নেপালকে ব্যবহার করে ভারতের উপরে ফিদায়েঁ হামলার ছক কষছে পাকিস্তানের জঙ্গিরা। এমনই বিস্ফোরক দাবি করে নয়াদিল্লিকে সতর্ক করলেন সেখানকার এক পদস্থ কর্তা। ফলে বিষয়টিকে একেবারেই হালকা ভাবে নিতে নারাজ কেন্দ্র। হিমালয়ের কোলের প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে ‘খোলা সীমান্ত’ থাকায় বেড়েছে চাপ। আর তাই গোর্খাভূমিকে সঙ্গে নিয়েই ইসলামাবাদের ষড়যন্ত্র ভেস্তে দেওয়ার পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছেন এ দেশের দুঁদে গোয়েন্দারা, খবর সূত্রের।
সম্প্রতি, কাঠমান্ডুতে ‘দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক একটি সেমিনারে ভাষণ দেন নেপালি প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পৌডেলের প্রধান রাজনৈতিক উপদেষ্টা তথা সাবেক শিল্পমন্ত্রী সুনীল বাহাদুর থাপা। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপুঞ্জ স্বীকৃত লশকর-এ-ত্যায়বা এবং জইশ-ই-মহম্মদের মতো পাক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ভারতকে নিশানা করতে আমাদের দেশের মাটিকে ব্যবহার করতে পারে। দিল্লির সঙ্গে আমাদের লম্বা সীমান্ত থাকায় এটা তাদের পছন্দের ট্রানজ়িট রুট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’’
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ভারতে হামলা চালাতে পাক জঙ্গি সংগঠনগুলির নেপালকে ব্যবহারের চেষ্টার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিলে জন্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী আক্রমণের পর ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন সিঁদুর’ চালায় নয়াদিল্লি। গত মে মাসে ভারতীয় সেনার ওই অভিযানে মারাত্মক ভাবে ‘মার’ খেতে হয়েছে রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের। পাশাপাশি, সীমান্তপার সন্ত্রাসবাদীদের একাধিক ঘাঁটিকে গুঁড়িয়ে দেয় এ দেশের বাহিনী।
‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের ‘যুদ্ধের’ পর সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হয় পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশী। কিন্তু, লড়াই থামলেও কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার ঘোষণা করে দেয় যে আগামী দিনে ইসলামাবাদের দিক থেকে কোনও জঙ্গি হামলা হলে তাকে যুদ্ধ হিসাবে (পড়ুন অ্যাক্ট অফ ওয়ার) বিবেচনা করবে নয়াদিল্লি। এর পরেই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে অন্য ষড়যন্ত্র ছকে ফেলে পাক গুপ্তচরবাহিনী আইএসআই (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স)। লশকর ও জইশ জঙ্গিরা যাতে নেপালে ঘাঁটি গাড়তে পারে, সেই পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সুনীল বাহাদুর থাপার কথা সত্যি হলে কঠিন চ্যালে়ঞ্জের মুখে পড়বে ভারতের নিরাপত্তা। কারণ, ঐতিহাসিক ভাবে নেপালের সঙ্গে নয়াদিল্লির মধুর সম্পর্ক রয়েছে। আর তাই সেখানকার মাটি ব্যবহার করে পাক জঙ্গিরা হামলা চালালে কাঠমান্ডুতে প্রত্যাঘাতের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না এ দেশের সরকার বা সেনা। অন্য দিকে হিমালয়ের কোলের দেশটিকে সামনে রেখে ভারতকে ক্রমাগত ক্ষতবিক্ষত করতেই থাকবে আইএসআই এবং লশকর ও জইশ জঙ্গিরা।
দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ আমল থেকে ভারতের হয়ে যুদ্ধ লড়ে চলেছেন নেপালি গোর্খারা। তাঁদের জন্য বাহিনীতে আলাদা একটি রেজিমেন্ট রয়েছে। পাক জঙ্গিদের নিকেশ করতে নেপালে সৈন্য অভিযান চালালে তাঁদের বিদ্রোহী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তৃতীয়ত, সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত হওয়ার দাবি তুলে নয়াদিল্লির সঙ্গে শত্রুতার রাস্তায় হাঁটতে পারে কাঠমান্ডু। কূটনৈতিক দিক থেকে যেটা হবে কেন্দ্রের কাছে বড় হার।
তবে এ ব্যাপারে উল্টো মতও রয়েছে। নেপাল যে পাকিস্তানের জঙ্গি কার্যকলাপে একেবারেই খুশি নয়, তা কাঠমান্ডুর সেমিনারে দেওয়া ভাষণে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন সেখানকার প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক উপদেষ্টা সুনীল। অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মিনেন্দ্র রিজ়াল, সাবেক বিদেশমন্ত্রী এনপি সৌদ, সাবেক কূটনীতিক দীনেশ ভট্টরাজ এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার মেজর জেনারেল পূর্ণা সিলওয়াল। তাই এ ব্যাপারে হিমালয়ের কোলের প্রতিবেশী দেশটির থেকে সব রকমের সহযোগিতা যে ভারত পাবে, তা বলাই বাহুল্য।
অতীতে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে কাঠমান্ডুর থেকে নয়াদিল্লির খোলাখুলি সমর্থন পাওয়ার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। ২০১৩ সালে ভারত-নেপাল সীমান্তে লশকর জঙ্গি আবদুল করিম টুন্ডাকে গ্রেফতার করে এ দেশের গোয়েন্দারা। কাঠমান্ডুর দিক থেকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা পেয়েছিলেন তাঁরা। ৪০টির বেশি বিস্ফোরণের সঙ্গে টুন্ডার জড়িয়ে থাকার প্রমাণ রয়েছে। পাক গুপ্তচরবাহিনী আইএসআইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাঁর।
১৯৯৮ সালে কাঠমান্ডুতে ‘সুপারি কিলার’দের গুলিতে খুন হন নেপালি পার্লামেন্টর সদস্য ভারতীয় বংশোদ্ভূত মির্জ়া দিলশাদ বেগ। ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নেমে বিস্ফোরক তথ্য পায় স্থানীয় পুলিশ। জানা যায়, ১৯৯৩ সালের মুম্বই বিস্ফোরণের ‘মাস্টারমাইন্ড’ আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিম কাসকরের ‘ডি কোম্পানি’র হয়ে কাজ করছিলেন তিনি। ভারতবিরোধী কার্যকলাপের জন্য তাঁকে ব্যবহার করার সুযোগ ছাড়েনি পাক গুপ্তচরবাহিনী আইএসআই।
গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের শেষ পর্বে মির্জা বেগ খুনের তদন্তে উঠে আসা তথ্য নয়াদিল্লিকে সরবরাহ করতে দেরি করেনি কাঠমান্ডু। ২০১৩ সালে পাক মদতপুষ্ট ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন জঙ্গিগোষ্ঠীর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসিন ভাটকলকে গ্রেফতার করে নেপাল পুলিশ। পরবর্তী কালে তাঁকে ভারতের হাতে তুলে দেয় প্রতিবেশী দেশটির সরকার। ইয়াসিনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে পুণে ও বেঙ্গালুরু স্টেডিয়ামে বিস্ফোরণ, ২০১১ সালের মুম্বই এবং ২০১৩ হায়দরাবাদ বিস্ফোরণে জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে। ২০১৬ সালে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয় জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা বা এনআইএ-র (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি) বিশেষ আদালত। বর্তমানে নয়াদিল্লির তিহাড় জেলে রয়েছেন এই কুখ্যাত জঙ্গি।
গত বছরের এপ্রিলে নেপাল সীমান্তে দুই সন্দেহভাজন পাক নাগরিককে গ্রেফতার করে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের সন্ত্রাস-বিরোধী দল বা এটিএস (অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াড)। তাঁদের নাম মহম্মদ আলতাফ ভাট এবং সৈয়দ গজনফার। তাঁদের সঙ্গে গাইড হিসাবে ছিলেন নাসের আলি নামের এক ব্যক্তি। কী উদ্দেশ্যে তাঁরা ভারতে এসেছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। তাঁদের সঙ্গে আইএসআইয়ের যোগাযোগ ছিল বলে দাবি করেছেন এটিএস কর্তাদের একাংশ।
বিশ্লেষকদের দাবি, ভারতের বিরুদ্ধে নেপালের মাটিকে দীর্ঘ দিন ধরেই ব্যবহার করে আসছে ইসলামাবাদের গুপ্তচরেরা। ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ‘আইসি-৮১৪’ বিমানকে কাঠমান্ডু থেকে অপহরণ করে আফগানিস্তানের কন্দহরে নিয়ে যায় পাক মদতপুষ্ট হরকত-উল-মুজাহিদিনের জঙ্গিরা। উড়োজাহাজটির যাত্রীদের পণবন্দি করে তারা। ফলে তিন জন কুখ্যাত জঙ্গিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় নয়াদিল্লি। তাঁরা হলেন মৌলানা মাসুদ আজ়হার, মুস্তাক আহমেদ জারগার এবং আহমেদ ওমর সইদ।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, মুক্তি পাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে জইশ-ই-মহম্মদ নামের সন্ত্রাসীদের গোষ্ঠী গড়ে তোলে মৌলানা মাসুদ আজ়হার। ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতের সংসদ ভবনে হামলা চালায় এই সংগঠনের পাঁচ জঙ্গি। তাঁদের এলোপাথাড়ি গুলিতে প্রাণ হারান দিল্লি পুলিশের ছয় কর্মী, সংসদ ভবনের দুই নিরাপত্তারক্ষী এবং এক জন মালি। যদিও এই গুলির লড়াই বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয়নি। অচিরেই খুঁজে খুঁজে জইশ জঙ্গিদের নিকেশ করে এ দেশের বাহিনী।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫০ সালে বন্ধুত্বের স্মারক হিসাবে নেপালের সঙ্গে ‘উন্মুক্ত সীমান্ত’ চুক্তি (ওপেন বর্ডার ট্রিটি) করেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। পরবর্তী দশকগুলিকে তা কখনওই বদল করেনি নয়াদিল্লি। ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডু থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার পরেও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বদল করতে দেখা যায়নি কেন্দ্রকে।
সাবেক গোয়েন্দাকর্তাদের দাবি, ভারতে সন্ত্রাসের বিষ ছড়িয়ে দিতে নেপালের ‘উন্মুক্ত সীমান্তের’ সুবিধা নিতে পারে পাক জঙ্গিরা। আইএসআইয়ের মদতে কাঠমান্ডু পৌঁছোনো তাদের পক্ষে কঠিন নয়। ‘খোলা সীমান্ত’ হওয়ায় এর পর খুব সহজেই সেখান থেকে ভারতে ঢুকতে পারবে তারা। ৫০-এর দশকের চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে যাতায়াতের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় না কোনও পাসপোর্ট-ভিসার। তবে নেপাল সীমান্তে সারা বছর মোতায়েন থাকে ‘সশস্ত্র সীমা বল’ বা এসএসবি নামের আধা সামরিক বাহিনী।
পাক জঙ্গিদের নিয়ে নেপালি প্রেসিডেন্টের প্রধান রাজনৈতিক উপদেষ্টার সতর্কবার্তার পর নড়েচড়ে বসেছে কেন্দ্র। সূত্রের খবর, বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকেই চাইছেন ‘উন্মুক্ত চুক্তি’র অবসান। তবে কূটনীতিকেরা মনে করেন সেটা সমস্যার সমাধান নয়। বরং কাঠমান্ডুর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তুলে পাল্টা রণকৌশল ঠিক করতে হবে নয়াদিল্লিকে। তাতে দু’কূলই রক্ষা করতে সক্ষম হবে কেন্দ্র।
এ ব্যাপারে কূটনীতিকদের পরামর্শ হল, নেপালের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠন। হিমালয়ের কোলের দেশটিতে যেখানে যেখানে আইএসআইয়ের গুপ্তঘাঁটি রয়েছে, কাঠমান্ডুকে ব্যবহার করেই সেগুলিকে গুঁড়িয়ে দিতে পারবে নয়াদিল্লি। অবস্থানগত দিক থেকে গোর্খাভূমিটি স্থলবেষ্টিত হওয়ায় পণ্য আদানপ্রদানের জন্য ভারতকে একান্ত ভাবে প্রয়োজন তাদের। সেই সুবিধা কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে কেন্দ্রকে।
তবে এ ক্ষেত্রে অন্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বর্তমানে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে রয়েছেন চিনপন্থী কেপি শর্মা ওলি। আর তাই এ ব্যাপারে তিনি কতটা নয়াদিল্লিকে সাহায্য করতে আগ্রহী হবেন তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অন্য দিকে সাম্প্রতিক সময়ে হিমালয়ের কোলের দেশটিতে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে দেখা গিয়েছে। ফলে আগামী দিনে জাতীয় সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।