পাকিস্তানে ফের সেনার সরকার? কুর্সি হারাতে চলেছেন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি? তার জায়গায় সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির বসতে পারেন বলে তীব্র হয়েছে জল্পনা। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর জন্য সংবিধান বদলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে ইসলামাবাদ। যদিও সরকারি ভাবে সেই দাবি মানতে নারাজ প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ এবং তাঁর সরকার।
পাক সেনাপ্রধান মুনিরের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা সংক্রান্ত খবর প্রথম বার প্রকাশ্যে আনে ‘দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’। করাচির সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, চলতি বছরের ১৫ জুলাই প্রেসিডেন্ট জারদারির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শরিফের বৈঠক শেষ হতে না হতেই তাঁর সঙ্গে দেখা করেন রাওয়ালপিন্ডির ফিল্ড মার্শাল। সেখানেই কুর্সিলাভের ষড়যন্ত্রের নীলনকশা ছকে ফেলা হয় বলে ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
‘দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’ জানিয়েছে, ফিল্ড মার্শাল মুনিরকে প্রেসিডেন্ট করতে পাক সংবিধানের ২৭তম সংশোধনীর প্রয়োজন রয়েছে। আগামী অধিবেশনে সেটা আনতে পারে শাহবাজ় সরকার। ইসলামাবাদের পার্লামেন্ট ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’তে সংশ্লিষ্ট সংশোধনীটি পাশ হয়ে গেলে পদত্যাগ করা ছাড়া প্রেসিডেন্ট জ়ারদারির কাছে দ্বিতীয় রাস্তা খোলা থাকবে না। তখন অনায়াসেই তাঁর ছেড়ে যাওয়া কুর্সিতে গিয়ে বসতে পারবেন পাক সেনাপ্রধান।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, গত এক মাসে এই নিয়ে তৃতীয় বার ইসলামাবাদে তীব্র হল সেনা অভ্যুত্থানের জল্পনা। আর তাই একে গুজব বলে উড়িয়ে দিতে নারাজ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের দাবি, প্রধান জোটসঙ্গী ‘পাকিস্তান পিপল্স পার্টি’ বা পিপিপির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শরিফের দল ‘পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ়’ বা পিএমএল-এনের ক্রমশ ফাটল চওড়া হচ্ছে। সেই কারণে মুনিরকে সামনে রেখে ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন শাহবাজ়।
বর্তমান পাক প্রেসিডেন্ট জ়ারদারি আবার পিপিপির সহ-সভাপতি পদে রয়েছেন। তাঁর ছেলে তথা ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির’ সদস্য বিলাবল ছিলেন সাবেক বিদেশমন্ত্রী। দক্ষিণ-পূর্বের সিন্ধ প্রদেশকে পিপিপি-র গড় বলা যেতে পারে। শরিফের দলের অভিযোগ, নানা ইস্যুতে সেখানে একাধিক গণ আন্দোলনে ইন্ধন দিচ্ছেন জ়ারদারি এবং বিলাবল, যা নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকার এবং সেনাকে।
সিন্ধের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল জলসঙ্কট। ২০২৩ সালে ‘পাকিস্তানের সবুজায়ন উদ্যোগ’ (গ্রিন পাকিস্তান ইনিশিয়েটিভ) নামের একটি প্রকল্পের সূচনা করে ইসলামাবাদ। এর মূল উদ্দেশ্য হল কৃষির উন্নতিসাধন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির আওতায় চোলিস্তান সেচ খাল কাটার সিদ্ধান্ত নেয় শরিফ সরকার। এর মাধ্যমে পঞ্জাব, সিন্ধু ও বালোচিস্তান— এই তিনটি প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষের জল পৌঁছোবে বলে জানিয়েছিল প্রশাসন।
চোলিস্তান প্রকল্পে কয়েক লক্ষ একর মরু এলাকায় মোট ছ’টি খাল কাটার কথা বলা রয়েছে। এর মাধ্যমে পঞ্জাব, সিন্ধু ও বালোচিস্তান— তিন প্রদেশের জন্য দু’টি করে খাল বরাদ্দ করেছিল পাক সরকার। শুধু তা-ই নয়, পাঁচটি খাল সিন্ধু নদী এবং একটি খাল সিন্ধুরই শাখানদী শতদ্রু থেকে কাটার পরিকল্পনা করে ইসলামাবাদ।
কিন্তু, গত মার্চে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিকে কেন্দ্র করে সিন্ধ প্রদেশে বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। গোটা পরিকল্পনাটি পাক পঞ্জাব প্রদেশে জলের জোগান বৃদ্ধি করার কথা মাথায় রেখে করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন আন্দোলনকারীরা। সেখানকার বিধানসভায় এর বিরোধিতা করে পাশ হয় একটি প্রস্তাব। শুধু তা-ই নয়, এই ইস্যুতে শরিফ সরকারকে ‘ফল ভুগতে হবে’ বলে হুঙ্কার দিয়েছিল অন্যতম শরিক দল পিপিপি।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চোলিস্তান প্রকল্পে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত আছে পাক সেনা। এর শিলান্যাস অনুষ্ঠানে পঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মরিয়ম নওয়াজ়ের সঙ্গে হাজির ছিলেন সেনাপ্রধান মুনির। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় আবার সম্পর্কে মরিয়মের কাকা। তাঁর বাবা নওয়াজ় শরিফ ছিলেন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। জোট শরিক হওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে পিপিপি জায়গা না পাওয়ায় বেজায় ক্ষুব্ধ হন জ়ারদারি ও বিলাবল।
গত এপ্রিলে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি হামলায় জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পর্যটক-সহ ২৬ জনের মৃত্যু হলে ‘সিন্ধু জল চুক্তি’ স্থগিত করে ভারত। এতে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে জলসঙ্কট আরও তীব্র হওয়ায় আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লিকে বন্ধুত্বের বার্তা দিতে আচমকাই একটি সাক্ষাৎকারে বিস্ফোরক দাবি করে বসেন জ়ারদারি-পুত্র বিলাবল। তাতে পাক সেনার পাশাপাশি প্রবল অস্বস্তির মুখে পড়ে সে দেশের গুপ্তচরবাহিনী আইএসআই (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স)।
৪ জুলাই কাতারের গণমাধ্যম আল জাজিরাকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন ‘পাকিস্তান পিপল্স পার্টি’ বা পিপিপির চেয়ারম্যান বিলাবল। সেখানে ২৬/১১ হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ তথা কুখ্যাত জঙ্গি গোষ্ঠী লশকর-ই-তৈবার নেতা হাফিজ় সইদ এবং জইশ-ই-মহম্মদের প্রতিষ্ঠাতা মৌলানা মাসুদ আজ়হারকে ‘উদ্বেগজনক ব্যক্তি’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। পাশাপাশি বলেন, ‘‘এই দু’জনকে ভারতে ফেরত পাঠানো যেতে পারে। তবে অবশ্যই নয়াদিল্লিকে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা এবং সদিচ্ছা দেখাতে হবে।’’
বিলাবলের ওই মন্তব্যের পর পাকিস্তান জুড়ে শোরগোল পড়ে যায়। কয়েক বছর আগেই দুই জঙ্গিগোষ্ঠী লশকর-ই-তৈবা এবং জইশ-ই-মহম্মদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ইসলামাবাদের ‘ন্যাশনাল কাউন্টার টেররিজ়ম অথরিটি’ বা ন্যাকটা। তবে এর পুরোটাই যে লোকদেখানো, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ, লশকর এবং জইশের মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের আসল মদতদাতা পাক ফৌজ ও গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। আর তাই নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এর শীর্ষনেতাদের দিব্যি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছে।
বিশ্লেষকদের দাবি, এই সমস্ত কারণের জেরে জারদারি ও বিলাবলকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে গুরুত্বহীন করতে চাইছেন সেনাপ্রধান মুনির। গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের ‘যুদ্ধে’ ভারতের হাতে মার খাওয়ার পরই জেনারেল থেকে ফিল্ড মার্শালে পদোন্নতি হয় তাঁর। পাক সেনার ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত দু’জন ওই পদ পেয়েছেন। মুনিরের আগে এই সম্মান ছিল শুধুমাত্র মহম্মদ আয়ুব খানের ঝুলিতে। জেনারেল পদে থাকাকালীনই সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন তিনি।
ফলে দেশভাগের ১১ বছরের মধ্যেই ইসলামাবাদ চলে যায় সেনাশাসনে। পরবর্তী কালে আয়ুবের দেখানো রাস্তায় হাঁটতে দেখা গিয়েছে একাধিক ফৌজি জেনারেলকে। যদিও তাঁদের কেউই ফিল্ড মার্শাল পদ পাননি। মজার বিষয় হল, ১৯৫৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জ়াকে সরিয়ে ক্ষমতা দখলের পর নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষণা করেন আয়ুব। এই সেনা অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় (পড়ুন ১৯৫৯ সালে) নিজেই নিজেকে ফিল্ড মার্শাল খেতাব দেন তিনি। মুনির অবশ্য ইতিমধ্যেই ওই পদ পেয়ে গিয়েছেন। এ বার প্রেসিডেন্ট হলে পূর্বসূরির সঙ্গে তাঁর যে পুরোপুরি তুলনা টানা শুরু হবে, তা বলাই বাহুল্য।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ অবশ্য ফিল্ড মার্শাল মুনিরের প্রেসিডেন্ট পদ পাওয়ার গুজবকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। গত ১১ জুলাই এই ইস্যুতে মুখ খোলেন প্রধানমন্ত্রী শরিফ। দ্য নিউজ়কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘ফিল্ড মার্শাল মুনির প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোনও ইচ্ছাপ্রকাশ করেননি। ভবিষ্যতেও তাঁর এমন কোনও পরিকল্পনা নেই। এগুলি সবই নিছক কল্পনা।’’
কিন্তু, গত ১০ জুলাই এ ব্যাপারে সমাজমাধ্যমে বিস্ফোরক পোস্ট করেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী মহসিন নকভি। এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) তিনি লেখেন, ‘‘তিনটে লোক দুষ্ট পরিকল্পনা করছেন। আমরা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অবগত।’’ নকভিকে রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারদের ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়। তাঁর বলা ‘তিনটে লোক’ যে প্রেসিডেন্ট জ়ারদারি, প্রধানমন্ত্রী শরিফ এবং ফিল্ড মার্শাল মুনির তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ জানিয়েছেন, ২৭তম সংবিধান সংশোধন নিয়ে এখনও কোনও আলোচনা করা হয়নি। তবে পিপিপি ও পিএমএল-এন একসঙ্গে সরকার চালাবে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি এবং থাকব। এটা শুধু ক্ষমতার বিষয় নয়। বরং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার।’’ উল্লেখ্য, গত বছরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না মেলায় পিপিপির সঙ্গে জোট করে প্রধানমন্ত্রী হন শাহবাজ়।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, প্রেসিডেন্ট পদ থেকে জ়ারদারি সরলে রাজনৈতিক ভাবে ফাঁকা মাঠ পাবেন শরিফ। সেই কারণেই ফিল্ড মার্শাল মুনিরকে ওই পদে বসাতে চাইছেন তিনি। কিন্তু পাকিস্তানের ইতিহাসে বার বার দেখা গিয়েছে যে, ক্ষমতার স্বাদ পেলেই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন সেনাকর্তারা। মুনির শেষ পর্যন্ত সেই রাস্তায় হাঁটেন কি না, তার উত্তর দেবে সময়।