক বছরে (২০২৫-’২৬) সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ রয়েছে দারিদ্রসীমার নীচে। আফগানিস্তান এবং সোমালিয়ায় এই সংখ্যাটা যথাক্রমে ৮৫ এবং ৫৪ শতাংশ। অন্য দিকে, পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশেরই দু’বেলা পেট ভরে খাবার জোটে না। এ ছাড়া আফ্রিকার দেশ মালির ৪৪ শতাংশ বাসিন্দা দারিদ্র্যসীমার নীচে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
পাকিস্তানের ‘ইসলামীয় নেটো’ তৈরির রাস্তায় দ্বিতীয় কাঁটা হল শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব। বর্তমানে সারা বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই সুন্নিপন্থী। বাকি ১০ শতাংশ শিয়া মতাদর্শ মেনে চলেন। সুন্নি মতবাদকে সামনে রেখে ওআইসি-সহ সমগ্র ইসলামীয় দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার স্বপ্ন রয়েছে সৌদি আরবের। পাকিস্তান সেই পথের পথিক। কিন্তু, পারস্য উপসাগরের কোলের শিয়া মুলুক ইরান সেটা কতটা মেনে নেবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। সামরিক জোট গঠন তো দূরস্থান, উল্টে নিজেদের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউই।
১৯৭৯ সালে ‘ইসলামীয় বিপ্লব’-এর পর ইরানের শাসনক্ষমতা দখল করেন কট্টরপন্থী শিয়া ধর্মগুরু আয়াতোল্লা খামেনেই। ওই সময় প্রতিবেশী সুন্নিপন্থী ইরাকের গদিতে ছিলেন সাদ্দাম হুসেন। তেহরানের বিপ্লবের আঁচ থেকে বাগদাদকে বাঁচাতে রাতারাতি পারস্য উপসাগরের কোলের দেশটিতে সামরিক অভিযানের মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি। ফলে পরবর্তী আট বছর ধরে চলে ইরাক-ইরান যুদ্ধ। ৩৭ বছর পেরিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে সেই বিদ্বেষ যে পুরোপুরি কেটে গিয়েছে, তা কিন্তু নয়।
গত শতাব্দীর ৮০-র দশকে পাক ভূমির সুন্নি কট্টরপন্থীরা লশকর-ই-ঝাংভি এবং সিপাহ-এ-সাহাবার মতো সংগঠন তৈরি করেন। পরবর্তী চার দশকে তাদের বিরুদ্ধে ওঠে কয়েক হাজার শিয়া ধর্মীবলম্বীদের গণহত্যার অভিযোগ। ফলে এই ইস্যুতে একসময় সুর চড়াতে থাকে তেহরান। যদিও তা একেবারেই গায়ে মাখেনি ইসলামাবাদ। ফলে তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে ‘ইসলামীয় নেটো’য় সাবেক পারস্য দেশটি আদৌ যোগ দেবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
১৯৯১ সালে সাদ্দামের শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হয় ইরাকি শিয়াদের একাংশ। বাগদাদের ‘স্বৈরাচারী’ শাসক তা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। তাঁর নির্দেশে টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর তীরে রাতারাতি কচুকাটা হতে হয় ১০ হাজার শিয়াকে। ২০০৩ সালে গণবিধ্বংসী হাতিয়ার রাখার অভিযোগ তুলে ইরাক আক্রমণ করে মার্কিন ফৌজ। সেই যুদ্ধে সাদ্দামের পতন হতেই বাগদানের শিয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলিকে পর্দার আড়ালে থেকে সাহায্য করতে শুরু করে তেহরান। এর জেরে পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়।
২০১২ সালে শিয়া ধর্মগুরু শেখ নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে সৌদি সরকার। এতে রিয়াধ এবং তেহরানের মধ্যে সংঘাত তীব্র হয়। ওআইসি-ভুক্ত দেশগুলির চরম আর্থিক দুরবস্থার নেপথ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হিসাবে দুর্বল ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করেছেন বিশ্লষেকদের একাংশ। সাধারণ ভাবে এই রাষ্ট্রগুলিতে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে ব্যাঙ্ক। এর সঙ্গে বাজার অর্থনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। ফলে বিপুল লোকসানের মুখ দেখতে হয় সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে।
পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ইরানের আবার একটি বিকল্প আর্থিক ব্যবস্থা রয়েছে। সেটা হল মাদকের ব্যবসা। এই তিন দেশেই আফিম চাষের ব্যাপক প্রচলন আছে। আন্তর্জাতিক আইনের ভয়ে অবশ্য প্রকাশ্যে একে সমর্থন করে না সরকার। কিন্তু গোপনে গোপনে একে দিব্যি মদত জুগিয়ে যাচ্ছেন সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে ফৌজি জেনারেল এবং প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা। এর জেরে নেশা এবং পাচারের মতো বেআইনি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে সেখানকার যুবসমাজের।
ইসলামীয় দেশগুলির আর একটি বড় সমস্যা হল সন্ত্রাসবাদ। পাকিস্তান, ইরান, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক বা তুরস্ক— কেউই এর বাইরে নেই। জঙ্গি সংগঠনগুলির জাল ছড়িয়ে রয়েছে আফ্রিকার মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতেও। কোথাও স্থানীয় সরকার, কোথাও আবার প্রত্যক্ষ বিদেশি মদতে ক্রমাগত শক্তি বাড়াচ্ছে তারা। ফলে অধিকাংশ জায়গাতেই রয়েছে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। পাশাপাশি ধর্মীয় কট্টরপন্থা এবং মৌলবাদ সেখানে দিন দিন চরম আকার ধারণ করছে।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতির নিরিখে মারাত্মক ভাবে পিছিয়ে রয়েছে ওআইসি-ভুক্ত যাবতীয় রাষ্ট্র। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের ২৫ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। কিন্তু, এখনও পর্যন্ত মুসলিম দেশগুলির মধ্যে থেকে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন মাত্র তিন জন। অন্য দিকে দুনিয়ার এক শতাংশেরও কম জনসংখ্যা হওয়া সত্ত্বেও ১৬৫টি নোবেল পুরস্কার রয়েছে ইহুদিদের ঝুলিতে। ইসলামীয় দেশগুলির মধ্যে কেবলমাত্র সংযুক্ত আরব আমিরশাহির গণিত কিছুটা ভাল। এ ব্যাপারে বিশ্বের মধ্যে ৩০ নম্বর স্থানে রয়েছে তারা।
ওআইসি-ভুক্ত অধিকাংশ মুসলিম দেশ ধর্মীয় শিক্ষায় বিশ্বাসী। ফলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতি সেখানে বিশেষ ঘটছে না। সাবেক সেনাকর্তাদের দাবি, আধুনিক যুদ্ধ অনেকাংশই কৃত্রিম মেধা, মহাকাশে থাকা উপগ্রহের উপর নির্ভরশীল। এগুলি ইসলামীয় দেশগুলির হাতে নেই বললেই চলে। শুধু তা-ই নয়, অত্যাধুনিক হাতিয়ারের ব্যাপারেও তারা পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমি দেশগুলির উপর নির্ভরশীল।
পাকিস্তানের ‘ইসলামীয় নেটো’র স্বপ্নের কফিনে শেষ পেরেক পুঁততে পারে রাজনৈতিক অস্থরিতা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর গত ৭৭ বছরে চার বার সেনা অভ্যুত্থান দেখেছে ইসলামাবাদ। একই অবস্থা ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন বা মিশরের মতো দেশগুলিরও। দুর্নীতির নিরিখে বিশ্বের প্রথম ২০টি স্থানেই রয়েছে কোনও না কোনও মুসলিম দেশ। সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে প্রথম ১০টির মধ্যে ন’টি রাষ্ট্রই ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর (১৯৩৯-’৪৫) বিশ্ব সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) সঙ্গে ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ে জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা। ওই সময় ১২টি ইউরোপীয় দেশকে নিয়ে ১৯৪৯ সালে ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন’ বা নেটো নামের একটি সামরিক সংগঠন গড়ে তোলে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২। পাকিস্তানের স্বপ্নের ‘ইসলামীয় নেটো’র সঙ্গে এর তুলনা টানা অর্থহীন, বলছেন এ দেশের অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারেরা।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন নেটোর তিনটি দেশ পরমাণু শক্তিধর। আমেরিকা ছাড়াও সেই তালিকায় রয়েছে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের নাম। তা ছাড়া এই সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট ভাল। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি হাতিয়ার নির্মাণের পারদর্শিতা রয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন এবং ইটালির। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকার কারণে সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য নিয়ে এগোতে পারছে তারা। ওআইসি-ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে তা একেবারেই নেই।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, ভেঙে চার থেকে পাঁচ টুকরো হতে পারে ‘ইসলামীয় নেটো’ গঠনের মূল হোতা পাকিস্তানই। ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির বালোচিস্তান এবং খাইবার-পাখতুনখোয়ায় ইতিমধ্যেই বিদ্রোহের আগুন তীব্র। আফগানিস্তানের সঙ্গে আবার ইসলামাবাদের রয়েছে সীমান্ত বিবাদ। অন্য দিকে ইরাক ভেঙে কুর্দিস্তান তৈরির ক্রমাগত ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে তেহরান।
চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের সঙ্গে ‘কৌশলগত-পারস্পরিক’ সামরিক চুক্তি করেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটির পরই রিয়াধকে ‘পরমাণু সুরক্ষা’র আশ্বাস দিতে শোনা যায় ইসলামাবাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফের গলায়। এ-হেন আণবিক হাতিয়ারের ‘কুমিরছানা’ দেখিয়ে ‘ইসলামীয় নেটো’র পালে হাওয়া দেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে তাঁদের।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ওআইসি-ভুক্ত ৫৭টি দেশের মধ্যে মাত্র আটটি দেশের আর্থিক অবস্থা ভাল। সেই তালিকায় রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত এবং জর্ডনের নাম। অপরিশোধিত খনিজ তেল রফতানির উপরে চলছে এদের অর্থনীতি। মিশরের আর্থিক অবস্থা আবার দাঁড়িয়ে আছে সুয়েজ় খালের উপর। এই পরিস্থিতিতে স্বপ্নপূরণে ইসলামাবাদ কী কী পদক্ষেপ করে সেটাই এখন দেখার।