পাকিস্তানের পরমাণু বোমা কি সত্যিই পাকিস্তানের? না কি বহিরাগত কেউ নিয়ন্ত্রণ করে সেই মারণাস্ত্র? ‘অপারেশন সিঁদুর’ শেষ হওয়ার প্রায় দু’মাসের মাথায় এই সমস্ত প্রশ্ন উস্কে দিয়েছেন মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-র (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) এক সাবেক আধিকারিক। তাঁর করা বিস্ফোরক মন্তব্য ঘিরে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। তবে এই ইস্যুতে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে ইসলামাবাদ।
জন কিরিয়াকু। মার্কিন গুপ্তচরবাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী ডেস্কের এই সাবেক আধিকারিক একটা সময়ে মোতায়েন ছিলেন পাকিস্তানে। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইসলামাবাদের যাবতীয় পরমাণু হাতিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের একজন ফৌজি জেনারেলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাঁর করা এই মন্তব্য এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) পোস্ট হতেই ঝড়ের বেগে তা ভাইরাল হয়ে যায়।
সাক্ষাৎকারে কিরিয়াকু বলেন, ‘‘পরমাণু অস্ত্রের কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণ বেশ কয়েক বছর আগেই পাক সরকার একজন মার্কিন জেনারেলের হাতে তুলে দেয়। ফলে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।’’ শুধু তা-ই নয়, রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের এই সিদ্ধান্ত নয়াদিল্লিকে কিছুটা ‘পিছু হটতে’ বাধ্য করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সিআইএ-র গোপন তথ্য ফাঁস করার জন্য আগেও বহু বার খবরের শিরোনামে এসেছেন কিরিয়াকু। ‘ওয়াটারবোর্ডিং’ পদ্ধতিতে সন্ত্রাসবাদীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকে মার্কিন গুপ্তচরবাহিনী। ২০০৭ সালে সেই তথ্য প্রথম বার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে দেন সিআইএ-র এই প্রাক্তনী। ওই সময়ে কিরিয়াকু দাবি করেন, কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়দার বন্দি সদস্যদের পেট থেকে কথা বার করতে ‘ওয়াটারবোর্ডিং’ প্রয়োগ করা হয়েছিল। আর সেটা ছিল বেশ যন্ত্রণার।
২০১২ সালে এক সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়ে এ কথা বলেন কিরিয়াকু। এর পরেই যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে হইচই পড়ে যায়। ওঠে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সিআইএ-র গুপ্ত তথ্য ফাঁস করার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করে মার্কিন সরকার। বিচারে ৩০ মাসের জেল হয় কিরিয়াকুর। সেই শাস্তি ভোগ করা সত্ত্বেও নিজের ‘স্বভাব’ যে তিনি পাল্টাননি, পাক পরমাণু হাতিয়ারের ব্যাপারে বিস্ফোরক কথা বলে ফের তা প্রমাণ করলেন সাবেক আমেরিকান গুপ্তচর।
ইসলামাবাদের আণবিক হাতিয়ার নিয়ে কিরিয়াকুর এ-হেন বিস্ফোরক মন্তব্যের কাটাছেঁড়া করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে উঠে এসেছে একাধিক প্রশ্ন। তাঁদের জিজ্ঞাসা, সেই কারণেই কি ‘অপারেশন সিঁদুর’ চলাকালীন ভারত-পাক ‘যুদ্ধ’ বন্ধ করতে উদ্যোগী হয় আমেরিকা? লড়াই থামায় পরমাণু হামলা আটকানো গিয়েছে বলে ক্রমাগত ঢাক পিটিয়ে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প?
দ্বিতীয়ত, জম্মু-কাশ্মীরের সীমান্ত পার সন্ত্রাসের প্রত্যাঘাত থেকে শুরু করে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত ইস্যুতে বহু বার নয়াদিল্লিকে আণবিক যুদ্ধের হুমকি দিয়েছে ইসলামাবাদ। বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, কিরিয়াকুর কথামতো পরমাণু হাতিয়ারের নিয়ন্ত্রণ আমেরিকার জেনারেলের হাতে থাকলে, সংঘাত পরিস্থিতিতে সেটিকে আদৌ ব্যবহার করতে পারবে তারা? উত্তর ‘না’ হলে, পাকিস্তানকে পরমাণু শক্তিধর বলার সার্থকতা কোথায়?
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদের চার দিনের ‘যুদ্ধে’ ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র ভান্ডারে আঘাত হেনেছে বলে সমাজমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে। যদিও সরকারি ভাবে কোনও পক্ষই বিষয়টি স্বীকার করে নেয়নি। সংঘর্ষবিরতির পর এ ব্যাপারে মুখ খোলেন ইউরোপীয় যুদ্ধ-ইতিহাসবিদ টম কুপার। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করেন তিনি।
চলতি বছরের মে মাসে ইতিহাসবিদ টম বলেন, ‘‘অপারেশন সিঁদুরে পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র ভান্ডারে হামলা করার স্বাধীনতা পেয়েছিল ভারতীয় ফৌজ। যুদ্ধ যে পর্যায়ে গিয়েছিল, তাতে সেই সিদ্ধান্ত নিতেই পারতেন নয়াদিল্লির সেনাকর্তারা। তবে সে ক্ষেত্রে আণবিক অস্ত্রের পাল্টা প্রত্যাঘাতের কোনও ক্ষমতাই ছিল না ইসলামাবাদের।’’ এর জন্য ভারতের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) কন্ট্রোল অ্যান্ড কমান্ড ইউনিটের ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি।
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের গোড়া থেকেই তার উপর কড়া নজর রাখছিলেন কুপার। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘নয়াদিল্লির সেনাকর্তারা সহজে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেন না। তাঁরা সংবেদনশীল, সতর্ক এবং বুদ্ধিমান। পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতার একটা ধারণা রয়েছে তাঁদের। পাক ফৌজের আফিসারদের একটা বড় অংশের সেটা নেই। সেই কারণেই যখন-তখন আণবিক হামলার হুমকি দিয়ে থাকেন তাঁরা।’’
পাশাপাশি আরও একটি বিষয় নিয়ে মুখ খোলেন ইউরোপীয় যুদ্ধ ইতিহাসবিদ কুপার। তাঁর কথায়, ‘‘পাকিস্তান নিজের পরমাণু অস্ত্র রক্ষা করতে অক্ষম। এটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা বিশ্বের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা বড় ঝুঁকির বিষয়।’’ আন্তর্জাতিক মহলে এ ব্যাপারে গভীর চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে বলেও ওই সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করেন টম।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণ করে ইতিহাসবিদ কুপার দাবি করেন, পাকিস্তানের ভূগর্ভস্থ পরমাণু অস্ত্র ভান্ডারের মুখে গিয়ে আঘাত হানে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র। ফলে সেখানকার মাটি-দেওয়াল ধসে পড়ে সেই রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে আগামী দিনে সেখানকার আণবিক অস্ত্র ইসলামাবাদ আদৌ ব্যবহার করতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
এ ব্যাপারে বেশ কয়েকটি উপগ্রহচিত্র দেখিয়ে কুপার বলেছেন, ‘‘পাক ফৌজ তাঁদের ভূগর্ভস্থ হাতিয়ারের গুদামে প্রবেশ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হওয়া ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে সেখানে যাওয়া মোটেই সহজ নয়। আর ওই রাস্তা চিরতরে বন্ধ হলে খেলা শেষ। ইসলামাবাদ হারাবে তাদের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু অস্ত্র ভান্ডার।’’ এ ক্ষেত্রে ভারত যে চালকের আসনে রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ ইতিহাসবিদ কুপারের বক্তব্যের সঙ্গে মার্কিন গুপ্তচরবাহিনীর সাবেক অফিসার কিরিয়াকুর বয়ানের বেশ মিল খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের অনুমান, পাকিস্তানের ভূগর্ভস্থ পরমাণু অস্ত্র ভান্ডারকে ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র নিশানা করায় বিপাকে পড়ে আমেরিকা। কারণ, সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল তাঁদের উপর। আর তাই ‘যুদ্ধ’ থামাতে উঠেপড়ে লেগেছিল ওয়াশিংটন।
সিআইএ-র সাবেক অফিসারের দেওয়া বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া না দিলেও ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ ভারতীয় সেনার প্রত্যাঘাতের তীব্রতা নিয়ে মুখ খুলেছেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের বিশেষ সহকারী (পড়ুন স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট) রানা সানাউল্লাহ। তাঁর দাবি, রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে ইসলামাবাদের নুর খান বায়ুসেনা ঘাঁটিকে নিশানা করে নয়াদিল্লি। ক্ষেপণাস্ত্রটি আণবিক বিস্ফোরক (ওয়ারহেড) বহন করছে মনে করে ওই সময় সারা দেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।
সংবাদমাধ্যমকে রানা সানাউল্লাহ বলেছেন, ‘‘ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্রকে চিহ্নিত করার জন্য আমাদের সেনাবাহিনীর হাতে মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় ছিল। কিন্তু, তার মধ্যে তীব্র গতির ওই হাতিয়ারকে চিহ্নিত করা যায়নি। এটি পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম হওয়ায় সারা দেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফৌজ ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এর পর আর দেরি না করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলাম আমরা। লড়াই না থামলে হয়তো পাকিস্তান নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।’’
‘অপারেশন সিঁদুর চলাকালীন পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের অন্যতম তথা ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ়’-এর এক্জ়িকিউটিভ ডিরেক্টর ইমতিয়াজ় গুলের একটি ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে তিনি দাবি করেন, ‘‘পাক ফৌজি অফিসারদের নূর খান বিমানঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি নেই। কারণ, ওটা পুরোপুরি ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের সামরিক মালবাহী বিমান সেখানে প্রায়ই অবতরণ করে থাকে। সেগুলিতে কী ধরনের পণ্য আনা-নেওয়া করা হচ্ছে, তা কখনওই ইসলামাবাদের কাছে প্রকাশ করতে রাজি নয় আমেরিকা।’’
এ ব্যাপারে একটি ঘটনারও উল্লেখ করেন পাক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ গুল। তাঁর দাবি, একবার নাকি ইসলামাবাদের সেনাবাহিনীর এক পদস্থ কর্তা নূর খান ঘাঁটিতে নামা একটি মার্কিন সামরিক মালবাহী বিমানকে আটকে দেন। জিজ্ঞাসা করেন, এতে কী কী পণ্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজি কমান্ডারেরা কোনও প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাঁকে ‘অনধিকার চর্চা’ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। বিষয়টি নিয়ে তর্কাতর্কি বেধে গেলে আমেরিকান সৈন্যেরা পাক সেনার ওই পদস্থ অফিসারের মাথায় পিস্তল ঠেকান বলে জানিয়েছিলেন গুল।
গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ মোট ২২ জন। এর পরই ইসলামাবাদের সঙ্গে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করে নয়াদিল্লি। পাশাপাশি, ৯ মে পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর বা পিএজেকের (পাকিস্তান অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর) মোট ন’টি সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় ভারতীয় সেনা। সেই অভিযানের নাম রাখা হয় ‘অপারেশন সিঁদুর’। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জঙ্গিদের পক্ষ নিয়ে আসরে নেমে ড্রোন হামলা শুরু করে ইসলামাবাদ।
ওই পরিস্থিতিতে ‘আকাশ প্রতিরক্ষা’ ব্যবস্থা ব্যবহার করে প্রথম মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলিকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করে ভারতীয় ফৌজ। এর পর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইসলামাবাদের ১১টি বিমানঘাঁটিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় এ দেশের বাহিনী। ফলে চার দিনের মাথায় সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হয় পাকিস্তান। ‘যুদ্ধ’ থামলে জানা যায়, রাওয়ালপিন্ডির বিমানবাহিনীর ২০ শতাংশ পরিকাঠামো নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এ সংঘর্ষবিরতি হলে ইসলামাবাদকে কড়া হুঁশিয়ারি দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে আর কখনওই পরমাণু হামলার পাক ‘ব্ল্যাকমেল’ সহ্য করবে না ভারত।’’ এই মারণাস্ত্র নিয়ে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের বিশেষ গর্ব রয়েছে। যদিও তার নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে আছে, তা নিয়েই উঠে গেল প্রশ্ন।