‘ব্রহ্মস’-এর পর এ বার ‘প্রলয়’। সামরিক শক্তিবৃদ্ধিতে আরও একটি ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রকে ‘পাখির চোখ’ করেছে ফিলিপিন্স। সূত্রের খবর, সংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্রটি আমদানি করতে নয়াদিল্লির সঙ্গে চূড়ান্ত পর্যায়ের কথাবার্তা চালাচ্ছে ম্যানিলা। শেষ পর্যন্ত এই প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়ে গেলে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌসেনার রক্তচাপ যে কয়েক গুণ বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। কারণ, বেজিঙের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটির রয়েছে দীর্ঘ সীমান্তবিবাদ।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, চলতি বছরের জুলাইয়ের একেবারে শেষের দিকে ‘প্রলয়’ ক্ষেপণাস্ত্র আমদানির ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় ফিলিপিন্সের ফৌজ। এর পরেই দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয় আলোচনা। ম্যানিলার সেনাকর্তাদের বক্তব্য, এতে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় বজায় থাকবে শক্তির ভারসাম্য। তবে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির কতগুলি ইউনিট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটি চাইছে, তা অবশ্য প্রকাশ্যে আসেনি। জানা যায়নি সম্ভাব্য চুক্তির আর্থিক দিকটিও।
ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ‘ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন’ বা ডিআরডিওর তৈরি ‘প্রলয়’ আসলে একটি ভূমি থেকে ভূমি (পড়ুন সারফেস টু সারফেস) হামলাকারী কৌশলগত ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর উৎপাদনকারী সংস্থা হল ভারত ডায়নামিক্স লিমিটেড (বিডিএল) এবং ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড (বিইএল)। আয়তাকার বিশেষ ধরনের সিলিন্ডারের মধ্যে রাখা থাকে এই ক্ষেপণাস্ত্র, যার নাম ক্যানিস্টার। ‘প্রলয়’-এর জীবনীশক্তি বৃদ্ধির জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে।
ডিআরডিওর তৈরি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটিকে দু’ভাবে শত্রুর উপরে ছুড়তে পারে সেনা। এর মধ্যে প্রথমটি হল মাটিতে বসানো লঞ্চার। এ ছাড়া ট্রাকের মতো গাড়ি থেকেও এটিকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর দিকে নিক্ষেপ করা যেতে পারে। ‘প্রলয়’-এর জন্য গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা অশোক লেল্যান্ডের তৈরি ১২ বাই ১২ ‘হেভি মোবিলিটি ভেহিকল’ (এইচএমভি) ব্যবহার করে ভারতীয় সেনা। সংশ্লিষ্ট গাড়িটির উপরের অংশে বসানো রয়েছে ট্রান্সপোর্টার ইরেক্টর লঞ্চার।
সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ‘প্রলয়’-এর পাল্লা ১৫০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা আরও বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ‘প্রলয়’কে হাইপারসনিক (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে গতিশীল) শ্রেণিতে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে ডিআরডিও। ৩৫০ থেকে হাজার কেজি পর্যন্ত বিস্ফোরক নিয়ে সর্বোচ্চ ৬.১ ম্যাক গতিতে ছুটতে পারে উচ্চ গতিসম্পন্ন এই অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র।
‘প্রলয়’কে লঞ্চারে বসাতে সময় লাগে মাত্র ১০ মিনিট। অন্য দিকে ৬০ সেকেন্ডেরও কম সময়ে একে উৎক্ষেপণ করা যেতে পারে। লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার মুখে মাঝ-আকাশে কিছুটা পাক খেয়ে আছড়ে পড়ে এই ক্ষেপণাস্ত্র। ফলে ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ বা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের সাহায্যে একে ধ্বংস করা বেশ কঠিন। এই বিশেষ প্রযুক্তি থাকার কারণে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ ‘প্রলয়’কে আধা ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বলে উল্লেখ করে থাকেন।
২০২২ সাল থেকে ভারতীয় সেনার অস্ত্রাগারে রয়েছে ‘প্রলয়’। মূলত উচ্চ মূল্যের লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে এটি তৈরি করেছেন ডিআরডিওর গবেষকেরা। এর মধ্যে অন্যতম হল শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ও হাতিয়ারের গুদাম। যুদ্ধের সময়ে এর ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে ওঠার ক্ষমতা রয়েছে, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
ভারতীয় সেনার পাশাপাশি বায়ুসেনাও এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার (মিসাইল টেকনোলজ়ি কন্ট্রোল রেজ়িম বা এসটিসিআর) সদস্যপদ রয়েছে ভারতের। আর তাই ২৯০ কিলোমিটার পাল্লার ‘প্রলয়’ রফতানি করতে পারবে নয়াদিল্লি। এখনও পর্যন্ত এই মারণাস্ত্র কাউকে বিক্রি করেনি কেন্দ্র। সে ক্ষেত্রে ফিলিপিন্স নয়, এর প্রথম ক্রেতা হতে পারে আর্মেনিয়া। গত জুলাইয়ে ‘প্রলয়’ কেনার ব্যাপারে প্রায় পাকা কথা সেরে গিয়েছেন ইয়েরেভানের ফৌজি জেনারেলরা।
গণবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং তার প্রযুক্তি সরবরাহের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ রাখতে ১৯৮৭ সালে একটি সমঝোতা করে ৩৫টি দেশ। তাতে ঠিক হয়, ৩০০ কিলোমিটারের বেশি পাল্লার এবং ৫০০ কেজির বেশি বিস্ফোরক বহনে সক্ষম কোনও হাতিয়ার অন্য রাষ্ট্রকে সরবরাহ করা হবে না। দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধের উত্তেজনা হ্রাস করতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
উল্লেখ্য, নাগরনো-কারাবাখের দখলকে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাসে নতুন করে প্রতিবেশী আজ়ারবাইজানের সঙ্গে সম্পর্কে তিক্ততা এসেছে আর্মেনিয়ার। বিতর্কিত এই এলাকার একটা বড় অংশই ২০২০ সালে দখল করে নেয় বাকু। সেই থেকে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্লেষকদের দাবি, এত দিন পর্যন্ত আজ়ারবাইজানের ভিতরে হামলা চালানোর মতো কোনও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছিল না আর্মেনিয়ার কাছে। ‘প্রলয়’ হাতে চলে এলে সেই ক্ষমতা পাবে মধ্য এশিয়ার এই দেশ। তখন আর্মেনীয় সেনার কাছে প্রতিবেশী দেশটির রাজধানী বাকুকে নিশানা করা খুব একটা কঠিন হবে না। এক কথায় আজ়ারবাইজানের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে পারে ভারতের ‘প্রলয়’।
একটা সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গ ছিল আর্মেনিয়া ও আজ়ারবাইজান। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে রাশিয়া-সহ মোট ১৫টি দেশের জন্ম হলে পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে তারা। জন্মের কিছু দিন পর থেকেই নাগরনো-কারাবাখকে কেন্দ্র করে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বাধে বিবাদ। এই নিয়ে বেশ কয়েক বার যুদ্ধে জড়িয়েছে আর্মেনিয়া ও আজ়ারবাইজ়ান।
নাগরনো-কারাবাখের বিবাদে প্রথম দিন থেকে তুরস্কের সমর্থন পেয়ে আসছে আজ়ারবাইজান। অন্য দিকে ‘বন্ধু’ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করেছে আর্মেনিয়া। দক্ষিণ ককেসাস এলাকার দেশটির প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহে বড় ভূমিকা রয়েছে নয়াদিল্লির। ভারতীয় কামান, ছোট অস্ত্র এবং রাডার ব্যবহার করতে ভালবাসে আর্মেনিয়ার ফৌজ।
২০২২ সালে ডিআরডিওর তৈরি পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার হাতে পেতে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে আর্মেনিয়ার সরকার। গত বছরের ডিসেম্বরে ওই মারণাস্ত্র মধ্য এশিয়ার দেশটিকে সরবরাহ করেছে নয়াদিল্লি। এ ছাড়া আকাশ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমও ইয়েরেভানকে সরবরাহ করেছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।
পাল্লা অনুযায়ী ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর ব্যবহৃত এই অস্ত্রের বেশ কয়েকটি প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন, ৪৫ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যে নিখুঁত নিশানায় হামলা করতে পারে পিনাকা মার্ক-১। অন্য দিকে পিনাকা মার্ক-২-এর পাল্লা ৯০ কিলোমিটার। আর্মেনিয়াকে ৯০ কিলোমিটার পাল্লার পিনাকা সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
পিনাকার সবচেয়ে ভাল দিক হল, মাত্র ৪৪ সেকেন্ডে ১২টি রকেট নিক্ষেপ করার ক্ষমতা। এর এক একটি ব্যাটারির ৭২টি রকেট ছোড়ার ক্ষমতা রয়েছে। হাতিয়ারটির প্রতিটা লঞ্চারকে স্বাধীন ভাবে চালানো যায়। রকেটগুলির মাধ্যমে একক ভাবে বা একসঙ্গে বিভিন্ন দিকে হামলা করার সুবিধা রয়েছে।
অন্য দিকে ২০২২ সালে ভারত ও রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে নয়াদিল্লির সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করে ফিলিপিন্স নৌসেনা। এর জন্য ৩৭ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার খরচ করেছে ম্যানিলা। ২০২৪ সালে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির প্রথম ব্যাচ এবং এ বছরের এপ্রিলে দ্বিতীয় ব্যাচ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির নৌবাহিনীর হাতে তুলে দেয় কেন্দ্র।
‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের একাধিক শ্রেণি বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে জাহাজ বিধ্বংসী হাতিয়ারটি কিনেছে ফিলিপিন্স। পরবর্তী সময়ে ভারতীয় হাতিয়ারের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পায় ম্যানিলার। এর ফলে ‘প্রলয়’ ভূমি থেকে ভূমি হামলাকারী ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি কিনতে চাইছে তারা। সাম্প্রতিক সময়ে এই মারণাস্ত্রটি লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশে ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ বা এলএসিতে (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) চিন সীমান্তের কাছে মোতায়েন রেখেছে এ দেশের ফৌজ।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল ‘প্রলয়’ ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ‘এয়ার ভার্সান’ তৈরিতে হাত দিয়েছে ডিআরডিও। ভারতীয় বিমানবাহিনীর শিরদাঁড়া হিসাবে পরিচিত রুশ লড়াকু জেট ‘এসইউ-৩০ এমকেআই’ থেকে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটিকে ছোড়া যাবে বলে জানা গিয়েছে। তবে তার জন্য একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে এ দেশের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীদের।
ডিআরডিওর গবেষকেরা ‘প্রলয়’ ক্ষেপণাস্ত্রের যে ‘এয়ার ভার্সান’ তৈরি করতে চলেছেন, তার দৈর্ঘ্য হবে ৯.০৬ মিটার। ওজন দাঁড়াতে পারে প্রায় পাঁচ টন। এতটা ভারী ক্ষেপণাস্ত্রকে ‘এসইউ-৩০ এমকেআই’ যুদ্ধবিমানের লঞ্চারে বসানো যে বেশ কঠিন হবে, তা বলাই বাহুল্য। কারণ, সংশ্লিষ্ট জেটটির দৈর্ঘ্য মেরেকেটে ২২ মিটার বলে জানা গিয়েছে। বর্তমানে এই ব্যারিকেড টপকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা।