গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত পুবের প্রতিবেশী। বাতাসে শুধুই বারুদের গন্ধ! এ-হেন মৃত্যুপুরীতে নিঃশব্দে পা ফেলেছে ড্রাগন। ঠিক তার পিছনে ঢুকেছে ভারতও। শুধু তা-ই নয়, সেখানে পা জমাতে ‘পরম বন্ধু’কে পাশে পাচ্ছে নয়াদিল্লি। ফলে গোটা ঘটনাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
ভারতের পূর্বের সাবেক বর্মা তথা অধুনা মায়ানমারে লম্বা সময় ধরে চলছে গৃহযুদ্ধ। ফলে ইরাবতীর তীরে লগ্নির ক্ষেত্রে একরকম মুখ ফিরিয়েই রেখেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। ব্যতিক্রম নয়াদিল্লি এবং বেজিং। এ বার নতুন খেলোয়াড় হিসাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে রাশিয়ার প্রবেশ ঘটতে চলেছে বলে জানা গিয়েছে।
মায়ানমারের স্থানীয় সংবাদ সংস্থা ‘ইরাবতী’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, দাউই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (স্পেশাল ইকোনমিক জ়োন বা এসইজ়েড) লগ্নির ব্যাপারে প্রবল উৎসাহ রয়েছে মস্কোর। আগে সেখানে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছিল তাইল্যান্ড। কিন্তু গৃহযুদ্ধের কারণে ধীরে ধীরে সেখান থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে ব্যাঙ্কক।
চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি দাউই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করেন মায়ানমারের রুশ রাষ্ট্রদূত ইস্কান্দার আজ়িজ়ভ। ওই দিনই প্রকল্পটির চেয়ারম্যান তথা তানিনথারি এলাকার মন্ত্রী মিয়াত-কোর সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। ইয়াঙ্গনের (সাবেক রেঙ্গুন) জুন্টা সেনা সরকার তাঁকে সংশ্লিষ্ট পদে নিয়োগ করেছে বলে জানা গিয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব মায়ানমারের শহর দাউই, তানিনথারি এলাকার রাজধানী হিসাবে পরিচিত। এর অবস্থান বঙ্গোপসাগরের তীরে হওয়ায় কৌশলগত দিক থেকে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দাউইতে বন্দর এবং বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা গড়ে তুলে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি মজবুত করার পরিকল্পনা রয়েছে জুন্টা সেনা সরকারের।
গত বছরের মার্চে বিষয়টি নিয়ে রুশ সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসের কাছে মুখ খোলেন জুন্টা প্রধান জেনারেল মিন অং-হ্লাইং। সেখানে দাউই বন্দর প্রকল্পের কাজ শেষ করতে খোলাখুলি ভাবে মস্কোর সাহায্য চান তিনি। সমুদ্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বন্দরটির পরিবহণ ক্ষমতা দু’লক্ষ টনে গিয়ে দাঁড়াবে বলে দাবি করেছেন জুন্টা প্রধান।
‘ইরাবতী’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর পর থেকেই মায়ানমারে লগ্নির ব্যাপারে তৎপর হন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গত ১০ মাসে দাউই এসইজ়েড নিয়ে জুন্টা সরকারের প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন ইয়াঙ্গনে মস্কোর রাষ্ট্রদূত। এরই সর্বশেষ পরিণতি হিসাবে বন্দর এলাকাটি পরিদর্শন করেছেন ইস্কান্দার আজ়িজ়ভ।
মায়ানমারে ইতিমধ্যেই বিপুল বিনিয়োগ করেছে চিন। দেশটির পূর্ব দিকের রাখাইন রাজ্যের কিয়াকফিউ এলাকায় বেজিঙের সহযোগিতায় গড়ে উঠছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ ছাড়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পেও কাজ করছে ড্রাগনভূমির একাধিক সংস্থা।
একই ভাবে রাখাইন রাজ্যে লগ্নি রয়েছে ভারতের। সেখানে কালাদান মাল্টি মডেল ট্রানজ়িট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের কাজ চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। এর মাধ্যমে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
গত বছরের একেবারে শেষে মায়ানমারের সামরিক জুন্টা সরকারের থেকে রাখাইন এলাকা ছিনিয়ে নেয় বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। তবে কালাদান প্রকল্পের কাজে বাধা না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। অন্য দিকে ইয়াঙ্গনের তরফেও নয়াদিল্লিকে দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
অন্য দিকে মায়ানমারের চিনা দূতাবাস জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারির গোড়ায় তানিনথারি এলাকার মুখ্যমন্ত্রী মিয়াত-কোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বেজিঙের রাজদূত মা জ়িয়া। সমুদ্র থেকে মাছ শিকার, বিদ্যুৎ, পর্যটন, শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগে সহযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে সদর্থক আলোচনার খবর মিলেছে।
এই পরিস্থিতিতে বঙ্গোপসাগরের কোলের তানিনথারি নিয়ে মস্কোর আগ্রহকে আলাদা চোখে দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। রুশ রাষ্ট্রদূত ইস্কান্দার আজ়িজ়ভ জানিয়েছেন, পর্যটন শিল্পে লগ্নি করতে চান তাঁরা। বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
দাউই এসইজ়েডের একেবারে গা ঘেঁষে চলে গিয়েছে আন্দামান সাগর। বিশেষ এই অর্থনৈতিক অঞ্চলটি সড়কপথে তাইল্যান্ড উপসাগরের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভবিষ্যতে ভারত এবং প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে যোগসাধনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হবে মায়ানমারের বন্দর শহর দাউই।
১৯৬ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে উঠছে দাউইয়ের বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা। এর মধ্যে রয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর। মায়ানমারের বন্দরটির নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হলে, মলাক্কা প্রণালীকে এড়িয়ে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য করা যাবে। সে দিক থেকে এর আর্থিক গুরুত্ব অপরিসীম।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, দাউই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে উচ্চ প্রযুক্তির শিল্পাঞ্চল। এ ছাড়া আগামী দিনে সেখানে থাকবে তথ্যপ্রযুক্তি জ়োন, রফতানি দ্রব্য প্রসেসিং কেন্দ্র, পরিবহণ এবং ব্যবসায়িক হাব। আর তাই রাশিয়ার নজর এর উপরে পড়েছে বলে স্পষ্ট করেছেন তাঁরা।
২০০৮ সালে দাউইতে বিশেষ আর্থিক অঞ্চল গড়ে তুলতে মায়ানমারের তৎকালীন সরকারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে তাইল্যান্ড। পরবর্তী কালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জুন্টা ক্ষমতায় এলেও সেই চুক্তি অটুট ছিল। কিন্তু গৃহযুদ্ধের জেরে থমকে রয়েছে ওই প্রকল্পের কাজ।
২০১২ সালে দুই দেশের মধ্যে এই এসইজ়েড নিয়ে আরও একটি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছিল। সেখানে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল মায়ানমার ও তাইল্যান্ড। যদিও তা পূরণ করতে পারেনি ইয়াঙ্গন এবং ব্যাঙ্কক।
দাউই বিশেষ আর্থিক অঞ্চল নির্মাণের দায়িত্ব পায় তাইল্যান্ডের শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত সংস্থা ‘ইতালিয়ান-তাই ডেভেলপমেন্ট’। মায়ানমারে বিনিয়োগের উপরে ৭৫ বছরের ছাড় পেয়েছিল তারা। কিন্তু, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটির সঙ্গে যাবতীয় চুক্তি বাতিল করে মায়ানমার সরকার।
সূত্রের খবর, এর পরই দাউইতে লগ্নির ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে রাশিয়া। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ইরাবতীর তীরে মস্কোর প্রভাব বৃদ্ধি পেলে আখেরে লাভ হবে ভারতের। কারণ, সে ক্ষেত্রে চিনের উপর ঘুরপথে চাপ তৈরির সুযোগ থাকবে নয়াদিল্লির হাতে।
২০২২ সালের নভেম্বরে জুন্টা প্রধান জেনারেল হ্লাইং দাউই পরিদর্শন করেন। প্রকল্পের কাজ চালু করার কথা বলেছেন তিনি। গত বছরের মাঝামাঝি একই সুর শোনা গিয়েছিল জান্তার উপপ্রধান সোয়ে উইনের গলায়। ফলে এ বছর মস্কোর লগ্নির ইরাবতীর তীরে পৌঁছবে বলে মনে করা হচ্ছে।