PM Modi in Cyprus

পাকিস্তানের বন্ধুকে জব্দ করতে ‘কূটনৈতিক চাল’! মোদীর সাইপ্রাস-তাসে ফালা ফালা ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’?

জি-৭ বৈঠকে যোগ দিতে কানাডা যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাসে জ্বালানি ভরতে থামবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিমান। কূটনৈতিক ভাবে একে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২৫ ০৭:৫৬
Share:
০১ ১৯

জি-৭ সম্মেলনে যোগ দিতে কানাডা সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রাস্তায় জ্বালানি ভরতে সাইপ্রাসে থামবে তাঁর বিমান। ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘পাকিস্তান-প্রেমী’ তুরস্কের সম্পর্ক ‘আদায়-কাঁচকলা’য়। ২৩ বছর পর সেখানে তৃতীয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পা পড়বে মোদীর। তাঁর এ হেন ‘কূটনৈতিক চালে’ অটোমান সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখা আঙ্কারার রক্তচাপ যে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেল, তা বলাই বাহুল্য।

০২ ১৯

‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা ‘যুদ্ধে’ পাকিস্তানের পাশে ছিল তুরস্ক। আঙ্কারার ড্রোনে উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের একাধিক সেনাছাউনিকে নিশানা করে ইসলামাবাদ। যদিও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে সেগুলিকে শূন্যেই ধ্বংস করে নয়াদিল্লি। এর পর চলতি বছরের ১০ মে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষবিরতি হলে ‘পাক-প্রেমী’ তুরস্ককে ‘সাজা’ দিতে পর পর বেশ কিছু পদক্ষেপ করে মোদী সরকার।

Advertisement
০৩ ১৯

এই আবহে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কানাডা যাওয়ার রাস্তায় সাইপ্রাসে থামার সিদ্ধান্তকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে মনে করছেন দুনিয়ার দুঁদে কূটনীতিকদের একাংশ। তাঁদের দাবি, এর মাধ্যমে তুরস্ককে স্পষ্ট বার্তা দেবেন মোদী। কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানকে বরাবর সমর্থন করে এসেছে আঙ্কারা। এ বার তাই পাল্টা সাইপ্রাসের জমি অবৈধ ভাবে কব্জা করে রাখায় তুরস্কের উপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করার কৌশল নিচ্ছে নয়াদিল্লি, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

০৪ ১৯

ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাসের কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। দেশটির উত্তরে তুরস্ক এবং পূর্ব দিকে গ্রিস। এই দ্বীপরাষ্ট্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব ভূমধ্যসাগর। পাশাপাশি, এখান থেকে পশ্চিম এশিয়ার ইজ়রায়েল, লেবানন এবং সিরিয়ার উপর নজরদারিও সম্ভব। সেই কারণে সম্পূর্ণ সাইপ্রাসকেই গিলে নেওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা রয়েছে তুরস্কের। একই ভাবে সেখানে পা জমাতে চায় গ্রিসও।

০৫ ১৯

একটা সময়ে গ্রিস এবং রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল সাইপ্রাস। কিন্তু ষোড়শ শতকে ভূমধ্যসাগরীয় এই দ্বীপরাষ্ট্র চলে যায় অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে। ওই সময়ে তাঁদের সাম্রাজ্যের সূর্য ছিল একেবারে মধ্যগগনে। দক্ষিণ ইউরোপ থেকে শুরু করে পশ্চিম এশিয়ার হয়ে একেবারে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত ছড়িয়েছিল এই অটোমান সাম্রাজ্যের বিশাল রাজপাট। সাইপ্রাস তাঁদের কব্জায় আসে ১৫৭১ সালে।

০৬ ১৯

কিন্তু উনিশ শতকে অটোমান সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হতে শুরু করলে বদলায় দক্ষিণ ইউরোপের রাজনীতি। ১৮৭৮ সালে সাইপ্রাসের কিছু অংশ চলে যায় ব্রিটেনের কব্জায়। সামুদ্রিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এর কৌশলগত গুরুত্ব ভালই বুঝেছিলেন ইংরেজ নাবিক এবং রাজনীতিবিদেরা। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের জোটের কাছে পরাজিত হলে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অটোমানদের ৬০০ বছরের সাম্রাজ্য।

০৭ ১৯

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল সাইপ্রাস। ১৯৩৯-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু, সেই লড়াই থামার পর ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা উপনিবেশগুলি ইংরেজ শাসন থেকে স্বাধীনতা পেতে শুরু করে। ঋণে জর্জরিত ব্রিটেনের পক্ষে তখন আর সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। ফলে ১৯৬০ সালে নতুন স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে সাইপ্রাস।

০৮ ১৯

ভূমধ্যসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটি স্বাধীনতা পেতেই সেটিকে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে ফেলে গ্রিস। ১৯৭৪ সালে স্থানীয় চরমপন্থীদের অভ্যুত্থানে রাতারাতি সাইপ্রাসে ঘটে ক্ষমতাবদল। এই অভ্যুত্থানে পূর্ণ সমর্থন ছিল আথেন্সের তৎকালীন জান্তা সরকারের। গ্রিকদের এই আগ্রাসী মনোভাবে প্রমাদ গোনে তুরস্ক। কারণ তত দিনে আঙ্কারা ও আথেন্সের মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে সীমান্ত বিবাদ। কালবিলম্ব না করে ওই বছরের ২০ জুলাই দ্বীপরাষ্ট্রটিকে আক্রমণ করে বসে তুর্কি সেনা।

০৯ ১৯

সদ্যস্বাধীন সাইপ্রাসের পক্ষে এই আক্রমণের চাপ সহ্য করা সম্ভব ছিল না। ফলে অনায়াসেই দ্বীপরাষ্ট্রটির এক তৃতীয়াংশ জমি দখল করে নেয় তুরস্ক। শেষে যুদ্ধ বন্ধ করতে উদ্যোগী হয় রাষ্ট্রপুঞ্জ। আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও দখল করা এলাকা থেকে বাহিনী সরায়নি আঙ্কারা। ওই এলাকার পোশাকি নাম ‘টার্কিস রিপাবলিক অফ নর্দার্ন সাইপ্রাস’ বা টিআরএনসি। একে আঙ্কারা স্বশাসিত এলাকা বলে থাকে।

১০ ১৯

টিআরএনসির আবার রাষ্ট্রপুঞ্জ বা আন্তর্জাতিক কোনও স্বীকৃতি নেই। একে একমাত্র মান্যতা দিয়েছে আঙ্কারা। তা ছাড়া তুরস্কের এই স্বশাসিত এলাকাটির সীমান্ত মোটেই সুনির্দিষ্ট নয়। দ্বীপরাষ্ট্রটির বাকি এলাকা শাসন করে গ্রিক সমর্থিত সাইপ্রিয়টেরা। দু’পক্ষের মধ্যে সীমান্ত বিবাদ এড়াতে মাঝে একটি বাফার জ়োন রেখেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ।

১১ ১৯

সাইপ্রাসের সরকার অবশ্য টিআরএনসির অস্তিত্ব মানতে নারাজ। তাঁরা একে তুরস্কের অবৈধ কব্জা বলে মনে করে। অন্য দিকে আঙ্কারার দাবি, ইতিহাসগত ভাবে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটি অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ফলে এর উপর কেবলমাত্র তুরস্কেরই অধিকার থাকা উচিত।

১২ ১৯

আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই বিবাদের মেলেনি কোনও সমাধানসূত্র। আর তাই ‘আগ্রাসী’ তুরস্কের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার চেষ্টা চালাচ্ছে সাইপ্রাস। কাশ্মীর ইস্যুতে বরাবর ভারতের পাশে থেকেছে ভূমধ্যসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্র। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, সেই কারণেই এক কদম এগিয়ে এ বার সেখানে পা রাখতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।

১৩ ১৯

১৯৬২ সালে সাইপ্রাসের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে নয়াদিল্লি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দু’তরফে সম্পর্ক বেশ নিবিড় হয়েছে। ২০২২-’২৩ আর্থিক বছরে দুই দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অঙ্ক ছিল ২০ হাজার কোটি ডলার। শুধু তা-ই নয়, ২০০২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ১,২৬৪ কোটি ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) এসেছে ভূমধ্যসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্র থেকে। এই দিক থেকে প্রথম ১০টি দেশের তালিকায় রয়েছে সাইপ্রাসের নাম।

১৪ ১৯

১৯৮৩ সালে প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সাইপ্রাস সফর করেন ইন্দিরা গান্ধী। এর পর ২০০২ সালে ভূমধ্যসাগরের ওই দ্বীপরাষ্ট্রে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। গত দু’দশকে দু’তরফে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মঞ্চে সাইপ্রাসের হয়ে বেশ কয়েক বার সুর চড়াতে দেখা গিয়েছে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে। এতে একেবারেই খুশি হতে পারেনি তুরস্ক।

১৫ ১৯

সাইপ্রাসের জনসংখ্যার বড় অংশই গ্রিক বংশোদ্ভূত এবং খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। কিন্তু, দেশটির উত্তর অংশ তুরস্ক দখল করার পর সেখান থেকে বিতাড়িত হতে হয় তাঁদের। ওই নাগরিকদের অধিকাংশকেই জেলে পোরে আঙ্কারা। বাকিদের বুক ফুঁড়ে দেয় পুরনো অটোমান সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখা তুর্কি সৈন্যদের বুলেট। এতে দ্বীপরাষ্ট্রটির দক্ষিণ অংশে দিন দিন বাড়ছে ক্ষোভের আগুন।

১৬ ১৯

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, বর্তমানে এই ক্ষোভকেই কাজে লাগাতে চাইছে নয়াদিল্লি। আগামী দিনে ভারতের সঙ্গে মোটা অঙ্কের প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলতে পারে সাইপ্রাসের সরকার। নয়াদিল্লি থেকে অত্যাধুনিক ড্রোন, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র কেনার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। যদিও সরকারি ভাবে এখনও এই নিয়ে কোনও তথ্য প্রকাশ্যে আনেনি দুই দেশ।

১৭ ১৯

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল সাইপ্রাসের কাছে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউর সদস্যপদ। আগামী বছরের গোড়ায় সংগঠনটির পর্যায়ক্রমিক সভাপতি হবে ভূমধ্যসাগরীয় এই দ্বীপরাষ্ট্র। সে ক্ষেত্রে ইইউ এবং ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বেশি মজবুত হতে পারে। ইইউ-এর সদস্যপদ পাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে তুরস্কের। সাইপ্রাস সভাপতি হলে সে গুড়ে যে বালি পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

১৮ ১৯

অতীতে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করার কারণে বেশ কয়েক বার ‘ফিনান্সিয়াল অ্যাকশান টাস্ক ফোর্স’ বা এফএটিএফের ধূসর তালিকায় জায়গা হয়েছে তুরস্কের। দক্ষিণ ইউরোপের দেশটির আর্থিক সঙ্কট ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, ভারতের কূটনৈতিক চালে ফের কপাল পুড়তে পারে আঙ্কারার। তাদের আবার এফএটিএফের ধূসর বা কালো তালিকায় ঠেলে দিতে বর্তমানে মরিয়া হয়ে উঠেছে নয়াদিল্লি।

১৯ ১৯

আগামী ১৫ জুন জি-৭ বৈঠকে যোগ দিতে কানাডার উদ্দেশে রওনা হবেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ওই দিনই সাইপ্রাস ছুঁয়ে উত্তর আমেরিকার দেশটিতে পৌঁছোবেন তিনি। এ বারের জি-৭ বৈঠক হবে কানাডার আলবার্টার কানানস্কিসে। ১৭ জুন ফেরার পথে মোদীর বিমান ইউরোপের বলকান এলাকার ক্রোয়েশিয়াতে থামবে বলে জানা গিয়েছে।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement