Modi Trump Phone Call

শুল্কের ব্যুমেরাংয়ে হাঁসফাঁস দশা, মুক্তি পেতে ফের মোদীর শরণে! ‘অহঙ্কারী’ ট্রাম্পের ফোনই তুলছেন না প্রধানমন্ত্রী?

শুল্কযুদ্ধের আবহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফোনই নাকি ধরছেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। একটি জার্মান গণমাধ্যমের এ-হেন প্রতিবেদনে দুনিয়া জুড়ে শুরু হয়েছে শোরগোল।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৫৪
Share:
০১ ২০

শুল্ক নিয়ে চমকানি-ধমকানি। চাপ তৈরি করতে বড় বড় হাঁকডাক। কিন্তু, সবই যেন ব্যুমেরাং হয়ে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে আসছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে! এক কথায় নিজের জালেই জড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। তড়িঘড়ি হাঁসফাঁস দশা থেকে মুক্তি পেতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে কথা বলে বিবাদ মেটাতে চাইছেন ‘পোটাস’ (প্রেসিডেন্ট অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেট্স)। কিন্তু, ‘বিশ্বাসঘাতক বন্ধু’র ফোন নাকি তুলছেন না মোদী। ভারতীয় অর্থনীতি নিয়ে বিষোদ্গারের শাস্তি? দুনিয়া জুড়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।

০২ ২০

চলতি বছরের ২৭ অগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক নেওয়া শুরু করছে ট্রাম্পের আমেরিকা। ছা়ড় পাচ্ছে একমাত্র ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম, বিরল খনিজ এবং সেমিকন্ডাক্টরের মতো সামগ্রী। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে একটা বিস্ফোরক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জার্মান গণমাধ্যম ‘ফ্রাঙ্কফুর্টার অ্যালজ়েমেইন জ়েইতুং’ (এফএজ়েড)। প্রতিবেদনটি নিয়ে বিশ্ব জুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের তরফে অবশ্য এই নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।

Advertisement
০৩ ২০

এফএজ়েডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে মোদীকে অন্তত চার বার ফোন করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। কিন্তু কোনও বারই ফোন ধরেননি প্রধানমন্ত্রী। ফলে ভারতের ক্ষেত্রে তাঁর শুল্ক-হুমকি এবং চাপ দিয়ে কাজ হাসিলের কূটকৌশল সম্পূর্ণ ভাবে মাঠে মারা গিয়েছে। জার্মান ভাষায় লেখা ওই রিপোর্টে অবশ্য কোন কোন তারিখে ট্রাম্প ফোনে মোদীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন, তার উল্লেখ করা হয়নি। বিশ্বস্ত সূত্রে গোটা বিষয়টি জানা গিয়েছে বলে দাবি করেছে ওই ইউরোপীয় গণমাধ্যম।

০৪ ২০

মোদীর দিক থেকে ট্রাম্পের ফোন না ধরার নেপথ্যে অবশ্য একাধিক কারণের উল্লেখ করেছে ‘ফ্রাঙ্কফুর্টার’। এ ব্যাপারে ভিয়েতনামের উদাহরণ টেনেছে সংশ্লিষ্ট জার্মান সংবাদমাধ্যম। গত কয়েক মাস ধরেই বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে হ্যানয়ের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিল ওয়াশিংটন। গত জুলাইয়ে বিষয়টি নিয়ে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন ট্রাম্প। ঠিক তার পরেই দু’তরফের যাবতীয় ‘গুপ্ত কথা’ নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ ফাঁস করে দেন তিনি।

০৫ ২০

ট্রাম্পের পোস্টের জেরে চাপে পড়েছিল ভিয়েতনাম। কারণ, তখনও দু’তরফে সরকারি ভাবে কোনও বাণিজ্যচুক্তি হয়নি। কিন্তু গণমাধ্যমে এই সংক্রান্ত খবর প্রচার হতে শুরু করে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, বাণিজ্যচুক্তিতে যাবতীয় সুবিধা নিজের দিকে টেনে নিতে অতীতেও বহু বার এই কৌশল অবলম্বন করেছেন ট্রাম্প। আর তাই ইচ্ছা করেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ফোন এড়িয়ে গিয়েছেন মোদী।

০৬ ২০

দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের শুল্কনীতির জেরে ভারতীয় অর্থনীতির বড় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা কম। মার্কিন আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, ২০২৫-’২৬ অর্থবর্ষে নয়াদিল্লির বৃদ্ধির সূচক খুব বেশি হলে ৬.৫ শতাংশ থেকে ৫.৫ শতাংশে নামতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে উপেক্ষা করার সাহস দেখাতে পারছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।

০৭ ২০

তৃতীয়ত, ট্রাম্পের ফোন না ধরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের গুরুত্ব বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন মোদী। জার্মান গণমাধ্যমটির প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, কোনও অবস্থাতেই আমেরিকার কথায় বিদেশনীতিতে বদল আনবে না নয়াদিল্লি। এই আচরণের মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে মার্কিন প্রভাব আগের তুলনায় কমেছে। আর তাই ট্রাম্পের হুমকিকে সে ভাবে পাত্তা দিচ্ছে না নয়াদিল্লি।

০৮ ২০

চতুর্থত, গত ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে দেওয়া ভাষণে ‘পণ্য ও পরিষেবা কর’ বা জিএসটিতে (গুড্‌স অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) বড় বদল আনার কথা ঘোষণা করেন মোদী। সূত্রের খবর, আগামী দিনে এই বাবদ কেবলমাত্র দু’টি ধাপে কর নেবে সরকার। সেটা হল পাঁচ এবং ১৮ শতাংশ। এ বছরের সেপ্টেম্বরের গোড়ায় হওয়া জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকে সংশ্লিষ্ট বিষয়টিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

০৯ ২০

বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, জিএসটিতে ওই বদল এলে উৎসবের মরসুমে বাড়বে আর্থিক বৃদ্ধির সূচক। ফলে ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাইছেন না মোদী। বরং ঘরোয়া রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে বেশি করে নজর রাখছেন তিনি। এতে আগামী দিনে তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হল বলে যুক্তি দিয়েছেন তাঁরা।

১০ ২০

বর্তমানে ভারতের রফতানি বাণিজ্যের এক পঞ্চমাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপরে নির্ভরশীল। এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লির পণ্যে অন্যায্য ভাবে ট্রাম্প ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেওয়ায় এ দেশে হু-হু করে কমেছে তাঁর জনপ্রিয়তা। পিউ রিসার্চের সমীক্ষা অনুযায়ী, গত জুনে এ দেশের প্রতি দু’জনের মধ্যে এক জনের সমর্থন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দিকে। সেটা বর্তমানে প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে।

১১ ২০

গত ৩১ জুলাই ভারতীয় অর্থনীতিকে ‘মৃত’ বলে তোপ দাগেন ট্রাম্প। জার্মান গণমাধ্যম ‘ফ্রাঙ্কফুর্টার’ মনে করে, এতেও বেজায় চটেছিলেন মোদী। ওই সময় থেকেই বিকল্প বাজারের খোঁজ শুরু করে দেন তিনি। বর্তমানে সংঘাত ভুলে চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে নয়াদিল্লি। বেজিঙের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।

১২ ২০

এ বছরের এপ্রিলে পারস্পরিক শুল্কনীতি জারি করে ট্রাম্প প্রশাসন। ওই সময় ভারতীয় পণ্যে ২৬ শতাংশ কর ধার্য করেছিল ওয়াশিংটন। এর পরেই শুল্ক এড়াতে দু’তরফে শুরু হয় বাণিজ্যচুক্তি সংক্রান্ত আলোচনা। সেখানে কৃষি এবং দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রির জন্য এ দেশের বাজার খুলে দেওয়ার দাবি তোলে আমেরিকা। ভারতীয় কৃষক এবং ডেয়ারি শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের কথা মাথায় রেখে তাতে রাজি হয়নি নয়াদিল্লি।

১৩ ২০

ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে সংঘাত তৈরি হওয়ায় ধৈর্য হারান ট্রাম্প। আলোচনার মাঝে বার বার অতিরিক্ত শুল্ক চাপানোর হুমকি দিতে থাকেন তিনি। ২০২২ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক রাশিয়ার থেকে সস্তা দরে খনিজ তেল আমদানি করছে নয়াদিল্লি। জুলাইয়ে পৌঁছে সেটা বন্ধ করতে মোদীর উপর চাপ তৈরি করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

১৪ ২০

ট্রাম্পের যুক্তি হল, মস্কোর থেকে নয়াদিল্লি খনিজ তেল আমদানি করার কারণেই বন্ধ হচ্ছে না ইউক্রেন যুদ্ধ। ভারতের সঙ্গে এই ‘তরল সোনা’র বাণিজ্য করেই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার যাবতীয় অর্থ পেয়ে যাচ্ছে ক্রেমলিন। আর তাই মোদী সরকার এটা বন্ধ না করলে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

১৫ ২০

কিন্তু, ওই সময় দৃঢ় অবস্থান নেয় নয়াদিল্লি। জাতীয় স্বার্থে জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা মেটাতে রুশ খনিজ তেল ‘উরাল ক্রুড’-এর আমদানি যে বন্ধ করা হবে না, তা স্পষ্ট ওয়াশিংটনকে জানিয়ে দেয় মোদী সরকার। গত ২১ অগস্ট মস্কো সফররত বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘‘আমরা রুশ তেলের সর্বাধিক ক্রেতা নই। এ ক্ষেত্রে এক নম্বরে রয়েছে চিন।’’

১৬ ২০

এর পরেই আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়াকে আয়না দেখান ভারতের বিদেশমন্ত্রী। বলেন, ‘‘আমরা রাশিয়ার থেকে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (লিকুইড ন্যাচরাল গ্যাস বা এলএনজি) কিনছি না। সেটা সম্ভবত ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ২০২২ সালের পর মস্কোর সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক লেনদেন সর্বাধিক বৃদ্ধি পায়নি। আমি মনে করি সেই তালিকায় দক্ষিণের কিছু দেশ রয়েছে।’’ তাঁর ওই মন্তব্যের পর স্বাভাবিক ভাবেই একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে। এই দেশগুলির ক্ষেত্রে কেন খড়্গহস্ত হচ্ছে না ওয়াশিংটন?

১৭ ২০

ট্রাম্পের উপরে মোদীর রাগের দ্বিতীয় কারণ হল তাঁর পাকিস্তান প্রেম। গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে ইসলামাবাদের সঙ্গে ‘যুদ্ধে’ জড়ায় ভারত। চার দিনের লড়াইয়ের পর সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হয় দু’পক্ষ। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি, এ ব্যাপারে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। যদিও তা খারিজ করে সংসদে বিবৃতি দেন মোদী।

১৮ ২০

ভারত-পাক সংঘাত থামার পর দু’বার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। ট্রাম্পকে তাঁর সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করতে দেখা গিয়েছে। অগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভারতকে পরমাণু হামলার হুমকি দেন মুনির। কিন্তু তখনও নিশ্চুপ ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। একে তাঁর প্রচ্ছন্ন মদত হিসাবেই দেখেছিল নয়াদিল্লি।

১৯ ২০

২৩ অগস্ট একটি অনুষ্ঠানে সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা এবং পাকিস্তানের মধ্যে চলা ‘প্রেমের সম্পর্ক’ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন জয়শঙ্কর। তখনই ৯/১১ হামলার মূল চক্রী তথা কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী ‘আল-কায়দা’র প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন-লাদেনের প্রসঙ্গ টেনে আমেরিকাকে খোঁচা দেন বিদেশমন্ত্রী। পাশাপাশি, ওয়াশিংটন ও ইসালামাবাদের ‘ইতিহাস বিস্মৃতি’র রোগ আছে বলেও বিস্ফোরক মন্তব্য করেন তিনি।

২০ ২০

আগামী ৩১ অগস্ট ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিওর (সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজ়েশন) বৈঠকে যোগ দিতে চিনের তিয়েনজ়িতে যেতে পারেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সেখানে বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে পারেন ড্রাগনভূমির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এর পরই সেপ্টেম্বরে ভারতে আসার কথা রয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বেজিং-বিরোধী ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় নীতি বিশ বাঁও জলে গেল বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement